শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭

তুরস্কে অনুদার গণতন্ত্রে 'একুশ শতকের সুলতান' এর্দোগান 

২০১৯-এ প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে এলে ২০২৯ অবধি প্রায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হবেন রিসেপ তায়িপ এর্দোগান

সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী

তরুণ তুর্কি না হলেও, রিসেপ তায়িপ এর্দোগান নবরূপেই তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আবির্ভূত হয়েছেন। ১৬ এপ্রিলের গণভোট তাঁর ক্ষমতা নিঃসন্দেহে অনেকটা বাড়িয়ে দিল। এই প্রেক্ষিতে অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ইতিমধ্যেই তাঁকে ‘একুশ শতকের সুলতান’ বলে উল্লেখ করতেও শুরু করেছেন।

পক্ষকাল আগে অনুষ্ঠিত তুরস্কের গণভোটে ৫১.৪ শতাংশ ভোটদাতা হ্যাঁ-বাচক ভোট দিয়েছেন, বিপক্ষে ৪৮.৬ শতাংশ। দুই মতাবলম্বী মানুষের ভোটের ফারাক যৎসামান্য বলে এর্দোগানের উপরে কিছুটা চাপ থাকছেই। কিন্তু এর ফলে দীর্ঘ দিনের সংসদীয় ব্যবস্থাকে বদলে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু হতে চলেছে। প্রসঙ্গত, ভারতেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। তুরস্কে নতুন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রায় যাবতীয় প্রশাসনিক ক্ষমতাই প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত হবে। প্রেসিডেন্ট যেমন ডিক্রি জারি করতে পারবেন, তেমনই অদূর ভবিষ্যতে পছন্দসই বিপুলসংখ্যক বিচারপতি ও সরকারি আধিকারিক নিয়োগও করতে পারবেন। নতুন প্রেসিডেন্ট সর্বাধিক দু’দফায় পাঁচ বছর করে মোট দশ বছর স্বপদে আসীন থাকতে পারবেন। এমনকী কোনও কারণে দেশের পার্লামেন্ট তাঁর দ্বিতীয় দফার নির্দিষ্ট মেয়াদে ছেদ ঘটালে তৃতীয় বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগও থাকছে। ২০১৯-এ এই পর্বান্তর সম্পন্ন হবে। সুতরাং, এর্দোগান ওই বছরে নতুন ভাবে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে তিনি ২০২৯ অবধি প্রায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হবেন। বস্তুত, এই ব্যবস্থাগুলির পরিণামে তুরস্কে প্রশাসনিক ও বিচারবিভাগীয় যাবতীয় ক্ষমতাই প্রেসিডেন্ট এর্দোগানের একার হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা।

গত বছর জুলাইতে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই নতুন করে রাজনৈতিক ঘুঁটি সাজাতে এর্দোগান সচেষ্ট। এই গণভোট তারই পরিণতি। কিন্তু জরুরি অবস্থা চলাকালীন এই গণভোট কি গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়? উদার গণতন্ত্রের পথা ছেড়ে অনুদার গণতন্ত্রকেই বেছে নেওয়া হল, এ মত অনেকেরই। অনুদার গণতন্ত্রের পদচারণা এখন পৃথিবীর বহু দেশেই। উদার গণতন্ত্র বলে সুপরিচিত বিশ্বের অনেক দেশই আজ অনুদার গণতন্ত্রমুখী। নিকটবর্তী হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবানও সেই পথেই চলতে স্বচ্ছন্দ। অনেক দেশেই আজ সংখ্যালঘু ধর্মীয় বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ইসলাম-আতঙ্কও ক্রমবর্ধমান। এই পরিস্থিতিতে তুর্কি ছাড়াও তুরস্কে যে কুর্দ, আলেভি বা স্বল্পসংখ্যক গ্রিক, আর্মেনীয় বা ইহুদি রয়েছেন, এর্দোগানের আগামী তুরস্কে তাঁদের যে কী হাল হবে, তা স্পষ্ট নয়। কামাল আতাতুর্কের দেখানো ‘সেকুলার’ সরণি বেয়ে যে এই তুরস্ক চলবে, এমন ভরসা কমই। জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নিরিখে হাজার পঁয়তাল্লিশ মানুষকে ইতিমধ্যেই আটক করেছে সরকার। এক লক্ষ ত্রিশ হাজারের মতো সরকারি কর্মীকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড বা ছাঁটাই করা হয়েছে। অথচ, তুরস্কের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও সুবিধের নয়। ১৩ শতাংশ বেকারির হারে জর্জরিত দেশ। সেই দেশকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ কতটা করতে পারেন এর্দোগান, সেটাই দেখার।

গণভোটের অব্যবহিত পরেই উত্তর সিরিয়া ও উত্তর ইরাকে তুর্কি যুদ্ধবিমান আমেরিকাকে মাত্র এক ঘণ্টা আগে খবর দিয়ে বোমা ফেলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণভোটে এর্দোগানের সাফল্যে প্রাথমিক পর্যায়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বটে। কিন্তু এই বিমান হানাকে আমেরিকা স্বাগত জানাবে, এমন ইঙ্গিত নেই। আসলে, কুর্দ জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে বিমান হানার যুক্তিকে ওয়াশিংটন স্বাগত জানাবে না।

আর এক দিকে, এর্দোগান যে ভাবে তুরস্কে মৃত্যুদণ্ড পুনরায় চালু করতে উদ্যত, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের না-পসন্দ। এর্দোগানও বর্তমানে ইউরোপের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের চাইতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে বেশি আগ্রহী। ইউরোপই যে তুরস্কের বৃহত্তম বাণিজ্যিক সঙ্গী। আবার বিগত সাত দশক ধরে ইউরোপীয় জোটে তুরস্কের প্রবেশাধিকারে বাধা দেওয়া হয়েছে, এই উষ্মা খোদ এর্দোগানেরই। তাই তুরস্কের ইউরোপীয় সংযোগও প্রশ্নচিহ্নের মুখে।

২০১১ থেকে সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে অন্তত ৫০ লক্ষ মানুষ সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিবেশী সিরিয়া থেকে যাতে আরও শরণার্থী তুরস্কে প্রবেশ করতে না পারেন, এর্দোগান সে বিষয়ে সচেষ্ট। প্রসঙ্গত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রেক্ষিতে বর্তমান তুরস্ক-সিরিয়া সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের আন্তালোয়াতে এই সীমানা শুরু হয়ে মোটামুটি পুবমুখী হয়ে ইউফ্রেটিস নদী বরাবর মেসোপটেমিয়ার উজানি এলাকা পার হয়ে যেখানে টাইগ্রিস নদী ইরাকে প্রবেশ করছে, সেই পর্যন্ত বিস্তৃত এই সীমা। সেই সীমানা বরাবর পাঁচিল তোলা নিয়েও বিতর্ক কম নয়। ইউরোপীয় বহু দেশও এ নিয়ে যথেষ্ট সরব।

এই প্রেক্ষাপটে চিন, রাশিয়া, এমনকী ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে তুরস্কের আগ্রহ মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চিনের উপদ্রুত জিনজিয়াং প্রদেশে তুর্কিভাষী মানুষেরা এর্দোগানের ‘বৃহত্তর তুর্কিস্তান’-এর স্বপ্নকে গ্রহণ করলে তা বেজিংয়ের অস্বস্তি বাড়াবে বই কী। আবার, বেজিংয়ের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতির কট্টর সমর্থক প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এর্দোগান।

নতুন ভাবে ক্ষমতাবান এর্দোগান প্রথমেই ভারতে পা রাখছেন। বছর নয় আগে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এ বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগমন। পারমাণবিক শক্তি সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে তুরস্ক দাঁড়াবে, দৃঢ় আশা নয়াদিল্লির। কিন্তু কাশ্মীর বা পাকিস্তান প্রসঙ্গে এর্দোগানের নতুন তুরস্ক কী অবস্থান নেয়, তা দেখার। তবে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকারের সঙ্গে ‘উত্তর-ইসলামি’ তুরস্কের নব রসায়ন ঘনীভূত হলে ইউরেশীয় আঞ্চলিক রাজনীতির ওপরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।

সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক