মমতার চোখে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি হাসপাতালচিত্র
দৈনিক এই সময়, কলকাতা
চিকিৎসায় অবহেলা৷ কথায় কথায় বিল বাড়ানো৷ প্যাকেজ ছাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা দাবি৷ টাকা না-মেটালে জবরদস্তি দেহ আটকে রাখা৷ মানসিক চাপ বাড়িয়ে রোগীর পরিজনকে ঘটি-বাটি বেচতে বাধ্য করা৷বেসরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে এ সব অভিযোগ হরবখত করে আমজনতা৷ এ বার সেই সব কথাই শোনা গেল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও৷ প্রকাশ্যে৷
বুধবার দুপুরে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার বেসরকারি হাসপাতাল কর্তাদের নিয়ে টাউন হলে আয়োজিত মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে তিনি সিলমোহর দিলেন সাধারণ মানুষের তোলা প্রায় সব ক’টি অভিযোগেই৷ শুধু জনতার বক্তব্য এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর গলাতেই উঠে আসেনি, যে ভাবে তিনি ধমকালেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে, তাতেও আমজনতার ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট৷ হাসপাতাল-নার্সিংহোমগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে তিনি অচিরেই হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে আইন তৈরি এবং ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাব্লিশমেন্ট আইন সংশোধনের কথাও ঘোষণা করেন৷ এ দিন বিকেলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলির প্রসঙ্গে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই তো ভুক্তভোগী ! আমি নিজে পুরোটা রিভিউ করব৷’
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অ্যাপোলোর বিরুদ্ধেই৷ বাংলাদেশ সরকারের তরফেও বেশি বিলের অভিযোগ এসেছে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে৷
তার আগে দুপুরবেলা অবশ্য টাউন হলেই মুখ্যমন্ত্রী কার্যত চাবকান কর্পোরেট কর্তাদের৷ ঠিক যে ঢঙে তিনি জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করেন, সেই একই কায়দায় কর্পোরেট হাসপাতাল কর্তাদেরও মুখ্যমন্ত্রী ক্লাস নেন একেবারে ‘দিদিমণি’র মেজাজেই৷ ফারাক একটাই৷ প্রশাসনিক বৈঠক হয় রুদ্ধদ্বার কক্ষে৷ আর হাসপাতাল-নার্সিংহোম কর্তাদের তিনি ধমক দিলেন সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে, একেবারে টিভি চ্যানেলের ‘লাইভ’ সম্প্রচারকে সাক্ষী রেখে৷ রীতিমতো তথ্যপ্রমাণ পেশ করে, ধরে ধরে তিনি এক-একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমজনতার ক্ষোভ নিয়ে সওয়াল করলেন বৈঠকে৷ আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কার্যত মুখ বুজে সে-সব অভিযোগ মেনে নিয়ে নিজেদের শোধরানোর অঙ্গীকারকরলেন কর্পোরেট কর্তারা৷ বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দেন, আর পাঁচটা বৈঠকের পুনরাবৃত্তি এ দিন হতেযাচ্ছে না৷ জানিয়ে দেন , সরকার বসে নেই৷বেসরকারি হাসপাতালদের কাজকর্ম নিয়ে‘হোমওয়ার্ক’ সরকার অনেক আগেই শুরুকরেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘অনেক দিনধরেই ভাবছিলাম , বসব৷ অবহেলা, দেহআটকে রাখা, অতিরিক্ত বিল নিয়ে ভূরি ভূরিঅভিযোগ আসছিলই৷ এমনকি, বাংলাদেশথেকেও অভিযোগ পাচ্ছিলাম৷ তাই সাভেশুরু করেছিলাম আগেই৷ ৯৪২টায় সাভেকরিয়ে ৭০টাকে শো -কজ করা হয়েছে, ৩৩টার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে৷ যেসব অভিযোগ উঠেছিল, বিধানসভার করাএই সার্ভেতে সেগুলির সব ক’টিই প্রমাণিত৷ ভাবতে পারেন, আমাদের এক এমপি-র বিলহয়েছে ৩৫ লাখ টাকা ! সব জানি, মুখখোলাবেন না৷ হাসপাতালের নাম বলতে আমাকে বাধ্য করবেন না, প্লিজ৷’ নিজেরঅভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর নিজেরই এমআরআই রিপোর্টে এমন একটি অঙ্গের উল্লেখ ছিল, যা বহু দিন আগেই বাদ চলে গিয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘কর্পোরেট’ জালিয়াতির ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট৷
এ দিনের বৈঠকে নাম ধরে ধরে হাসপাতাল কর্তাদের জবাবদিহি চান মুখ্যমন্ত্রী৷ বলেন, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অ্যাপোলোর বিরুদ্ধেই৷ বাংলাদেশ সরকারের তরফেও বেশি বিলের অভিযোগ এসেছে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে৷ রেয়াত করেননি বেলভিউ ক্লিনিকের মতো হাসপাতালকেও যেখানে তিনি নিজে তো বটেই, তাঁর সাংসদ ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা -মন্ত্রী -বিধায়ক -সাংসদরা বরাবর ভর্তি হয়ে থাকেন৷ রুবি জেনারেল, মেডিকা , কেপিসি -দের সম্পর্কে সরাসরি আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে কলকাতার মোট ১৯টি নামি বেসরকারি হাসপাতালকেও তিনি বক্তব্য পেশ করতে বলেন এ দিনের বৈঠকে৷ সব হাসপাতালকে ই-প্রেসক্রিপশন চালুর নির্দেশ দেন তিনি৷ টাকার জিগির তুলে ইমার্জেন্সি থেকে কোনও মতেই যে কোনও রোগীকে ফেরানো যাবে না, জীবনদায়ী প্রাথমিক চিকিত্সাটুকু যে দিতেই হবে, সেই মর্মেও মুখ্যমন্ত্রী সাফ নির্দেশ দেন কর্পোরেট হাসাপাতাল কর্তাদের৷ স্বাস্থ্যসাথীর তালিকায় কিছু হাসপাতাল নাম লেখানোর আগ্রহ না -দেখানোয় মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দেন , ‘আমাকেও তা হলে আপনাদের লাইসেন্স নিয়ে ভাবতে হবে৷’
আমরি এবং সিএমআরআইয়ের কোনও প্রতিনিধি কেন সাম্প্রতিক স্বাস্থ্যসাথীর বৈঠকে স্বাস্থ্যভবনে আসেননি , তারও কৈফিয়ত চান মুখ্যমন্ত্রী৷ পরিষেবা ও বিলের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব , সমন্বয়হীনতা , ছলে -বলে -কৌশলে বিল বাড়িয়ে দেখানো , হাসপাতাল থেকেই তাদের নির্ধারিত রেটে ডায়গনস্টিক পরীক্ষা করানো ও ওষুধ কিনতে রোগী -পরিজনকে বাধ্য করা , দরকারের সময়ে কেস সামারি দিতে না -চাওয়া , বিল না -মেটালে দেহ আটকে রাখা , নোটবন্দির সময়েও চেক পেমেন্ট নিতে না -চাওয়া , প্যাকেজে এক রকম বলে অন্য রকম বিল করা , এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল নিয়েও সমস্যা তৈরি কেন করা হচ্ছে লাগাতার , সে সবের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে বলেন কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলির ৩৬টি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের কাছ থেকে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাপুটে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে কর্পোরেট কর্তাদের জবাব দিতে দেখা গিয়েছে হেডমাস্টারের সামনে ক্লাসে দোষ ধরা পড়ে যাওয়া ছাত্রদের ঢঙে৷ গোড়া থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল , তিনি প্রস্ত্ততি নিয়েই এসেছেন৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলির উদ্দেশে তিনি বলেন , ‘আপনারা তো যা -তা করে চলেছেন৷ ২০ % ইনকাম করুন না৷ তা বলে ১০০ % করবেন ! তা হলে তো জহ্লাদের কারখানা হয়ে যায়৷ বিজ্ঞাপনে বলবেন হার্ট সার্জারির প্যাকেজ দেড় লাখ টাকা আর তার পর পেশেন্ট খারাপ হয়ে গিয়েছে বলে আইসিইউ -তে ঢুকিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা বিল করবেন ! ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের নামে পেশেন্টকে তো আরও ক্রিটিক্যাল করে দেবেন দেখছি৷ এটা কি কল -কারখানা নাকি ? এটা কোনও সিস্টেম হল?’ তিনি জানান, এ সবই তাঁর নয়, সাধারণ মানুষের অভিযোগ৷ বৈঠকে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ পদস্থ আমলারা উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন৷
স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্লা জানান , কোনও হাসপাতালই চুক্তির তোয়াক্কা করে না৷ স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে সরাসরি অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেন, ১০ % ইন্ডোর বেড এবং ২০ % আউটডোর পরিষেবা যে গরিবদের জন্য দেওয়ার কথা, তা কি তারা দেয় ? জবাবে অ্যাপোলোর কর্তা জানান , নিয়ম অনুযায়ী যাঁদের বার্ষিক আয় ছ’ হাজার টাকার কম, তাঁদের বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়া হয়৷ চমকে উঠে মুখ্যমন্ত্রী তখন বলে ওঠেন, ‘এটা হয় নাকি? ভিখিরির বার্ষিক আয়ও তো ছ’হাজার টাকার বেশি৷ মান্ধাতা আমলের চুক্তি আর নিয়মকানুনের সুযোগ এ ভাবে আপনারা নেন !’
বেলভিউয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়, তাদের হাসপাতাল থেকে নার্সরা যে হারে সরকারি চাকরিতে চলে যাচ্ছেন, তা আটকাতে যেন সরকার বিধিনিষেধ চালু করে৷ মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ভত্র্সনার সুরেই বলে ওঠেন, ‘আপনারা তো প্রচুর আয় করেন৷ তা হলে নার্সদের বেতন বাড়ান না কেন? বেশি বেতন মেলে বলেই তো নার্সরা সরকারি চাকরিতে চলে আসে৷ তা ছাড়া কে কোথায় চাকরি করবে তা আইন দিয়ে আটকানো যায় না৷ সেই বিকল্পটা বাছা মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে৷’