বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

টাকা না দিলে মৃতদেহ আটক, রোগী-পরিজনকে ঘটি-বাটি বেচতে বাধ্য করা

মমতার চোখে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি হাসপাতালচিত্র

দৈনিক এই সময়, কলকাতা 

চিকিৎসায় অবহেলা৷ কথায় কথায় বিল বাড়ানো৷ প্যাকেজ ছাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা দাবি৷ টাকা না-মেটালে জবরদস্তি দেহ আটকে রাখা৷ মানসিক চাপ বাড়িয়ে রোগীর পরিজনকে ঘটি-বাটি বেচতে বাধ্য করা৷

বেসরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে এ সব অভিযোগ হরবখত করে আমজনতা৷ এ বার সেই সব কথাই শোনা গেল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও৷ প্রকাশ্যে৷

বুধবার দুপুরে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার বেসরকারি হাসপাতাল কর্তাদের নিয়ে টাউন হলে আয়োজিত মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে তিনি সিলমোহর দিলেন সাধারণ মানুষের তোলা প্রায় সব ক’টি অভিযোগেই৷ শুধু জনতার বক্তব্য এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর গলাতেই উঠে আসেনি, যে ভাবে তিনি ধমকালেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে, তাতেও আমজনতার ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট৷ হাসপাতাল-নার্সিংহোমগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে তিনি অচিরেই হেলথ রেগুলেটরি কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে আইন তৈরি এবং ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাব্লিশমেন্ট আইন সংশোধনের কথাও ঘোষণা করেন৷ এ দিন বিকেলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলির প্রসঙ্গে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই তো ভুক্তভোগী ! আমি নিজে পুরোটা রিভিউ করব৷’

সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অ্যাপোলোর বিরুদ্ধেই৷ বাংলাদেশ সরকারের তরফেও বেশি বিলের অভিযোগ এসেছে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে৷

তার আগে দুপুরবেলা অবশ্য টাউন হলেই মুখ্যমন্ত্রী কার্যত চাবকান কর্পোরেট কর্তাদের৷ ঠিক যে ঢঙে তিনি জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করেন, সেই একই কায়দায় কর্পোরেট হাসপাতাল কর্তাদেরও মুখ্যমন্ত্রী ক্লাস নেন একেবারে ‘দিদিমণি’র মেজাজেই৷ ফারাক একটাই৷ প্রশাসনিক বৈঠক হয় রুদ্ধদ্বার কক্ষে৷ আর হাসপাতাল-নার্সিংহোম কর্তাদের তিনি ধমক দিলেন সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে, একেবারে টিভি চ্যানেলের ‘লাইভ’ সম্প্রচারকে সাক্ষী রেখে৷ রীতিমতো তথ্যপ্রমাণ পেশ করে, ধরে ধরে তিনি এক-একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমজনতার ক্ষোভ নিয়ে সওয়াল করলেন বৈঠকে৷ আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কার্যত মুখ বুজে সে-সব অভিযোগ মেনে নিয়ে নিজেদের শোধরানোর অঙ্গীকারকরলেন কর্পোরেট কর্তারা৷ বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দেন, আর পাঁচটা বৈঠকের পুনরাবৃত্তি এ দিন হতেযাচ্ছে না৷ জানিয়ে দেন , সরকার বসে নেই৷

বেসরকারি হাসপাতালদের কাজকর্ম নিয়ে‘হোমওয়ার্ক’ সরকার অনেক আগেই শুরুকরেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘অনেক দিনধরেই ভাবছিলাম , বসব৷ অবহেলা, দেহআটকে রাখা, অতিরিক্ত বিল নিয়ে ভূরি ভূরিঅভিযোগ আসছিলই৷ এমনকি, বাংলাদেশথেকেও অভিযোগ পাচ্ছিলাম৷ তাই সাভেশুরু করেছিলাম আগেই৷ ৯৪২টায় সাভেকরিয়ে ৭০টাকে শো -কজ করা হয়েছে, ৩৩টার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে৷ যেসব অভিযোগ উঠেছিল, বিধানসভার করাএই সার্ভেতে সেগুলির সব ক’টিই প্রমাণিত৷ ভাবতে পারেন, আমাদের এক এমপি-র বিলহয়েছে ৩৫ লাখ টাকা ! সব জানি, মুখখোলাবেন না৷ হাসপাতালের নাম বলতে আমাকে বাধ্য করবেন না, প্লিজ৷’ নিজেরঅভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর নিজেরই এমআরআই রিপোর্টে এমন একটি অঙ্গের উল্লেখ ছিল, যা বহু দিন আগেই বাদ চলে গিয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘কর্পোরেট’ জালিয়াতির ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট৷

এ দিনের বৈঠকে নাম ধরে ধরে হাসপাতাল কর্তাদের জবাবদিহি চান মুখ্যমন্ত্রী৷ বলেন, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অ্যাপোলোর বিরুদ্ধেই৷ বাংলাদেশ সরকারের তরফেও বেশি বিলের অভিযোগ এসেছে অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে৷ রেয়াত করেননি বেলভিউ ক্লিনিকের মতো হাসপাতালকেও যেখানে তিনি নিজে তো বটেই, তাঁর সাংসদ ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা -মন্ত্রী -বিধায়ক -সাংসদরা বরাবর ভর্তি হয়ে থাকেন৷ রুবি জেনারেল, মেডিকা , কেপিসি -দের সম্পর্কে সরাসরি আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে কলকাতার মোট ১৯টি নামি বেসরকারি হাসপাতালকেও তিনি বক্তব্য পেশ করতে বলেন এ দিনের বৈঠকে৷ সব হাসপাতালকে ই-প্রেসক্রিপশন চালুর নির্দেশ দেন তিনি৷ টাকার জিগির তুলে ইমার্জেন্সি থেকে কোনও মতেই যে কোনও রোগীকে ফেরানো যাবে না, জীবনদায়ী প্রাথমিক চিকিত্সাটুকু যে দিতেই হবে, সেই মর্মেও মুখ্যমন্ত্রী সাফ নির্দেশ দেন কর্পোরেট হাসাপাতাল কর্তাদের৷ স্বাস্থ্যসাথীর তালিকায় কিছু হাসপাতাল নাম লেখানোর আগ্রহ না -দেখানোয় মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দেন , ‘আমাকেও তা হলে আপনাদের লাইসেন্স নিয়ে ভাবতে হবে৷’

আমরি এবং সিএমআরআইয়ের কোনও প্রতিনিধি কেন সাম্প্রতিক স্বাস্থ্যসাথীর বৈঠকে স্বাস্থ্যভবনে আসেননি , তারও কৈফিয়ত চান মুখ্যমন্ত্রী৷ পরিষেবা ও বিলের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব , সমন্বয়হীনতা , ছলে -বলে -কৌশলে বিল বাড়িয়ে দেখানো , হাসপাতাল থেকেই তাদের নির্ধারিত রেটে ডায়গনস্টিক পরীক্ষা করানো ও ওষুধ কিনতে রোগী -পরিজনকে বাধ্য করা , দরকারের সময়ে কেস সামারি দিতে না -চাওয়া , বিল না -মেটালে দেহ আটকে রাখা , নোটবন্দির সময়েও চেক পেমেন্ট নিতে না -চাওয়া , প্যাকেজে এক রকম বলে অন্য রকম বিল করা , এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল নিয়েও সমস্যা তৈরি কেন করা হচ্ছে লাগাতার , সে সবের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে বলেন কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলির ৩৬টি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের কাছ থেকে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাপুটে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে কর্পোরেট কর্তাদের জবাব দিতে দেখা গিয়েছে হেডমাস্টারের সামনে ক্লাসে দোষ ধরা পড়ে যাওয়া ছাত্রদের ঢঙে৷ গোড়া থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল , তিনি প্রস্ত্ততি নিয়েই এসেছেন৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলির উদ্দেশে তিনি বলেন , ‘আপনারা তো যা -তা করে চলেছেন৷ ২০ % ইনকাম করুন না৷ তা বলে ১০০ % করবেন ! তা হলে তো জহ্লাদের কারখানা হয়ে যায়৷ বিজ্ঞাপনে বলবেন হার্ট সার্জারির প্যাকেজ দেড় লাখ টাকা আর তার পর পেশেন্ট খারাপ হয়ে গিয়েছে বলে আইসিইউ -তে ঢুকিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা বিল করবেন ! ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের নামে পেশেন্টকে তো আরও ক্রিটিক্যাল করে দেবেন দেখছি৷ এটা কি কল -কারখানা নাকি ? এটা কোনও সিস্টেম হল?’ তিনি জানান, এ সবই তাঁর নয়, সাধারণ মানুষের অভিযোগ৷ বৈঠকে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ পদস্থ আমলারা উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন৷

স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্লা জানান , কোনও হাসপাতালই চুক্তির তোয়াক্কা করে না৷ স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে সরাসরি অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেন, ১০ % ইন্ডোর বেড এবং ২০ % আউটডোর পরিষেবা যে গরিবদের জন্য দেওয়ার কথা, তা কি তারা দেয় ? জবাবে অ্যাপোলোর কর্তা জানান , নিয়ম অনুযায়ী যাঁদের বার্ষিক আয় ছ’ হাজার টাকার কম, তাঁদের বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়া হয়৷ চমকে উঠে মুখ্যমন্ত্রী তখন বলে ওঠেন, ‘এটা হয় নাকি? ভিখিরির বার্ষিক আয়ও তো ছ’হাজার টাকার বেশি৷ মান্ধাতা আমলের চুক্তি আর নিয়মকানুনের সুযোগ এ ভাবে আপনারা নেন !’

বেলভিউয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়, তাদের হাসপাতাল থেকে নার্সরা যে হারে সরকারি চাকরিতে চলে যাচ্ছেন, তা আটকাতে যেন সরকার বিধিনিষেধ চালু করে৷ মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ভত্র্‌সনার সুরেই বলে ওঠেন, ‘আপনারা তো প্রচুর আয় করেন৷ তা হলে নার্সদের বেতন বাড়ান না কেন? বেশি বেতন মেলে বলেই তো নার্সরা সরকারি চাকরিতে চলে আসে৷ তা ছাড়া কে কোথায় চাকরি করবে তা আইন দিয়ে আটকানো যায় না৷ সেই বিকল্পটা বাছা মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে৷’


মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

‘ডের স্পিগেল ’-এর প্রচ্ছদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই কার্টুন নিয়ে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া

‘ঘাতক’ ট্রাম্পের এক হাতে রক্তমাখা ছুরি, অন্য হাতে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র কাটামুন্ডু

 বার্তা সংস্থা

এক হাতে রক্তমাখা ছুরি, অন্য হাতে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির কাটামুন্ডু, যা থেকে টপটপ করে ঝরছে রক্ত৷ নীচে লেখা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’৷

জার্মানির জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ডের স্পিগেল ’-এর প্রচ্ছদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই কার্টুন নিয়ে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া৷ জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মার্কেল শরণার্থীদের জন্য যে ‘উন্মুক্ত দ্বার নীতি ’ নিয়েছিলেন , তার চড়ান্ত সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প৷ কিন্ত্ত সে কারণে ট্রাম্পকে এমন ঘাতক হিসেবে তুলে ধরা মানতে পারছেন না অনেকেই৷ আর তাই জার্মানিতেই উঠেছে সমালোচনার ঝড়৷


‘ডের স্পিগেল ’-এর প্রচ্ছদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই কার্টুন
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের জার্মান ভাইস -প্রেসিডেন্ট এই কার্টুনকে ‘নিম্নরুচি ’র পরিচায়ক বলে মনে করেন৷ এ দিকে যে শিল্পী এই ম্যাগাজিনের কভার পেজ ডিজাইন করেছেন, সেই এডেল রডরিগুয়েজের জন্ম কিউবায়৷ ১৯৮০ সালে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আমেরিকায় আসেন তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘এটা গণতন্ত্র, পবিত্র প্রতীকের মুণ্ডচ্ছেদ৷’ 

ম্যাগাজিনের সম্পাদকের কথায়, ‘ডের স্পিগেল কাউকে উস্কানি দিতে চায় না৷ আমরা শুধু বোঝাতে চেয়েছিলাম, এটা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের, বিচারবিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন৷ এই সবগুলোই এখন বিলুন্তপ্রায়৷ আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে রয়েছি৷’ কিন্তু জার্মানিরই একাধিক সংবাদপত্র এই কার্টুনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে৷ জার্মান ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড’ মনে করে, এই কার্টুনের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আদতে আইএস ঘাতক জিহাদি জনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে৷ সেই সঙ্গেই তারা জানিয়েছে, এর আগেও ‘ডের স্পিগেল’-এর আমেরিকার বিরোধী মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে৷ সংবাদপত্র ‘ডাই ওয়েল্ট’-এর মতে, এ ধরনের প্রচ্ছদ সাংবাদিকতারই ক্ষতি করে৷ এমনিতেই লোকের ধারণা, মূলধারার সংবাদমাধ্যম পক্ষপাতমূলক রিপোর্টিং করে৷ এ ধরনের প্রচ্ছদ সেই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করে দেয়৷ হোয়াইট হাউস অবশ্য আগেই অভিযোগ করেছে, একাধিক ‘উদারমনস্ক সংবাদমাধ্যম’ ট্রাম্পের কৃতিত্বকে খাটো করতে ভুলভাল রির্পোটিং করছে৷ এ দিন বার্লিনের আমেরিকা দূতাবাসের তরফে অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি৷

রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সংসদীয় ব্যবস্থার একান্ত অনুরাগী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

সৈকত রুশদী


পরিণত, সত্তরোর্ধ বয়সে চলে গেলেন রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যেকোন স্তরের মানুষের সাথে সহজভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত। এই গুণটির কারণে তিনি অসংখ্য মানুষকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন। এমনকী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের সাথেও তাঁর স্বাভাবিক কথা-বার্তার সম্পর্ক কখন ছিন্ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই।  আর সাংবাদিকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয় রকমের ঘনিষ্ঠ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়াও যে তিনটি কারণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে, স্থায়ী হয়ে থাকবে, তার দু'টি ইতিবাচক।  আর একটি নেতিবাচক।
প্রথমত: তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকারী সংসদের অন্যতম সদস্য।  ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের জোয়ারের মধ্যে তিনি মস্কোপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ন্যাপ (মোজাফফর)-এর প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ঐবছর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে যাঁরা জীবিত ছিলেন ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ (Constituent Assembly of Bangladesh) গঠন করা হয়।  সেই গণপরিষদের একজন বিরোধী দলীয় সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের নতুন সংবিধান পাশের পক্ষে ভোট দেন এবং সংবিধানের কপিতে স্বাক্ষর করেন।  এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
দ্বিতীয়ত: ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কয়টি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং যে কয়টিতে তিনি প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন, একটি বাদে তার সব ক'টিতেই তিনি বিজয়ী হয়ে মোট আটবার (১৯৭০, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, জুন ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪) জনপ্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর চেয়ে বেশিবার সংসদ সদস্য হওয়ার রেকর্ড বাংলাদেশে আর কারও নেই। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার সন্তান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বর্তমান দশম জাতীয় সংসদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
তৃতীয়ত: আওয়ামী লীগের তৃতীয় সরকারে রেল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে তাঁর বাসভবনে আসার সময়ে তাঁর একান্ত সহকারী গাড়িতে নগদ ৭০ লাখ টাকাসহ বিডিআর সদর দফতরে ধরা পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।  বিরোধী দলের দাবি এবং জনমতের চাপে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দফতর বিহীন মন্ত্রী হিসেবে রেখে দেন। এই ঘটনার অল্প কিছুদিন আগে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে দুর্নীতির 'কাল বিড়াল' তাড়াতে হবে ঘোষণা দিয়ে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন। আর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকেই 'কাল বিড়াল' নামে অভিহিত করা হয়।  আমৃত্যু সেই কলংকের বোঝা বয়ে চলতে হয় তাঁকে।
রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদের (১৯৮৬-১৯৮৮) সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালনের সময় কোন একদিন আওয়ামী লীগের এই সাংসদের সাথে আমার পরিচয় জাতীয় সংসদ ভবনের লবিতে।  সম্ভবত: মেহেরপুর-১-এর আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সহিউদ্দীন-এর সাথে লবিতে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি কাছে আসলে নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমি তাঁর সাথে আলাপ করি।  তখন আমি দৈনিক খবর-এর প্রতিবেদক।  নিরহংকারী, সৎ ও জনদরদী সহিউদ্দীন ছিলেন আমার ফুপুর স্বামী। তিনি আমার আত্মীয়তার পরিচয় দেননি।  তবুও আমার মতো একজন তরুণ সাংবাদিকের সাথে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিরহংকারী আচরণ আমাকে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতে উৎসাহ দিয়েছিল।  সংসদ অধিবেশন চলার সময়ে এবং অন্য সময়েও সংবাদের জন্য তাঁর সাথে যোগাযোগ রেখেছি।
সেসময়ে প্রস্তাবিত কোন বিল নিয়ে ব্যাখ্যা ও আলোচনার জন্য দৈনিক ইত্তেফাক-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শফিকুর রহমান (বর্তমানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি), জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত (তখন কোন পত্রিকায় ছিলেন আজ আর মনে নেই) ও আরও দু'একজনের সাথে আমি মাঝে মাঝে সেনগুপ্তের সাথে আলাপ করতে যেতাম। তিনি প্রাঞ্জল বাংলায় সহজবোধ্য সব ব্যাখ্যা দিতেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন নির্মোহ ভঙ্গীতে।  কোন দলীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়াই।  দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন আইনের প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে।  তাঁর এই ব্যাখ্যা ছিল সংসদীয় রীতি-নীতি এবং আইনের ভাল-মন্দ দু'টি দিকই বিশ্লেষণ শেখায় আগ্রহী তরুণ সাংবাদিক হিসেবে আমার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।  আমি বাংলাদেশ টাইমস-এ (১৯৮৭) যোগ দেওয়ার পরও তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ  অব্যাহত থাকে।  পরবর্তীকালে আমি বাংলাদেশে কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ও সবশেষে ব্রিটিশ হাই কমিশনে সব মিলিয়ে ১১ বছর রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কাজের সময়েও কোন আইন বা অধ্যাদেশ নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য যখনই যোগাযোগ করেছি, তিনি সাথে সাথেই সময় দিয়েছেন। কথা বলেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। দেখেছি সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুরাগ ও প্রচেষ্টা।
জনগণের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র সমুজ্জ্বল রাখা এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু রাখার লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি।  মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও অন্তত: এই একটি কারণে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন, তাঁর অপর সকল দোষগুণ ছাপিয়ে।
ভাল ও মন্দ মিলিয়েই মানুষ। আজ তাঁর জীবনাবসান হয়েছে।  তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।

টরন্টো,  ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

সৈকত রুশদী: কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক