মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

Mercantile Bank chairman, NRBC collude in huge loan, share scams, BB finds Shahidul Ahsan holds NRBC shares in ‘fake names’, gets Tk 301cr loan

Mercantile Bank chairman Shahidul Ahsan

AKM Zamir Uddin

Mercantile Bank chairman Shahidul Ahsan and NRB Commercial Bank colluded in huge irregularities like loan scam and illegal shareholding in ‘fake names’, according to a Bangladesh Bank investigation.
NRB Commercial Bank sanctioned Tk 301 crore to Ahsan violating the rules and regulations.
NRBC Bank violated the single borrower exposure limit to sanction the loans in favour of Ahsan’s business organisations as it approved 56 per cent credit limit amounting to Tk 301 crore against its capital of Tk 540 crore.
According to the bank company act, the outstanding amount of loan to a single person, counterparty or a group will not exceed 35 per cent of the capital of a bank at any point of time.
The central bank findings came from separate three inspections at Principal Branch and Uttara Branch in the capital Dhaka, and Chandraganj Branch in Noakhali of NRBC Bank. The central bank conducted the inspections in the last week of November.
Besides, NRBC Bank did not take adequate collateral securities from Ahsan against its sanctioned and disbursed loans, the BB investigation report said.
It said Ahsan also ‘illegally gripped’ NRBC Bank’s shares of its two sponsor directors — Kamrun Nahar Sakhi and ABM Abdul Mannan. The two directors hold shares of the bank worth Tk 43.71 crore.

Sakhi and Mannan have been staying abroad since 2009, but Ahsan opened ‘fake’ accounts with Gulshan Branch of Mercantile Bank in the names of the two persons.
Ahsan transferred huge amount of cash dividend against the shares of the two persons to his business group AG Agro Industries Ltd’s account in 2014 and 2015 violating the rules.
The BB report said that Ahsan was the real owner of the shares of Sakhi and Mannan and it was a punishable offence in line with the bank company act and the shares should be confiscated.
The NRBC Bank ‘illegally duplicated’ the signatures of Sakhi and Mannan and showed them as attendees of the board meetings so that they could play role in sanctioning loans in favour of Ahsan.
AKM Shafiqul Islam and Syed Golam Farouque were nominated as alternative directors of Sakhi and Mannan at the board of directors of the bank.
Shafiqul and Farouque are also directors and consultants of Ahsan Group owned by the Mercantile Bank chairman.


Mercantile Bank Chairman Shahidul Ahsan along Managing Director and CEO Kazi Masihur Rahman congratulating Deputy Governor of Bangladesh Bank SM Moniruzzaman with a bouquet of flowers for being promoted.
The board of NRBC Bank sanctioned Tk 119 crore on June 6, 2015 to Ahsan in presence of Shafiqul and Farouque.
Moreover, Ahsan attended the bank’s annual general meeting on April 18, 2016 as a proxy man of Sakhi.
According to the BB report, AG Agro Industries opened a current account with the Principal Branch of NRBC Bank on April 18, 2013.
The board of the bank sanctioned a credit limit of Tk 140 crore to the Ahsan’s business organisation on May 8, 2013 with mortgaging a land worth only Tk 3.91 crore.
The central bank asked the bank in December 2013 to decrease the credit limit considering the inadequate collateral securities.
The bank informed the BB that it decreased the limit to Tk 118 crore and Ahsan’s credit outstanding stood at Tk 20.88 crore on December 23, 2013.
But, the bank increased the Ahsan’s credit limit again to Tk 183 crore on May 3, 2016 violating the central bank’s directive when his overall credit limit stood at Tk 995.77 crore from other banks on the day.
The NRBC Bank’s document showed that it had taken collateral securities of Tk 60 crore, but the real mortgage amount was Tk 3.91 crore considering the value of the land.
Chandraganj Branch of NRBC Bank also sanctioned a credit limit of Tk 118 crore in favour of Begumganj Feed Mills Ltd owned by Ahsan resulting that the single borrower exposure limit crossed 56 per cent of the bank’s capital.
Violating the single borrower exposure limit was a punishable offence in line with the bank company act.
The disbursed loan to Ahsan apparently showed as regular but he repaid the instalments of the loans from other branches of the NRBC Bank.
Uttara Branch of NRBC Bank disbursed loans to one family of Aziz Chowdhury with his sons Salahuddin Chowdhury and Tareq Chowdhury, but a significant amount of the loans was transferred to the account of AG Agro Industries.
The same family took loans against its business organisation Stylish Garments and a remarkable amount of the loans was transferred to the account of AG Agro Industries.
The BB report suspected that Ahsan might keep his credit accounts as non-defaulted situation by creating loan accounts anonymously.
A BB official told New Age on Sunday that the central bank was now thinking to take actions against Ahsan as he controlled the NRBC Bank’s board behind the scene.
Ahsan declined to make any comment regarding the allegation although New Age made four attempts over the last one week.
When communicated with NRBC Bank’s management to take opinion about the fraudulent act, Ruhul Amin, head of public relation department of the bank, told New Age on Tuesday that the bank’s managing director Dewan Mujibur Rahman would not make any comment in this regard.
BB executive director and spokesperson Subhankar Saha told New Age that the central bank was still investigating the issue in details. So it would not be logical to make any comment under the circumstances, he added.

Courtesy: New Age Dec 25,2016

রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল ভারতে ব্রাত্য কেন

 অমিত গোস্বামী


গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষদিক। তখন টেলিভিশন দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বাড়িতে ছাদের ওপরে অ্যালমুনিয়ামের দুটি অ্যান্টেনা শোভা পেত। একটি ভারতের সরকারি চ্যানেলের জন্য। অন্যটি বিটিভি অর্থাৎ বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য। তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাকের ভাই অর্থাৎ বর্তমান সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ভারতের দূরদর্শন তখন দুয়োরানি। বিটিভির বিজ্ঞাপনের জোরে বাজারে বিকোচ্ছে বাংলাদেশি সাবান, গুঁড়োদুধ, কনডেন্সড মিল্ক, পেস্ট। চোরাইপথে আসছে সব। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিটিভির প্রচারে তখন রীতিমতো হিরো। বাংলাদেশের টিভি নাটকের জনপ্রিয়তায় ঢাকা পড়ে গেছে কলকাতায় তৈরি বাংলা সিনেমা। উপায় না দেখে কলকাতা দূরদর্শন শনিবারে চালিয়ে যাচ্ছে উত্তম, সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সৌমিত্র। তা সত্ত্বেও বোকাবাক্স শাসন করে যাচ্ছে পদ্মাপারের রাজ্জাক, ববিতা। এ এক অদ্ভুত বাংলাদেশি রাজত্ব বিরাজ করছে টেলিভিশনে। তীব্র আকর্ষণে সন্ধ্যা হলেই খুলছে টিভি নামক চৌখুপি বাক্স আর বাজছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’

অমিত গোস্বামী
কিন্তু ১৯৯০ সালে ভারতের বাজারে এলো ক্যাবল চ্যানেল মাত্র চারটে প্রাইভেট চ্যানেল নিয়ে। তার একটি বিবিসি নিউজ। সেই সময় থেকে বিটিভির পিছু হটা শুরু। আরেকটা ফ্যাক্টর অবশ্যই কাজ করেছিল। স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে তীব্র হতেই পেশাদারিত্বের উৎকর্ষ ছেড়ে বিটিভি হয়ে গেল কর্তাভজা লাউড স্পিকার। মুখ ফেরাতে শুরু করল ভারতীয় বাঙালি দর্শক। মুছে গেল বাংলাদেশ আমাদের টেলিভিশন সেট থেকে। বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লড়তে শুরু করল ভারতীয় চ্যানেলগুলো। তখন বিদেশি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার হতো সিঙ্গাপুর বা হংকং থেকে। কিছু প্রযুক্তিগত সুবিধা পাওয়ার কারণে। ভারতীয় চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতার চাপে সেই প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়ার জন্য নিজেদের অফিস করে নিল সিঙ্গাপুরে। অর্থাৎ দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেল ভারতীয় চ্যানেলগুলো এবং জনপ্রিয়তার হিসেবে পেছনে ফেলে দিল বিদেশি চ্যানেলদের। কিন্তু তখন কোথায় বাংলাদেশের টেলিভিশন শিল্প? তারা এই আকাশলড়াই থেকে নিজেদের দূরে রেখে মন দিল ভারতীয় চ্যানেলের অনুকরণে। কিন্তু দুধ যদি পাওয়া যায় মানুষ ঘোল খাবে কেন? বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে সুযোগ পেতেই বাংলাদেশের টিভি বাজারের দখল নিল ভারতের চ্যানেলগুলো। আজ বাস্তব এই যে, বাংলাদেশে ভারতের কমপক্ষে ৪২টি টিভি চ্যানেল দেখানো হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা অবশিষ্ট ভারতে বাংলাদেশের প্রায় ৩০টি চ্যানেলের মধ্যে অনিয়মিতভাবে দু-একটি দেখা যায়। প্রশ্ন ওঠে, এই পরিস্থিতি কেন? সম্প্রতি একটি জরিপের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে টেলিভিশন দেখেন এমন নারীদের ৬৬ শতাংশের বেশি অধিকাংশ সময় ভারতীয় টিভি চ্যানেল দেখেন। চ্যানেলগুলোর শীর্ষে রয়েছে স্টার জলসা। বাংলাদেশের ৫৮ শতাংশ নারী দর্শক নিয়মিত এই চ্যানেলটি দেখেন।’ জরিপটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ।


সিনেমা, টেলিভিশন বা বিনোদন জগতে আদর্শ খুব বেশি একটা কাজ করে না। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন চ্যানেল আপনার হাতের মুঠোয়। আপনি আপনার রিমোট কন্ট্রোল চাপতে থাকুন। বাংলাদেশে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া প্রভৃতি দেশের ভালো ভালো চ্যানেল দেখতে পাবেন। তাই ইন্ডিয়ার ওই চ্যানেলটি দেখব না, এসব কথা বলে এখন আর পার পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের অনেকের ধারণা, যেখানে আজ ভারত সারা বিশ্বের দর্শকদের তাদের চলচ্চিত্র, হিন্দি সিরিয়াল, নাটক, গান, নাচ দিয়ে মাতিয়ে তুলছে সেখানে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হয়তো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে তাদের দেশে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না। কিন্তু ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশে ভারতের টিভি চ্যানেলের প্রচার নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন বা আবেদন করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার না হওয়ার পেছনে আসল কারণটা কী?

ভারতে বিদেশি টিভি চ্যানেল দেখাতে হলে কিছু নিয়মনীতি পালন করতে হয়। সম্প্রতি ভারতীয় হাইকমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতে দেখানোর ক্ষেত্রে ভারত সরকারের কোনো আইনি বাধা নেই। ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে যে কেউ ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংক করতে পারবে।’

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ভারতীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও ভারতে কোনো বাংলাদেশি চ্যানেল ডাউনলিংকের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। কোনো কোম্পানি যদি বাংলাদেশি চ্যানেল ডাউনলিংক করতে চায়, তা হলে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নীতিমালা অনুযায়ী সর্বতোভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ভারতে ডাউনলিংকের জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেনি।’

তবে আবেদনকারী কোম্পানিকে প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় টাকা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিটি অতিরিক্ত চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ভারতীয় টাকা নেট মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই মূল্য ছাড়াও ডাউনলিংকের অনুমতি মঞ্জুরের সময় ১০ লাখ ভারতীয় টাকা ফি দিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আপলিংক করা প্রতিটি চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য বার্ষিক ফি হিসেবে ১৫ লাখ ভারতীয় টাকা দিতে হবে। ডাউনলিংকের নিবন্ধন ও অনুমতি ১০ বছর বহাল থাকবে। এটা করতে পারলে মাল্টি সিস্টেম অপারেটররাও (এমএসও) সেই চ্যানেল বিপণনের ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু বিদেশি টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ডাউনলিংক ফি বেশি হওয়ায় ভারতীয় ক্যাবল অপারেটররা আগ্রহ প্রকাশ করছেন না।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেল চালাতে আগ্রহী এখানকার চ্যানেল বিপণনকারী সংস্থাগুলো। কলকাতাসহ রাজ্যের বাঙালি দর্শকদের মধ্যে বাংলাদেশি চ্যানেল প্রদর্শনের জন্য নিয়মিত দর্শকদের কাছ থেকে চাপ সহ্য করতে হচ্ছে বিপণনকারীদের। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল আইনগতভাবে ভারতে ডাউনলিংকের অনুমোদন নিয়ে না আসায় দর্শকদের কাছে বাংলাদেশের চ্যানেল পৌঁছে দিতে পারছে না বিপণনকারী সংস্থাগুলো। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি চ্যানেলের মালিক আমাকে একান্ত আড্ডায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মাত্র ২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের বাজারে দেশীয় চ্যানেলগুলো চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর যদি ভারতে সম্প্রচারের জন্য বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয় তাহলে বিপদে পড়তে হবে।’

এতক্ষণে আসল সমস্যা বোঝা গেল। প্রথম ডাউনলিংকের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় টাকা, সঙ্গে ডাউনলিংকের অনুমতি মঞ্জুরের সময় ১০ লাখ ভারতীয় টাকা এবং ডাউনলিংকের জন্য বার্ষিক ফি হিসেবে ১৫ লাখ ভারতীয় টাকা প্রতি চ্যানেলকে দিতে হবে। এখানে একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার। ইংরেজি বা হিন্দি চ্যানেলের প্রসার সর্বভারতীয়। কিন্তু বাংলা চ্যানেলের প্রচার শুধু বাংলাভাষীদের মধ্যে। কাজেই সারা ভারতে প্রচারিত বিদেশি চ্যানেলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর একই রকম অর্থ জমা দেওয়ার ফরমানে তাদের ইচ্ছা বা উৎসাহ আজ অবধি তৈরি হয়নি।

তাহলে বাংলাদেশে যে ভারতীয় চ্যানেলগুলো প্রচারিত হচ্ছে সে জন্য তাদের বাংলাদেশ সরকারকে কী দিতে হচ্ছে? ক্যাবল নেটওয়ার্ক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা কোয়াবসূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতের প্রায় অর্ধশত চ্যানেল প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা খুবই কম অর্থ দিচ্ছে। ভারতীয় চ্যানেল মাত্র তিন লাখ টাকার টোকেন মানি দিয়ে বাংলাদেশে চালু করা যায়। আরও একটা কথা, বেশিরভাগ ভারতীয় চ্যানেল ‘ফ্রি টু এয়ার’ (বিনামূল্যের) হওয়ায় সব চ্যানেল সম্প্রচার করা অত্যন্ত সুবিধাজনক।

বুঝলাম। কিন্তু এ তো অন্যায়। কোথায় ৫ কোটিরও বেশি আর কোথায় ৩ লাখ! ক্যাবল অপারেটররা ব্যবসায়ী। তারা তাদের সুবিধা দেখবেন। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান একমাত্র করতে পারেন দুই দেশের সরকার। কিন্তু তার আগে জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশে স্বাধীনতা প্রায় ৪৪ বছর পর প্রথম বাস্তবসম্মত সম্প্রচার নীতিমালা এতদিনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখনো সম্প্রচার আইন তৈরি হয়নি। কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের গত সফরের সময় এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু হয়নি। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। কারণ তিস্তার স্রোত বাংলাদেশের জন্য যতটা জরুরি, বাংলাদেশের চ্যানেল তেমনই ভারতে আসা জরুরি। না হলে যেটা হবে সেটা হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরেÑ সেটা আর হবে না।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অনেক কাজ করছে, যা বাস্তবোচিত ও ভবিষ্যতের জন্য ভালো ফল আনতে বাধ্য। কাজেই তাদের কাছে এই প্রত্যাশা করা যেতেই পারে, এই সমস্যা সমাধানে তারা উদ্যোগী হবে। কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর পশ্চিমবঙ্গে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? ভারতের অন্যতম বৃহত্তম চ্যানেল বিপণনকারী সংস্থা মন্থনের পরিচালক শিবশঙ্কর চক্রবর্তীর মতে, বাংলাদেশে যেহেতু অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গবাসীর পূর্বপুরুষের ভিটা এবং একই সংস্কৃতি, ভাষা এবং খাদ্যাভ্যাসের ফলে এখানে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো সম্প্রচারে আসলে দর্শকদের যেমন বাংলাদেশি চ্যানেল দেখার সুযোগ হবে, তেমনই চ্যানেলগুলোও ব্যবসা করতে পারবে। জিটিপিএল নামে আর একটি বৃহত্তম চ্যানেল বিপণনকারী সংস্থার পরিচালক সুষেন বলেন, ‘প্রতিদিন কয়েকশ ফোন আসে। সবারই দাবি, অন্য বিদেশি চ্যানেল দেখা গেলে কেন বাংলাদেশের খবর-নাটক-ছবি কোনো চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে না। এর জবাব আসলে আমরা দিতে পারি না।’ ভারতের জি-গ্রুপের বিপণনকারী সংস্থার সিটি ক্যাবলের পরিচালক সুরেশ শেঠিয়া মনে করেন, যেহেতু বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল এখানে দেখানো হয় না তাই যারাই আগে এ উদ্যোগ নিয়ে আসবে তারা অবশ্যই ব্যবসা করতে পারবে।

বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ভারতে এলে আরেকটি লাভ হবে। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। বাংলাদেশের কোম্পানি প্রাণ গ্রুপ কলকাতার নাগেরবাজারের কাছে একটি অফিস নিয়ে ভারতের ব্যবসা জগতে তাদের উপস্থিতির ক্ষীণ স্বাক্ষর রেখেছেন। তারা জি বাংলাসহ আরও দু‘একটি টিভির খুব জনপ্রিয় কয়েকটি অনুষ্ঠানের মূল স্পন্সর। কোটি কোটি টাকা ঢেলেছেন, অবশ্যই ভারতীয় কোম্পানি হিসেবে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে যাতে তাদের প্রডাক্টের ব্যাপক প্রচার হয়। হয়েছেও। তার সঙ্গে উপরি লাভ হয়েছে এই যে, প্রাণ গ্রুপের প্রডাক্টের জনপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গে এতটাই বেড়ে গেছে যে, তাদের সেই দাবি মেটানোর ক্ষমতা নেই। একইভাবে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর আগমনে বেশ কিছু ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা শুরু করবে। এই যে পারস্পরিক ব্যবসায়িক পরিযান, এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বলবান করে তুলবে।

ভারতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘এটা অনুচিত। মানা যায় না। আমরা তো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখতে পাই, তবে বাধা কেন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের ওপর?’

কবি শঙ্খ ঘোষ বললেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু। পাকিস্তানি চ্যানেল দেখা যায়, অথচ বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে পারি না। এটা কী করে হয়!’

অর্থাৎ এ দেশের সুশীল সমাজ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তবে আরেকটি কথা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ খেয়ে নেয় বিজ্ঞাপন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেন ও ভারতে এই বিজ্ঞাপনের ভাগ ১১ শতাংশ। কাজেই বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোকেও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে গেলে সাবালক হতেই হবে। কিন্তু শেষ অবধি বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করা হয় সেটাই দেখার বিষয়। না হলে বাংলা সংস্কৃতি যে অবাঙালি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হবে তা বলাই বাহুল্য।

অমিত গোস্বামী: ভারতীয় কবি ও সম্পাদক

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

তৃণমূলের সঙ্গে সখ্য চায় শেখ হাসিনার সরকার

কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রদর্শনীতে মমতা । ডানে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু

এই সময়, কলকাতা 

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সঙ্গেও সম্পর্ক মজবুত করতে চায় শেখ হাসিনার সরকার৷ তিস্তা জলবণ্টন এবং পশ্চিমবঙ্গের মাটিকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদীরা যাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যকলাপ চালাতে না-পারে, তার জন্য মমতার সঙ্গেও আলাদা ভাবে কথা বলবে আওয়ামি লিগ সরকার৷

বৃহস্পতিবার পূর্বাঞ্চলীয় সেনা সদর দন্তর ফোর্ট উইলিয়ামে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে এ কথা জানান বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান৷ তবে বিকেলে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিজয় উৎসবে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা জলচুক্তির উল্লেখ করেননি৷ ছিটমহল আদানপ্রদান নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ভূমিচুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য৷ আবার আমার বাংলার সরকারেরও সাফল্য৷ যার ফলে স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরে এখানকার ছিটমহলের বাসিন্দাদের স্বাধীনতা উপহার দিতে পেরেছি৷’

জঙ্গি কার্যকলাপের প্রসঙ্গ উল্লেখ না -করে মমতা শুধু বলেন, ‘এমন কিছু আমরা করতে দেব না বা করব না, যাতে কেউ হস্তক্ষেপ করে আমাদের চিন্তিত করতে পারে বা দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে পারে৷ দু’দেশের মধ্যে সুসর্ম্পক ছিল, থাকবে৷ ভৌগোলিক সীমানা যা-ই থাকুক, আমাদের মানবিকতা, ভালোবাসার কোনও সীমানা নেই৷’

বাংলাদেশ হাইকমিশনের এই অনুষ্ঠানে সে দেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার জকি আহাদ উপস্থিত ছিলেন৷

কলকাতা সফরের ফাঁকে আসাদুজ্জমান মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন, এমন খবর চাউর হয়েছিল৷ কিন্তু দমদম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে আসাদুজ্জমান জানান, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই তিনি কলকাতায় এসেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কোনও কর্মসূচি নেই৷

বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারত যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তার কথা আমরা ভুলব না৷ আজ বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক এবং আধুনিক রাষ্ট্র৷ খাদ্যঘাটতি মিটিয়ে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দিকে এগোচ্ছি৷ কৃষি, স্বাস্থ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে৷ সেই কাজে ভারত সাহায্য করে চলেছে৷’

বাংলাদেশের আরও এক মুক্তিযোদ্ধা তথা আওয়ামি লিগের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন খসরু বলেন, ‘যখন বিদেশে যাই লোকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? যখন তাঁদের বলি, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তখন তাঁদের অনেকেই আমাকে ইন্ডিয়ার লোক বলে সম্বোধন করেন৷ বলে, আপনি গান্ধীর দেশের লোক৷’

পাকিস্তানকে কাঠগড়ায় তুলে তিনি বলেন, ‘পঞ্চাশ বছর ভারতের সঙ্গে শত্রুতা কী লাভ হল পাকিস্তানের?’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল মহম্মদ নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘পৃথিবীতে খুব কম দেশ আছে, যারা অন্যের জন্য আত্মবলিদান দিয়েছে৷ ভারত সেরকম একটি দেশ৷ ভারতের বর্তমান শাসকরাও বাংলাদেশকে নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷’

মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬

জয়ললিতার উত্থান শুধু সিনে-রাজনীতির দরুণ?

আত্মপরিচয়ের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাই একদা দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিকে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল


বৈদূর্য চক্রবর্তী

তামিলনাড়ুরলৌহ প্রজাপতি’, জয়রাম জয়ললিতা (১৯৪৮-২০১৬) চলে গেলেন; তাঁর আজীবন শত্রু করুণানিধিও অশীতিপর অসুস্থ৷ অনেকেই মনশ্চক্ষে দেখছেন ডিএমকে-এআইডিএমকের তামিল রাজনীতিতে দ্বৈত শাসন শেষ হয়ে এল বলে; অনেকেই বলছেন এক যুগের অবসান৷ কিন্তু যুগ কোন যুগ? জনমানসে এই যুগ মনে করায় দক্ষিণি রাজনীতির হিন্দি-বিরোধিতা, জনপ্রিয় সিনেমার পুরুষ তারকাদের রাজনীতিতে বিরাট, প্রায় একচ্ছত্র প্রভাব, এবং বিভিন্ন জনমোহিনী ওয়েলফেয়ার স্কিমের কথা৷  

বাঙালি--- যারা আজও দাক্ষিণাত্য বলতেমাদ্রাজিবোঝে--- অপরিসীম তাচ্ছিল্যের সাথে এতকাল দেখে এসেছে দক্ষিণি রাজ্যগুলির রাজনীতিতে চিত্রতারকাদের প্রাদুর্ভাব, তাদেরএক টাকায় চালযোজনা, ইত্যাদি; সেই বোম্বাগড়ের দেশে লোকে না কি ঈশ্বরের নামভূমিকায় নামা চিত্রতারকাদের খোদ ভগবানের সাথে গোলায় বলেই এই সব তারকাদের রাজ্যের মসনদে বসায়! আমরা অবশ্য খুব সক্ষম ভাবে ভুলে যাই যে এই বোম্বাগড়ের দেশগুলি সব পরিসংখ্যান বিচারেই গোবলয় বা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে, এবং তামিলনাড়ুর চেয়ে কার্যকরী সমাজকল্যাণ যোজনা ভূভারতে মেলা দুষ্কর৷ সুতরাং আত্মম্ভরিতার বাইরে বেরিয়ে যদি আমরা তামিল, বা দক্ষিণি, রাজনীতিকে দেখি তা হলে সবার আগে বুঝে নিতে হবে:
 ) সিনেমার সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগ কোনও বালখিল্যের খামখেয়ালি নয়, বরং ভারতীয় রিপাবলিকের এক গভীর অসুখের ফল ;  
) দক্ষিণি রাজনীতি জনপ্রিয় সিনেমার কিমিতি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল
 ) এই কিমিতির মূলে কোনও ঈশ্বরবিশ্বাস নয়, বরং আঞ্চলিকতার প্রশ্নটি লুকিয়ে আছে ; এবং 
 ) যদিও বর্তমান দক্ষিণি রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রস্থানমূল সিনেমা রাজনীতির কিমিতি, তাঁর বর্তমান ভবিষ্যত সেই প্রস্থানমূল ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছে৷
জয়ললিতা নিজেকে যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গেআম্মাতে রূপান্তরিত করেন, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর স্থায়িত্বের চাবিকাঠি৷
আধুনিক ভারতবর্ষেজাতিসত্তাবস্তুটি ভারি কিম্ভূত৷ যা তোমার সত্যই জাতি--- সে ভাষা বিচারেই হোক বা ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক বিচারেই হোক--- তাজাতীয়তো নয়ই বরং তুচ্ছআঞ্চলিক শুধুমাত্র একটি ভাষার সমান অংশীদার হওয়ার দাবি দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়৷ যা সত্যই আপন তাকেআঞ্চলিকমেনে নিয়ে একটি হিন্দু-সভ্যতা-কেন্দ্রিক, আধা-কাল্পনিক ইতিহাসে নিজেদের ভাগীদার ভেবে নিতে না পারলেযথার্থভারতীয় হয়ে ওঠা যায় না৷ এই সাড়ে বত্রিশ ভাজা জাতীয়তাবাদের চরিত্রটি যথার্থ অনুধাবন না করলে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি--- বিশেষত দক্ষিণ ভারতের রাজনীতির আঞ্চলিক দলগুলির ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের ভূমিকা --- বোঝা অসম্ভব৷  

আমাদের জাতীয়তাবাদেআঞ্চলিকসত্তা --- যা আদতে যথার্থে জাতীয় সত্তা ---চিরায়ত অবদমিত হওয়ার ফলে, ফ্রয়েডিয় ভাষায়অবদমিতের প্রত্যাবর্তন’-এর রূপও ভিন্ন হতে বাধ্য৷ স্বাধীনতার ঠিক আগে পরে, হিন্দি ভাষা হিন্দু-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের উল্লম্ফিত জয়গানের মুহূর্তে, মূকআঞ্চলিকমানুষ যে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের কাউকে-চেনোনা-তুমি-তোমাকে-চেনেনা-কেউ সুরক্ষায় সাদা পর্দার সব-পেয়েছির-দেশে নিজেদের আত্মপরিচয়ের স্বপ্ন দেখবে, সে কথা বুঝে নেওয়া কি সত্যই কঠিন? তামিলনাড়ুর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আঞ্চলিক পার্থক্য (দ্রাবিড়িয় রাজনীতি) জাতিভেদবিরোধী চিন্তা (ব্রাহ্মণ-বিরোধী রাজনীতি) স্বাধীনতা-প্রান্তির বেশ কিছুটা আগে থেকেই প্রধান হয়ে উঠেছিল, প্রধানত ভি রামস্বামী নাইকার, বা পেরিয়ার, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দ্রাবিড় কাড়াগমের (ডিকে) দৌলতে৷ কিন্তু পেরিয়ারের মুক্ত-চিন্তা-কেন্দ্রিক, নাস্তিক, জাতপাত-বিরোধী, যুক্তিবাদী, নারীবাদী রাজনীতি থেকে অনেকটা আপসের রাস্তায় সরে এসে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাড়াগম, বা ডিএমকে৷  


ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক আধুনিকতার বহু পুরাতন দুর্বলতা অন্নদায়িনী মাজয়ললিতা সেই দৌর্বল্যে ভর করেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সমার্থক হয়ে ওঠেন আম্মা ক্যান্টিন, ফার্মেসিফ্যানের দৌলতে পৌঁছে যান তামিলনাড়ুর ঘরে ঘরে৷


ডিএমকের নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই চলচ্চিত্রের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন; আন্নাদুরাই তাঁর উত্তরসূরি করুণানিধি অসংখ্য সফল ছবির চিত্রনাট্যকার তো বটেই, ডিএমকের অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত গীতিকার কন্নাদাসন মঞ্চাভিনেতা ভি নেদুঞ্চেড়িয়ান৷ পেরিয়ারের বৈপ্লবিক চিন্তাকে আমরা এক ভাবে বাবাসাহেব আম্বেদকরের দলিত রাজনীতির সমান্তরাল হিসেবে দেখতে পারি; সেই প্রস্থান থেকে সরে এসে এক ধরনের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দিল ডিএমকে উত্থান৷ এই উত্থানে সঙ্গ দিয়েছিল সিনেমা নামের সেই জনমাধ্যমটি, যা একটি প্রায়-নিরক্ষর দেশে সর্বগ্রাহ্য হয়েও মধ্যবিত্ত উন্নাসিকতার দাপটে দুয়োরানি হয়ে রইলো চিরদিন৷ এখানে আঞ্চলিকতা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সমান্তরালটি প্রণিধানযোগ্য: দুইই একই সাথেপপুলারএবং সেই কারণেই ঘোর সন্দেহের বস্তু! কিন্তু যে ভঙ্গিমাতে ডিএমকের নেতৃবৃন্দ সে দিন দ্রাবিড়িয় জনপ্রিয় রাজনীতিকে গড়ে তুলেছিলেন জনপ্রিয় সিনেমার মাধ্যমে, তার পিছনে প্রচ্ছন্ন আছে যাঁর জীবন কর্ম, তিনি স্বয়ং এম কে গান্ধী৷ যেভক্তিকে হাতিয়ার করে গান্ধী রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রায়-ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন, যে ভক্তি- ভাষা হয়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনগণের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র মাধ্যম, সেইভক্তি মাধ্যমেই তামিল জনপ্রিয় সিনেমা রাজনীতির মধ্যে একটি দৃঢ় সেতু গড়ে ওঠে; কথা প্রেমিন্ডা জেকব তাঁরসেলুলয়েড ডেইটিসবইটিতে (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান ২০১০) বিশদে প্রতিভাত করেছেন৷  

ক্ষেত্রে আবার প্রশ্ন তোলা যাক : যারা দক্ষিণি রাজনীতিতে চিত্রতারকাদের প্রাদুর্ভাব নিয়ে এত চিন্তিত, কেন তাঁরা গান্ধীবাদের ভক্তি-ভিত্তিক ব্যক্তিপূজা নিয়ে একই শঙ্কা প্রকাশ করেন না? দুই অনাকাঙ্ক্ষিত দুয়োরানির ---আঞ্চলিকতা জনপ্রিয় সিনেমা --- মেলবন্ধনের ফলেই কি এমন গেল-গেল রব? গণতন্ত্রের মূলে রয়েছে যে সার্বভৌমত্বের গল্প --- অর্থাৎ যেআমরা-সবাই-রাজা-আমাদের-এই -রাজার -রাজত্বেবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে আমরা একটি সার্বভৌম দেশের নাগরিক হতে রাজি হই --- তা একই ভাষার সমান শরিক না হলে যে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, সে কথা মাধব প্রসাদ আমাদের শিখিয়েছেন৷ সেই রকমই একটি মুহূর্তে, যখন দেশের মানুষের উপর হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল তুঙ্গে, তখন সিনেমার মাধ্যমে তামিল জনসাধারণ খুঁজে নেন তাদের মনোমত অধীশ্বর কিছু, যাদের পর্দার পর্দার বাইরের রাজনীতির মধ্যে তাঁরা নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে নিয়েছিলেন৷ একে মাধব প্রসাদ তাঁরসিনে-পলিটিক্সগ্রন্থেফ্যান ভক্তিবলে অভিহিত করেছেন, যার মাধ্যমে পিলসুজের তলার অন্ধকারও খুঁজে নেয় সার্বভৌমত্বের মানে৷ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ ক্ষেত্রে প্রধানত আপসমূলক, যার মাধ্যমে ভারত-নামক গণরাজ্যটির থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না হয়ে গিয়েও একটি উপ-জাতি উপ-জাতীয়তাবাদ হিসেবে টিকে থাকা যায়৷ এই উপ-জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করেই ক্রমে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা-উত্তর তামিলনাড়ু, অন্যান্য আরও অনেক রাজ্যের, রাজনীতি৷ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র ছিল সার্বভৌমত্বের একটি বিকল্প ক্ষেত্র, যেখানে কল্পিত বয়ানে জাতিত্বের সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব৷ কিন্তু সেই উপজাতিত্বের দীর্ঘ আয়ু, তাঁর সঙ্গে ভারতরাষ্ট্রের সম্বন্ধ, এবং সেই রাজনীতির সামন্ততান্ত্রিক চেহারা --- সবই ভারতীয় রাজনীতির মূল চরিত্রের সাথে যুক্ত; তার দোষ সিনেমার উপর শুধু বর্তায় না৷  
অচিরেই দ্রাবিড়িয় জাতীয়তাবাদ তামিল জনপ্রিয় সিনেমার এমনই একচ্ছত্র অধীশ্বর হয়ে ওঠেন এমজি রামচন্দ্রন, যাকে মানুষ চিনল এমজিআর নামে৷ করুণানিধি জমানার ভ্রষ্টাচারের বিরোধিতা করে ১৯৭২ সালে তৈরি করলেন সেই দল, যা আজ এআইএডিএমকে নামে পরিচিত৷ ডিএমকে- রাজনীতি ক্রমে চেহারা নিল দ্রাবিড়ত্বের কুলীন প্রতিনিধির; অন্যত্র এমজিআর ভরসা হলেন পপুলিজম- বিশ্বাস রাখা জনসাধারণের৷ এখানে মনে রাখা দরকার যে জরুরি অবস্থার পরবর্তীকালে এআইএডিএমকে ক্রমেই দিল্লি-বান্ধব হয়ে ওঠে; ডিএমকে- তামিল ইলমের দাবির শত যোজন দূরে থেকে তারা তামিল (উপ-)জাতির উপর ভারতরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ আধিপত্য মেনে নেয়৷ রামচন্দ্রন পরবর্তী জয়ললিতার শাসনপদ্ধতিতে যে স্বৈরাচারের প্রচ্ছন্ন ছায়া, তার পূর্বসূরি ইন্দিরা গান্ধী; সেই একইঅত্যাচারমূলক প্রগতি ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি আশি শতাংশ ভারতবাসীর পকেট মেরেছেন৷

কিন্তু এই পপুলিজম সিনে-রাজনীতির দুনিয়াতেও জয়ললিতার উত্থান বুঝে ওঠা সহজ কাজ নয়৷ ১৯৮৭ সালে এমজিআর -এর মৃত্যুর পরে তিনি অভাবনীয় ভাবে দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার রাশ কেড়ে নেন এমজিআর-এর স্ত্রী প্রাক্তন অভিনেত্রী ভি এন জানকীর থেকে; যদিও কথা অনস্বীকার্য যে রামচন্দ্রন নিজে তাঁকে এই নেত্রী ভূমিকার জন্য তৈরি করে গিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত জয়ললিতা রামচন্দ্রনের ছায়া থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসে নিজেকে যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গেআম্মাতে রূপান্তরিত করেন, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তামিল রাজনীতিতে তাঁর স্থায়িত্বের চাবিকাঠি৷ জনপ্রিয় সিনেমার যৌনতা -ভিত্তিক যে আপৃষ্ঠ বন্ধনে অভিনেত্রীরা বন্দি থাকেন, তাঁর মধ্যে বন্ধ থাকলে এমজিআর-এরপ্রিয় অভিনেত্রী বেশি জয়ললিতার আর কিছু হয়ে ওঠা হতো না৷ তাই জয়ললিতা পরে নেন এক বিশাল আলখাল্লা, যা তাঁর শরীরকে প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়; জয়ললিতা পরিণত হন অযৌনআম্মায়৷ সিনেমার প্রচ্ছায়া এই আম্মার দেহের অনেক পিছনে শুধু রামচন্দ্রনের স্মৃতিসূচক হয়ে থেকে যায়; রামচন্দ্রনের সঙ্গে তাঁর পরিবার-বহির্ভূত সম্পর্ককে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া ছাড়া তার আর কোনও ভূমিকা থাকে না৷ অন্নদায়িনী মা ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক আধুনিকতার বহু পুরাতন দুর্বলতা; সেই দৌর্বল্যতে ভর করেই জয়ললিতা রাষ্ট্রযন্ত্রের সমার্থক হয়ে ওঠেন৷ আম্মা ক্যান্টিন, আম্মা ফার্মেসি, আম্মা ফ্যানের দৌলতে জয়ললিতা-ইমেজ পৌঁছে যায় তামিলনাড়ুর ঘরে ঘরে, রাষ্ট্রদত্ত সমাজকল্যাণের প্রতীক হয়ে৷

কিন্ত্ত এই ইমেজ-সর্বস্ব জনকল্যাণের সাথে জনগণের দূরত্ব আজ অপরিমেয়৷ আজকের এআইএডিএমকে জাতপাতের রাজনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত; তার প্রধান নেতারা --- শশীকলা পান্নিরসেলভাম দুজনেই --- থেভার জাতের প্রতিনিধি৷ তাদের প্রায়সঙ্গী পিএমকে তামিলনাড়ুতে দলিতহত্যাকে শিল্পকলায় পরিণত করে ফেলেছে প্রায়, যার প্রতি জয়ললিতা চুপ করে থেকেছেন৷ তামিলনাড়ুর মিডিয়ার কণ্ঠরোধ জয়ললিতার চিরকলঙ্ক হয়ে রইবে৷ যে (উপ-)জাতীয় পপুলিজম থেকে ডিএমকে এআইডিএমকে দুয়েরই জন্ম, তা এহ বাহ্য হয়ে উঠেছে ; জনগণের স্বাধীন, সবাক হওয়ার গল্প হয়তো সিনেমার সাদা পর্দা আজও ফিসফিসিয়ে শোনায়, কিন্ত্ত তা বাস্তবায়িত করার পথ হয়তো আর বেঁচে নেই৷ সে কথাই হয়তো গুঢ় সঙ্কেতে রজনীকান্ত-এর নতুন ছবি, ‘কাবালি’ (২০১৬ ) বলে যায়; যে ছবিতে একদা ট্রেড ইউনিয়নিস্ট বর্তমানে জনকল্যাণকারী গ্যাংস্টার মালয় -নিবাসী কাবালি বিদেশবাসী তামিলদের জন্যে যে মুহূর্তে সব বিরোধিতা অতিক্রম করে জয় লাভ করেন, সেই মুহূর্তে রাষ্ট্র তাকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করায়৷ যে কণ্ঠরুদ্ধ জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন প্রতিনিয়ত দলিত হয়, তারা স্বপ্নবিকারে ভোগে, কতিপয় নেতাকে নিজেদের স্বপ্নসার ভেবে নিয়ে তাদের বিপদে মৃত্যুতে জীবনদান করে, অথবা নোটবন্দির হয়রানির মধ্যে নিষ্পাপ যন্ত্রণাবিলাসীর মতো ভাবে, এই যে কষ্ট সে পাচ্ছে, সেই বুঝি বা প্রগতি, স্বাধীনতা, ইত্যাদির লক্ষণ৷ দুর্ভাগা দেশে সেই অভাগাদেরও তো বেঁচে নিতে হবে!

বৈদূর্য চক্রবর্তী: চলচ্চিত্র গবেষক
 
সৌজন্যে: এই সময়, কলকাতা