বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল ভারতে ব্রাত্য কেন
অমিত গোস্বামী
গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষদিক। তখন টেলিভিশন দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বাড়িতে ছাদের ওপরে অ্যালমুনিয়ামের দুটি অ্যান্টেনা শোভা পেত। একটি ভারতের সরকারি চ্যানেলের জন্য। অন্যটি বিটিভি অর্থাৎ বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য। তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাকের ভাই অর্থাৎ বর্তমান সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ভারতের দূরদর্শন তখন দুয়োরানি। বিটিভির বিজ্ঞাপনের জোরে বাজারে বিকোচ্ছে বাংলাদেশি সাবান, গুঁড়োদুধ, কনডেন্সড মিল্ক, পেস্ট। চোরাইপথে আসছে সব। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিটিভির প্রচারে তখন রীতিমতো হিরো। বাংলাদেশের টিভি নাটকের জনপ্রিয়তায় ঢাকা পড়ে গেছে কলকাতায় তৈরি বাংলা সিনেমা। উপায় না দেখে কলকাতা দূরদর্শন শনিবারে চালিয়ে যাচ্ছে উত্তম, সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সৌমিত্র। তা সত্ত্বেও বোকাবাক্স শাসন করে যাচ্ছে পদ্মাপারের রাজ্জাক, ববিতা। এ এক অদ্ভুত বাংলাদেশি রাজত্ব বিরাজ করছে টেলিভিশনে। তীব্র আকর্ষণে সন্ধ্যা হলেই খুলছে টিভি নামক চৌখুপি বাক্স আর বাজছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’
অমিত গোস্বামী |
সিনেমা, টেলিভিশন বা বিনোদন জগতে আদর্শ খুব বেশি একটা কাজ করে না। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন চ্যানেল আপনার হাতের মুঠোয়। আপনি আপনার রিমোট কন্ট্রোল চাপতে থাকুন। বাংলাদেশে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া প্রভৃতি দেশের ভালো ভালো চ্যানেল দেখতে পাবেন। তাই ইন্ডিয়ার ওই চ্যানেলটি দেখব না, এসব কথা বলে এখন আর পার পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের অনেকের ধারণা, যেখানে আজ ভারত সারা বিশ্বের দর্শকদের তাদের চলচ্চিত্র, হিন্দি সিরিয়াল, নাটক, গান, নাচ দিয়ে মাতিয়ে তুলছে সেখানে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হয়তো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে তাদের দেশে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না। কিন্তু ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশে ভারতের টিভি চ্যানেলের প্রচার নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন বা আবেদন করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার না হওয়ার পেছনে আসল কারণটা কী?
ভারতে বিদেশি টিভি চ্যানেল দেখাতে হলে কিছু নিয়মনীতি পালন করতে হয়। সম্প্রতি ভারতীয় হাইকমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতে দেখানোর ক্ষেত্রে ভারত সরকারের কোনো আইনি বাধা নেই। ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে যে কেউ ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংক করতে পারবে।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ভারতীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও ভারতে কোনো বাংলাদেশি চ্যানেল ডাউনলিংকের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। কোনো কোম্পানি যদি বাংলাদেশি চ্যানেল ডাউনলিংক করতে চায়, তা হলে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নীতিমালা অনুযায়ী সর্বতোভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ভারতে ডাউনলিংকের জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেনি।’
তবে আবেদনকারী কোম্পানিকে প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় টাকা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিটি অতিরিক্ত চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ভারতীয় টাকা নেট মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই মূল্য ছাড়াও ডাউনলিংকের অনুমতি মঞ্জুরের সময় ১০ লাখ ভারতীয় টাকা ফি দিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আপলিংক করা প্রতিটি চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য বার্ষিক ফি হিসেবে ১৫ লাখ ভারতীয় টাকা দিতে হবে। ডাউনলিংকের নিবন্ধন ও অনুমতি ১০ বছর বহাল থাকবে। এটা করতে পারলে মাল্টি সিস্টেম অপারেটররাও (এমএসও) সেই চ্যানেল বিপণনের ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু বিদেশি টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ডাউনলিংক ফি বেশি হওয়ায় ভারতীয় ক্যাবল অপারেটররা আগ্রহ প্রকাশ করছেন না।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেল চালাতে আগ্রহী এখানকার চ্যানেল বিপণনকারী সংস্থাগুলো। কলকাতাসহ রাজ্যের বাঙালি দর্শকদের মধ্যে বাংলাদেশি চ্যানেল প্রদর্শনের জন্য নিয়মিত দর্শকদের কাছ থেকে চাপ সহ্য করতে হচ্ছে বিপণনকারীদের। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল আইনগতভাবে ভারতে ডাউনলিংকের অনুমোদন নিয়ে না আসায় দর্শকদের কাছে বাংলাদেশের চ্যানেল পৌঁছে দিতে পারছে না বিপণনকারী সংস্থাগুলো। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি চ্যানেলের মালিক আমাকে একান্ত আড্ডায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মাত্র ২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের বাজারে দেশীয় চ্যানেলগুলো চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর যদি ভারতে সম্প্রচারের জন্য বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয় তাহলে বিপদে পড়তে হবে।’
এতক্ষণে আসল সমস্যা বোঝা গেল। প্রথম ডাউনলিংকের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় টাকা, সঙ্গে ডাউনলিংকের অনুমতি মঞ্জুরের সময় ১০ লাখ ভারতীয় টাকা এবং ডাউনলিংকের জন্য বার্ষিক ফি হিসেবে ১৫ লাখ ভারতীয় টাকা প্রতি চ্যানেলকে দিতে হবে। এখানে একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার। ইংরেজি বা হিন্দি চ্যানেলের প্রসার সর্বভারতীয়। কিন্তু বাংলা চ্যানেলের প্রচার শুধু বাংলাভাষীদের মধ্যে। কাজেই সারা ভারতে প্রচারিত বিদেশি চ্যানেলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর একই রকম অর্থ জমা দেওয়ার ফরমানে তাদের ইচ্ছা বা উৎসাহ আজ অবধি তৈরি হয়নি।
তাহলে বাংলাদেশে যে ভারতীয় চ্যানেলগুলো প্রচারিত হচ্ছে সে জন্য তাদের বাংলাদেশ সরকারকে কী দিতে হচ্ছে? ক্যাবল নেটওয়ার্ক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা কোয়াবসূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতের প্রায় অর্ধশত চ্যানেল প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা খুবই কম অর্থ দিচ্ছে। ভারতীয় চ্যানেল মাত্র তিন লাখ টাকার টোকেন মানি দিয়ে বাংলাদেশে চালু করা যায়। আরও একটা কথা, বেশিরভাগ ভারতীয় চ্যানেল ‘ফ্রি টু এয়ার’ (বিনামূল্যের) হওয়ায় সব চ্যানেল সম্প্রচার করা অত্যন্ত সুবিধাজনক।
বুঝলাম। কিন্তু এ তো অন্যায়। কোথায় ৫ কোটিরও বেশি আর কোথায় ৩ লাখ! ক্যাবল অপারেটররা ব্যবসায়ী। তারা তাদের সুবিধা দেখবেন। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান একমাত্র করতে পারেন দুই দেশের সরকার। কিন্তু তার আগে জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশে স্বাধীনতা প্রায় ৪৪ বছর পর প্রথম বাস্তবসম্মত সম্প্রচার নীতিমালা এতদিনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখনো সম্প্রচার আইন তৈরি হয়নি। কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের গত সফরের সময় এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু হয়নি। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। কারণ তিস্তার স্রোত বাংলাদেশের জন্য যতটা জরুরি, বাংলাদেশের চ্যানেল তেমনই ভারতে আসা জরুরি। না হলে যেটা হবে সেটা হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরেÑ সেটা আর হবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অনেক কাজ করছে, যা বাস্তবোচিত ও ভবিষ্যতের জন্য ভালো ফল আনতে বাধ্য। কাজেই তাদের কাছে এই প্রত্যাশা করা যেতেই পারে, এই সমস্যা সমাধানে তারা উদ্যোগী হবে। কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর পশ্চিমবঙ্গে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? ভারতের অন্যতম বৃহত্তম চ্যানেল বিপণনকারী সংস্থা মন্থনের পরিচালক শিবশঙ্কর চক্রবর্তীর মতে, বাংলাদেশে যেহেতু অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গবাসীর পূর্বপুরুষের ভিটা এবং একই সংস্কৃতি, ভাষা এবং খাদ্যাভ্যাসের ফলে এখানে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো সম্প্রচারে আসলে দর্শকদের যেমন বাংলাদেশি চ্যানেল দেখার সুযোগ হবে, তেমনই চ্যানেলগুলোও ব্যবসা করতে পারবে। জিটিপিএল নামে আর একটি বৃহত্তম চ্যানেল বিপণনকারী সংস্থার পরিচালক সুষেন বলেন, ‘প্রতিদিন কয়েকশ ফোন আসে। সবারই দাবি, অন্য বিদেশি চ্যানেল দেখা গেলে কেন বাংলাদেশের খবর-নাটক-ছবি কোনো চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে না। এর জবাব আসলে আমরা দিতে পারি না।’ ভারতের জি-গ্রুপের বিপণনকারী সংস্থার সিটি ক্যাবলের পরিচালক সুরেশ শেঠিয়া মনে করেন, যেহেতু বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল এখানে দেখানো হয় না তাই যারাই আগে এ উদ্যোগ নিয়ে আসবে তারা অবশ্যই ব্যবসা করতে পারবে।
বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ভারতে এলে আরেকটি লাভ হবে। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। বাংলাদেশের কোম্পানি প্রাণ গ্রুপ কলকাতার নাগেরবাজারের কাছে একটি অফিস নিয়ে ভারতের ব্যবসা জগতে তাদের উপস্থিতির ক্ষীণ স্বাক্ষর রেখেছেন। তারা জি বাংলাসহ আরও দু‘একটি টিভির খুব জনপ্রিয় কয়েকটি অনুষ্ঠানের মূল স্পন্সর। কোটি কোটি টাকা ঢেলেছেন, অবশ্যই ভারতীয় কোম্পানি হিসেবে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে যাতে তাদের প্রডাক্টের ব্যাপক প্রচার হয়। হয়েছেও। তার সঙ্গে উপরি লাভ হয়েছে এই যে, প্রাণ গ্রুপের প্রডাক্টের জনপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গে এতটাই বেড়ে গেছে যে, তাদের সেই দাবি মেটানোর ক্ষমতা নেই। একইভাবে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর আগমনে বেশ কিছু ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা শুরু করবে। এই যে পারস্পরিক ব্যবসায়িক পরিযান, এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বলবান করে তুলবে।
ভারতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘এটা অনুচিত। মানা যায় না। আমরা তো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখতে পাই, তবে বাধা কেন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের ওপর?’
কবি শঙ্খ ঘোষ বললেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু। পাকিস্তানি চ্যানেল দেখা যায়, অথচ বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে পারি না। এটা কী করে হয়!’
অর্থাৎ এ দেশের সুশীল সমাজ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তবে আরেকটি কথা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ খেয়ে নেয় বিজ্ঞাপন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেন ও ভারতে এই বিজ্ঞাপনের ভাগ ১১ শতাংশ। কাজেই বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোকেও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে গেলে সাবালক হতেই হবে। কিন্তু শেষ অবধি বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করা হয় সেটাই দেখার বিষয়। না হলে বাংলা সংস্কৃতি যে অবাঙালি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হবে তা বলাই বাহুল্য।
অমিত গোস্বামী: ভারতীয় কবি ও সম্পাদক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন