মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

কিউবার সমাজতন্ত্র তার নিজের মতো

কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির ২০১৬ সালের কংগ্রেসে ফিদেল কাস্ত্রো

 অঞ্জন চক্রবর্তী

ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে অনেক কথা গত ক’দিনে নতুন করে বলা হয়েছে। তাঁর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং রোমাঞ্চকর। বস্তুত, পঞ্চাশটা রহস্যরোমাঞ্চ ছবি একসঙ্গে করলেও ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনটাকে পুরোপুরি ধরা যাবে না। তাই সে দিকে না গিয়ে বরং কিউবায় এবং বিশ্বে তাঁর গুরুত্বটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
 

সার্বভৌমত্ব, বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র

ফিদেলের চিন্তা ও কাজের কেন্দ্রে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হল জাতীয় সার্বভৌমত্ব। তিনি যে এক সময় সমাজতন্ত্রের পথ নিয়েছিলেন, সেটাও বুঝতে হবে বাতিস্তার বিরুদ্ধে কিউবার সার্বভৌমত্ব অর্জনের সংগ্রামের প্রেক্ষিতেই। বাতিস্তা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব সেই পুতুল-সরকারকে উৎখাত করে, তার লোকজন মায়ামিতে পালিয়ে গিয়ে প্রধান বিরোধী ঘাঁটি তৈরি করে। বিপ্লবের আগে কিউবার রাজনীতি ও সরকারি নীতি ছিল আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে, জমির মালিক ছিল ভূস্বামীরা ও মার্কিন কোম্পানিগুলি, নানা পণ্য হয় আমেরিকা থেকে আমদানি হত অথবা কিউবায় আমেরিকান কোম্পানি তৈরি করত, দারিদ্রের মাত্রা ছিল অস্বাভাবিক বেশি, নিরক্ষরতা ও অস্বাস্থ্য ছিল ব্যাপক, জাতি-বৈষম্য, বিশেষ করে আফ্রিকা থেকে আসা ক্রীতদাসদের বংশধরদের নিপীড়ন একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, যে কোনও প্রতিবাদ ছিল নিষিদ্ধ, যে কোনও বিরোধিতা কঠোর ভাবে দমন করা হত।

ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর লড়াই শুরু করেছিলেন, কমিউনিস্ট নয়, বাম জাতীয়তাবাদী হিসেবে। স্বভাবতই তিনি মনে করতেন, জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব হল প্রথম কথা, তাকে বাদ দিয়ে নতুন কিউবা নির্মাণ অসম্ভব। এই আদর্শই মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে আজ অবধি কিউবার আপসহীন অবস্থানের মূলে। কিউবা যে আন্তর্জাতিক সংহতিকে বরাবর গুরুত্ব দিয়েছে, তারও ভিত্তিতে ছিল বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান।

কিউবার বিপ্লবের পরে আমেরিকা দেখে, তার প্রভাব খর্ব হচ্ছে। কাস্ত্রোর সরকারকে উৎখাত করতে উঠেপড়ে লাগে তারা, এক সময় ছোট্ট প্রতিবেশী দেশটির উপরে নির্মম অবরোধ জারি করে। সিআইএ-র উদ্যোগে বহু বার কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা হয়। ফিদেল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকে বলেছিলেন, ‘আততায়ীর আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়াটা যদি অলিম্পিকের খেলা হিসেবে স্বীকৃত হত, তবে আমি স্বর্ণপদক পেতাম।’  কিউবার উপর অবরোধ ও (১৯৬১ সালে মার্কিন ব্যবস্থাপনায়) আক্রমণের আসল নিশানা ছিল তার সার্বভৌমত্ব। এই প্রেক্ষিতেই ফিদেল একমাত্র কার্যকর বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্রের পথ বেছে নিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত ধরলেন, যদিও সেই সমাজতন্ত্রের চরিত্র নির্ধারণ করলেন কিউবার নিজস্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী।

একদলীয় শাসন এবং বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের কারণে কাস্ত্রো সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিপ্লবের ভিতটা অক্ষত রাখার জন্য এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল, যে ভিতের উপর গড়ে উঠেছিল সার্বভৌমত্ব, জাতি-বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসান, ভূমি সংস্কার, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, দারিদ্র দূরীকরণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, খেলাধুলার প্রসার এবং শিল্পায়ন। ঠিক হোক বা ভুল হোক, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি (১৯৬৫ সালে যার জন্ম) মনে করে, এই নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া এক কোটি দশ লক্ষ মানুষের ছোট্ট দেশটির পক্ষে সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করা ও ধরে রাখা সম্ভব নয়।

ধনতন্ত্রের মতোই সমাজতন্ত্রও অনেক ধরনের হতে পারে। কিউবার সমাজতন্ত্রও তার নিজের মতো। তার কাঠামোটা উপর থেকে বা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, তা নিজের অন্দর থেকে বিবর্তিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এবং এই কারণেই ফিদেল ও তাঁর কিউবা ভয়ঙ্কর আর্থিক অবরোধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সামলে এগারো জন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পার করেছে। কিউবার সমাজতন্ত্রের সাফল্যের মূলে আছে তার জনসাধারণের অন্তর্নিহিত শক্তি।

আন্তর্জাতিকতা ও সংহতি

দৃশ্য ১: ২০১৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ফিরে এল ইবোলা। মহামারীতে এগারো হাজারের বেশি প্রাণ গেল। চার দিকে প্রবল আশঙ্কা— বৃহত্তর দুনিয়ায় এই কালান্তক রোগ ছড়িয়ে পড়বে। পশ্চিম দুনিয়ার আতঙ্কিত দেশগুলি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আবেদন জানাল, নিজেরা অবশ্য বিশেষ কিছু করল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০০০ সৈন্য পাঠাল, যদিও ঠিক কী কারণে বোঝা গেল না। এক কোটি দশ লক্ষ মানুষের দেশ কিউবা তৈরি করল হেনরি রিভ ব্রিগেড, মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলিতে পাঠিয়ে দিল ৪৬১ জন ডাক্তার ও নার্সকে, বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে ইবোলার মোকাবিলায় নামলেন তাঁরা, অসংখ্য প্রাণ বাঁচালেন, অন্য দেশে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আটকাতে তৎপর হলেন। ডব্লিউএইচও তো বটেই, এমনকী চিরশত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইবোলার মোকাবিলায় কিউবার এই ভূমিকার প্রশংসা করল। হেনরি রিভ ব্রিগেডকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হল। পুরস্কার অবশ্য তারা পেল না— কেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

বিপ্লব-উত্তর কিউবার স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা সুপ্রসিদ্ধ, যার রূপকার ছিলেন এর্নেস্তো চে গেভারা। তার অনন্যতা এই যে, নিজের জ্ঞান, মানবসম্পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে কিউবা সব সময় আগ্রহী ও তৎপর। এখানেই তার আন্তর্জাতিকতা। এর মূলে ক্ষমতার ছক নেই, আছে এই বিশ্বাস যে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় গোটা দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষের নৈতিক অধিকার আছে। এ কালের পৃথিবীতে আর কোনও দেশ আন্তর্জাতিক সংহতির এই মৌলিক আদর্শে স্থিত থেকে বিভিন্ন উপলক্ষে এমন নিয়মিত ভাবে তার প্রমাণ দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিউবা বাকি পৃথিবীকে কী দিয়েছে, সেটাই আন্তর্জাতিক পরিসরে তার অস্বাভাবিক প্রভাবের পিছনে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। জাগতিক ভূমিকার চেয়েও এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল নৈতিক প্রভাব।

দৃশ্য ২: লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পশ্চিমী উপনিবেশ এবং মার্কিন মদতে কায়েম হওয়া স্বৈরাচারী জমানার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বড় ভূমিকা নিয়েছে কিউবা। আফ্রিকার দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। স্যঁ জেকবস-এর ভাষায়, ‘আফ্রিকা যদি একটা দেশ হয়, তবে ফিদেল কাস্ত্রো আমাদের এক জন জাতীয় নায়ক।’ পশ্চিমী দেশগুলির (বা অধুনা চিনের) মতো মূল্যবান খনিজ সম্পদ দখলের জন্য কিউবা এই দেশগুলিতে হস্তক্ষেপ করেনি, ঔপনিবেশিক তথা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। রবেন আইল্যান্ড-এর কারাগার থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছিলেন, ‘এই প্রথম অন্য এক মহাদেশ থেকে একটি রাষ্ট্র এসেছে আফ্রিকা থেকে কিছু নিয়ে যেতে নয়, আফ্রিকানদের স্বাধীনতা অর্জনে সহায় হতে।’ কঙ্গো, গিনি বিসাউ ও কেপ ভের্দে, অ্যাঙ্গোলা বা মোজাম্বিকের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার ভূমিকা সুপরিচিত। ১৯৭৬ ও ১৯৮৮ সালে সদ্য-স্বাধীন অ্যাঙ্গোলায় কেবল বিদ্রোহী জঙ্গি নয়, সিআইএ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী শাসকদের অর্থ ও অস্ত্রে পুষ্ট শ্বেতাঙ্গ ভাড়াটে সৈন্যদের আক্রমণ থেকে নবীন রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে সে দেশের নায়কদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ফিদেল সেনা পাঠিয়েছিলেন। হাজার হাজার কিউবান সৈনিক সেই সংঘর্ষে প্রাণ হারান। অ্যাঙ্গোলায় বিদ্রোহীরা হার মানে। ১৯৮৮ সালে শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকার সেনাও পরাজিত হয়। এর ফলেই সে দেশের বর্ণবিদ্বেষী জমানার অবসান ত্বরান্বিত হয়। অন্য দিকে জন্ম নেয় স্বাধীন নামিবিয়া।

১৯৯১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় পালাবদলের পরে নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে কিউবায় যান এবং ফিদেলকে বলেন, ‘অনেক দেশের মানুষ সম্প্রতি আমাদের দেশে গেছেন। কিউবা আমাদের বন্ধু, সে আমাদের দেশের মানুষকে, বিশেষত চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, নানা ভাবে আমাদের সংগ্রাম জারি রাখতে সাহায্য করেছে। অথচ আপনি আমাদের দেশে যাননি। কবে আসবেন?’ মনে রাখতে হবে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড সহ তথাকথিত মুক্ত দুনিয়ার বহু দেশই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারকে প্রায় শেষ পর্ব অবধি সমর্থন করেছে। সেই দেশে এবং আফ্রিকার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে মহালুণ্ঠনে লিপ্ত ছিল তাদের অনেকেই। পশ্চিম দুনিয়া এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যম ফিদেল ও তাঁর কিউবার যে সমালোচনা করে এসেছে, সে বিষয়ে ম্যান্ডেলা মন্তব্য করেছিলেন, ‘গত চল্লিশ বছর ধরে যারা বর্ণবৈষম্যবাদী শাসনকে সমর্থন করে এসেছে, এখন তারাই আমাদের কিউবা নিয়ে উপদেশ দিচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ে যারা আমাদের কোনও সাহায্য করেনি, আত্মমর্যাদা থাকলে কারও পক্ষে কখনও তাদের উপদেশ শোনা সম্ভব নয়।’

রোমান্টিক রাজনীতি

ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন এক ভঙ্গুর মানুষ। তিনি ভুল করতেন, নিঃসংকোচে সেই ভুল স্বীকারও করতেন। কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনেকে যেমন ভালবাসা ও যৌনতা নিয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকেন, তেমন কোনও শুচিবাই তাঁর ছিল না। তাঁর এই মানবিক স্বভাবের কথা জানত বলেই সিআইএ এক বার ফিদেলের প্রাক্তন প্রেমিকা মারিতা লরেন্সকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিল পানীয়তে বিষ মিশিয়ে তাঁকে খুন করতে। ফিদেল সেই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছিলেন। বাকিটা মারিতার মুখে শোনা যাক। ‘‘আমি ধরেই নিয়েছিলাম ও আমাকে গুলি করবে। কিন্তু আমার হাতে বন্দুকটা তুলে দিয়ে ও বলল, ‘তুমি আমাকে মারতে এসেছ?’ তার পর সিগারে একটা টান দিয়ে ও চোখ বন্ধ করল। ও নিজেকে এতটা দুর্বল করে তুলল, কারণ ও জানত, আমি কাজটা পারব না। ও আমাকে তখনও ভালবাসে, আমিও ওকে।’’ বুলেটটা বের করে নিয়ে লরেন্স ফিদেলের বুকে আশ্রয় নিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনে বিপ্লবী রাজনীতি আর ভালবাসা হাতে হাত মিলিয়ে চলত।

"আমার বয়েস নব্বইয়ের কাছাকাছি হল। সকলের মতোই আমিও অচিরে বিদায় নেব। কিন্তু আমরা যদি সমবেদনা ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে কাজ করি, তা হলে মানুষের প্রয়োজনীয় বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সৃষ্টি করতে পারব। কিউবার কমিউনিস্টদের ধারণাগুলি সেটাই প্রমাণ করে।"

অঞ্জন চক্রবর্তী: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

নতুন পাক সেনাপ্রধান সম্পর্কে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল বিক্রম সিংহে

কামার জাভেদ বাজওয়া ‘অমায়িক’ এবং ‘অত্যন্ত পেশাদার’

 নয়া পাক সেনাপ্রধান বাজওয়া ও জাতিসংঘ মিশনে তার বস  বিক্রম সিংহে
পেশাদারিত্বের কারণেই বাজওয়া অন্য সব পাক সেনাপ্রধানের চেয়ে আলাদা। পাক জাতীয় স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন। তাই তার সম্পর্কে ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে: জেনারেল বিক্রম সিংহের ইঙ্গিত
  

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন

পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে ভারতকে। মন্তব্য প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান বিক্রম সিংহের। ১ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন যিনি, সেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল বিক্রম সিংহের অধীনে বেশ কিছু দিন কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জেনারেল বিক্রম সিংহের মন্তব্য, পাকিস্তানের হবু সেনাপ্রধান বেশ ‘অমায়িক’ এবং ‘অত্যন্ত পেশাদার’। কিন্তু বিক্রম সিংহের সতর্কবার্তা, পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব যখন বাজওয়ার কাঁধে বর্তাতে চলেছে, তখন আচরণে বদল অস্বাভাবিক নয়। সে কথা মাথায় রেখে বাজওয়ার ‘পেশাদারিত্ব’ সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জেনারেল সিংহ।

প্রধানমন্ত্রী শরীফের সাথে নতিুন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল বাজওয়া
ভারতের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল দলবীর সিংহ সুহাগ যাঁর হাত থেকে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনিই হলেন জেনারেল বিক্রম সিংহ। এই বিক্রম সিংহের অধীনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ এক অভিযানে কাজ করেছেন পাকিস্তানের হবু সেনাপ্রধান। মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোতে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ থামানোর জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের যে শান্তি অভিযান, তাতে এক সময় অংশ নিতে হয়েছিল বিক্রম সিংহকে। রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রেরিত বহুজাতিক শান্তি বাহিনীর ইস্টার্ন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং (জিওসি) পদে ছিলেন জেনারেল বিক্রম সিংহ। পাক সেনার অফিসার কামার জাভেদ বাজওয়া সে সময় বিক্রম সিংহের অধীনস্থ একটি ব্রিগেডের কম্যান্ডার ছিলেন। ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান সেই সময়ের কথা তুলে ধরে জানিয়েছেন, কামার জাভেদ বাজওয়া এক জন ‘অত্যন্ত পেশাদার’ ব্যক্তি। বাজওয়া তাঁর অধীনে ‘অসামান্য দক্ষতা’র সঙ্গে কাজ করেছিলেন বলেও জেনারেল বিক্রম সিংহ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। কামার জাভেদ বাজওয়া এক জন ‘অমায়িক’ মানুষ বলেও জেনারেল বিক্রম সিংহের মত। কিন্তু এর পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাপ্রধানের ব্যাখ্যা, কোনও আন্তর্জাতিক মিশনে যখন কোনও সৈনিক কাজ করেন, তখন তাঁর মানসিকতা যে রকম হয়, দেশের হয়ে কাজ করার সময় তেমনটা নাও হতে পারে। কামার জাভেদ বাজওয়া পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পদে বসার পর তিনি পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন। তাই জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া সম্পর্কে ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে, মনে করছেন বিক্রম সিংহ। বাজওয়ার অসামান্য পেশাদারিত্বের কারণেই তিনি অন্য পাক সেনাপ্রধানদের চেয়ে আলাদা, অনেকটা এমনই ইঙ্গিত জেনারেল বিক্রম সিংহের।

পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ অবসর নিচ্ছেন ৩০ নভেম্বর। অর্থাৎ পুরোদস্তুর সেনাপ্রধান হিসেবে কামার জাভেদ বাজওয়া কাজ শুরু করবেন ১ ডিসেম্বর থেকে। কিন্তু সেনার শীর্ষ পদ হস্তান্তরিত হয় যে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে, তা আয়োজিত হচ্ছে ২৯ নভেম্বর। রাওয়ালপিন্ডিতে পাক সেনার সদর দফতরে ওই দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে বাজওয়ার হাতে দায়িত্ব তুলে দেবেন রাহিল শরিফ। বর্তমানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে থাকা কামার জাভেদ বাজওয়া হতে চলেছেন বালুচিস্তান রেজিমেন্টের চতুর্থ আধিকারিক, যিনি পাক সেনার শীর্ষ পদ পাচ্ছেন। বালুচিস্তান রেজিমেন্ট থেকে আসা অন্য তিন পূর্বতন পাক সেনাপ্রধান হলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আসলাম বেগ এবং জেনারেল আশফাক পারভেজ কিয়ানি।

বাজওয়া নিয়ন্ত্রণ রেখায় তথা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে দীর্ঘ দিন কর্মরত ছিলেন। তিনি পাক সেনার ১০ কোর-কে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উত্তরাংশে দীর্ঘ দিন কাজ করার সেই অভিজ্ঞতার সুবাদে পাকিস্তানের কাশ্মীর নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ রেখার দু’পাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাজওয়া সম্যক ওয়াকিবহাল।

মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ও ভোটের উলটপুরাণ

ট্রাম্পের থেকে ৬৩০৮৭৭টি বেশিপপুলার ভোটপেয়েও হিলারি পরাজিত

আর্য ভট্টাচার্য

ট্রাম্প এখন আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতার দায়িত্বের হস্তান্তর চলছে, আরও বেশ কিছু দিন বাদে উনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করবেন৷ এই নির্বাচনের ফলাফল অনেককে স্তম্ভিত করেছে, আমাকেও৷ নির্বাচনের দিন সকালে একটি ওয়েবসাইটে বিশেষজ্ঞের মতন লিখেছিলাম যে হিলারি জিতবে তার সম্ভাবনা একশো শতাংশ, এখন ব্যবধান কত হবে সেটাই দেখার৷ আমি ভুল প্রমাণিত হয়েছি৷ কারণ সবাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে, দু-একজন বাদে যারা বলেছিল ট্রাম্প জিতবে৷ এমনকী খবরের কাগজে পড়লাম যে ট্রাম্পের নিজের যে পোল --- সমস্ত নির্বাচনী ক্যাম্পেইনেরই নিজস্ব পোল থাকে --- সেটাও নাকি বলেছিল ট্রাম্প হারবে৷  

জীবন জীবিকার তাগিদে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকি, আর জাতে বাঙালি, তাই নির্বাচনী উত্তেজনার আঁচ আমাকে স্পর্শ করবেই৷ এই নিয়ে দেশে আমার তৃতীয় নির্বাচন যা আমি খুব কাছ থেকে লক্ষ করলাম৷ বারের নির্বাচন আমার কাছে খুব ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যদিও আমি নিজে ভোট দিতে পারি না৷ যে দেশে আমার সন্তানেরা জন্মগ্রহণ করেছে সে দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে তাই নিয়ে আগ্রহ আছে৷ আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট-এর বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিকল্পনা রেটোরিক এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁর কিছু কিছু ঘটনা যা সামনে এসেছে তাতে ক্রমশ এই নির্বাচন আমার কাছে ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে৷ যে ব্যক্তি জাত বর্ণ দিয়ে সারা দেশকে ভাগ করেন, যে ব্যক্তি নারীদের অসম্মান করেন এবং তা প্রকাশ্যে এলে বলেন তো ছেলেদের কথা (locker room talk), সেই ব্যক্তি আমি যে দেশে দীর্ঘদিন ধরে ট্যাক্স দিই তার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না৷ কিন্তু আমরা জানি যে গণতন্ত্রে এমনটা হতেই পারে, তাকে মেনে নেওয়াই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা৷ কিন্তু আর একটি দিকও আছে, ভেবে দেখা যে কেন এমন হল৷ সত্যিই কি গরিষ্ঠসংখ্যক আমেরিকার নাগরিক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার অনুযায়ী মুসলমানদের দেশে ঢুকতে না দেওয়া, মেক্সিকোর সীমান্তে প্রাচীর তৈরি, গর্ভপাত করলে শাস্তি দেওয়া বা অন্যান্য সামাজিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপের সপক্ষে ভোট দিল

ইলেকটোরাল কলেজনিয়মের আবির্ভাব দাসপ্রথার সময়৷ প্রতিটি রাজ্যে ভোটাররা সেই রাজ্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যাদেরইলেকটরবলা হয়৷ কোন রাজ্যে কতজনইলেকটরথাকবে তা আগে থেকে নির্ধারিত কনস্টিটিউশনে৷ যে রাজ্যে ভোটাররা যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বেশি ভোট দেয় সেই রাজ্যের সমস্তইলেকটরসেই প্রার্থীর৷ 
 

সেই আলোচনায় বিশদে যাবার আগে ছোট্টো করে বলে নিই যে ঠিক কী করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়৷ নির্বাচনে প্রতিটি রাজ্যে ভোটাররা সেই রাজ্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করে যাদেরইলেকটরবলা হয়৷ আসলে তারাই শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে৷ সাধারণ জনগণ নির্বাচনের দিন কে প্রেসিডেন্ট হবেন সেই ভোটে ভোট দেয়, কিন্তু শেষেইলেকটররা ভোট দিয়ে পাকাপাকি ভাবে ঠিক করে কে প্রেসিডেন্ট হবেন৷ যেমন বারেরইলেকটররা ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে ভোট দেবেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য৷ প্রতি রাজ্যেই প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যারা লড়ছে তারা নিজেদেরইলেকটরঠিক করে৷ কোন রাজ্যে কতজনইলেকটরথাকবে তা আগে থেকে নির্ধারিত আমেরিকার কনস্টিটিউশনে৷ যে রাজ্যে ভোটাররা যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বেশি ভোট দেয় সেই রাজ্যের সমস্তইলেকটরসেই প্রার্থীর৷ তারা পরে অবশ্যই নিজের প্রার্থীকে নির্বাচন করে৷টেকনিকালিট্রাম্পেরইলেকটরহিলারিকে শেষে ভোট দিতে পারে, কিন্তু এমন হয় না৷ মেইন নেব্রাস্কায় একটু নিয়মটা আলাদা, সেখানে প্রতিটি কংগ্রসেনাল ডিস্ট্রিক্ট একটি করেইলেকটোরালভোট এবং বাকি দুটি সমস্ত রাজ্যে যে বেশি ভোট পেয়েছে তার দিকে যায়৷ উদাহরণ নিলে, ক্যালিফোর্নিয়ায় সব মিলিয়ে ৫৫ টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পূর্বনির্ধারিত কনস্টিটিউশন অনুযায়ী৷ হিলারিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় বেশি মানুষ ভোট দিয়েছে৷ অতএব, সব টি ইলেকটোরাল ভোট হিলারির পক্ষে গেল৷ সাধারণ জনগণ নির্বাচনের দিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য যে ভোট দিয়েছেন তা ওইইলেকটরঠিক করার জন্য লাগে, পরে তার আর কোনও গুরুত্ব নেই৷ এই ভোটকে বলেপপুলার ভোট হয়তো অনেকেরই জানা, কিন্তু এই ব্যাখ্যাটা জরুরি আমার লেখার পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য৷ এবারের ভোটের হিসেব অনুসারে (এই প্রতিবেদন লেখার সময় অবধি, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের হিসেব ) ইলেকটোরাল কলেজের ২২৮টি ভোট পেয়েছেন হিলারি, ট্রাম্প পেয়েছেন ২৯০টি ভোট৷ পপুলার ভোটের মধ্যে হিলারি পেয়েছেন ৬০, ৯৮১,১১৮ এবং ট্রাম্প ৬০,৩৫০,২৪১৷ হ্যাঁ, হিলারিপপুলার ভোটে৬৩০,৮৭৭ ভোট বেশি পেয়েছেন৷ অর্থাৎ শুধুমাত্র যদি জনগণের ভোটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হত তা হলে হিলারি আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হতেন৷ রকম কী করে সম্ভব হল? উত্তর হলইলেকটোরাল কলেজ ভোট

২৭০-এর বেশিইলেকটোরাল কলেজ ভোটপেয়েছেন ট্রাম্প, আর আমেরিকারকনস্টিটিউশনঅনুযায়ী সেটাই নির্ধারিত করে কে প্রেসিডেন্ট হবেন৷ তা হলে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ আমেরিকান না চাইলেও শুধুমাত্রইলেকটোরাল কলেজভোটের হিসেব কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সম্ভব৷ আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবার নয়, সাম্প্রতিক অতীতে অ্যাল গোর, জর্জ বুশ জুনিয়রের কাছে ২০০০ সালে ঠিক এই ভাবেই পরাজিত হয়েছিলেন৷ আমেরিকার জনগণ অ্যাল গোর -এর পক্ষে ভোট দিলেওইলেকটোরাল কলেজভোটের হিসেবে গোর পরাজিত হয়েছিলেন৷ কিছুদিন আগে যখন ভোটের বাজার উত্তন্ত, এইইলেকটোরাল কলেজ’  ভোটের ইতিহাস নিয়ে একখানি প্রবন্ধ পড়েছিলাম৷ লিখেছেন ইয়েল স্কুল-এর অধ্যাপক অখিল রিড আমর, পড়ান কনস্টিটিউশন ল৷ এই প্রবন্ধে অখিল দেখিয়েছেন এইইলেকটোরাল কলেজ’  ভোটের ইতিহাস কী, কেন তা এখন কাজ করে না৷ এই লেখার পরবর্তী অধ্যায় অনেকাংশে সেই লেখাটির কাছে ঋণী৷ ইতিহাসআমেরিকারকনস্টিটিউশন’- ১২তম অ্যামেন্ডমেন্টে লেখা আছে কী ভাবে দেশের প্রেসিডেন্ট ভাইস -প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে৷ ১৮০৩ সনে এই অ্যামেন্ডমেন্ট প্রথাগত ভাবে সই সাবুদ করেকনস্টিটিউশন’- জায়গা পায়৷ আর তখন থেকেই এইইলেকটোরাল কলেজ’-এর ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়৷  

কী কারণে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়? প্রচলিত যে কারণ পাঠ্যবইতে পড়ানো হয় এবং লোকে মেনে নেয় তা হল : এক, বড়ো ছোটো রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার সাম্য আনতে৷ যে রাজ্যে বেশি লোক থাকে তারা যাতে বেশি প্রাধান্য না পায়৷ দুই, সাধারণ জনগণের কাছে তথ্য বেশি থাকত না, তাই তারা জানতে পারত না যে অন্য কোনও রাজ্যের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তাদের জন্য বেশি উপযোগী কি না৷ অখিলের মতে এই সাধারণগ্রাহ্য কারণগুলোর মাঝে যা ঢাকা পড়ে যায়, তা হল আমেরিকার তৎকালীন কালো ইতিহাস---দাসপ্রথা৷ ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার সভায় জেমস উইলসন যখন সমস্ত জনগণের দ্বারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তাব আনেন তখন ভার্জিনিয়া রাজ্যের প্রতিনিধি জেমস ম্যাডিসন তার তীব্র প্রতিবাদ করেন বলেন দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জন্য এই প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য নয় ---‘The right of suffrage was much more diffusive [i.e., extensive] in the Northern than the Southern States; and the latter could have no influence in the election on the score of the Negroes.’ যদি সরাসরি নির্বাচন হত তা হলে দক্ষিণের রাজ্যের দাসরা ভোট দিতে পারত না, আর তাতে উত্তরের রাজ্যগুলোর সুবিধা হত৷ এই সভাতেই ম্যাডিসনইলেকটোরাল কলেজ’-এর প্রথম প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তী কালে তাই কার্যকরী হয়৷  

কনস্টিটিউশন-এর প্রথম ছত্রিশ বছরের মধ্যে বত্রিশ বছর ভার্জিনিয়ার প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়৷ বর্তমান তা হলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতির দরকার কতটা? ইন্টারনেটের যুগে এখন সমস্ত তথ্য সবার কাছে চোখের পলকে পৌঁছে যায় অতএব, ‘ইলেকটরস’  বেশি খবর রাখেন তা আর সত্য নয়৷ আর এখন দাসপ্রথাও নেই, তা হলে? অখিল তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন যাঁরা এইইলেকটোরাল কলেজ’  ভোটের পক্ষে, তাঁরা দশটি অজুহাত দেখান৷ যার মধ্যে আছে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না দেওয়া, টেনিসের মতন খেলারঅ্যানালজি’  যেখানে মোট পয়েন্টে না জিতেও খেলা জেতা যায়, ছোটো ছোটো শহরের লোকেদের কথা ভাবতে বাধ্য করা, ভৌগোলিক কারণে কোন এক জায়গায় বেশি লোকজন থাকলে সেখানকার লোকেদের ভোটের ওজন যাতে বেশি না হয় সেটা খেয়াল রাখা ইত্যাদি৷ উনি সবকটা অজুহাতকেই যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন৷ মূলত উনি যা বলেছেন তা হল যদি কোনও রাজ্যের গভর্নর সেই রাজ্যেরপপুলার ভোট’  দিয়ে নির্বাচন করা যায় তা হলে প্রেসিডেন্টকে যাবে না কেন? টেনিসের মতন খেলায় তাত্ক্ষণিক উত্তেজনা তৈরির জন্য যে অনিশ্চয়তার দরকার তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দরকার নেই৷ অখিল যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে দেখিয়েছেন কেন আজকের যুগেইলেকটোরাল কলেজঅচল৷ মূলত তাঁর যুক্তি হল সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সরাসরিইলেকটরবাগভর্নর’  নির্বাচনের থেকে আলাদা কিছু না৷ অন্যগুলো যদি সরাসরি নির্বাচনে সম্ভব হয় তা হলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও সম্ভব৷ গণতন্ত্রে সবার কথাই ভাবা উচিত, ‘মাইনরিটির’  স্বার্থও যাতে রক্ষিত হয় সেটা দেখা একটা দিক, অন্য দিক হল একটা সীমিত অংশ বিরাট অংশের হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা যাতে না পায় সেটাও দেখা৷ মিশিগানে হিলারি মাত্র ১১,৮৩৭ ভোটে হেরেছেন, কেন তা বড়ো হয়ে দাঁড়াবে যেখানে ক্যালিফোর্নিয়ায় উনি মিলিয়নেরও বেশি ভোটে জিতছেন?  

একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে ১২ জন মহিলা যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন প্রকাশ্যে, সেই প্রার্থীই তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে ছাপিয়েছেন যে মুসলিমদের দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না, যিনি জাত বর্ণের ভিত্তিতে সারা দেশকে ভাগ করেছেন, তিনিই আজ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট৷ অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, পরিবেশ নীতি নিয়ে হতে পারে, কিন্ত্ত বর্ণবৈষম্য লিঙ্গবৈষম্যকে মান্যতা দিয়ে বাকি সব কিছু সম্ভব তো? রাজনীতির একটা দিক তো সামাজিক, সেখানে চূড়ান্ত অস্থিরতা থাকলে অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব তো ? আর তাকে উন্নয়ন বলে তো? যদি সবের উত্তর নেতিবাচক হয় তা হলে আমেরিকাকে তার শতাব্দী -প্রাচীন পদ্ধতির সংস্কারের কথা ভাবতে হবে, নইলে আগামী প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে পারবে তো? সুপ্রসিদ্ধ গণতন্ত্রকেই তার উত্তর খুঁজতে হবে, বিশ্ব দেখছে৷

আর্য ভট্টাচার্য: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ