স্ত্রী মেলানিয়াকে নিয়ে ট্রাম্পকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ
সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো দেশে নেতা নির্বাচিত হলে পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। খুব ঘনিষ্ঠ কেউ হলে টেলিফোনেও কথা বলেন। এটাই রীতি। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও অভিনন্দনবার্তা পাঠান। অধিকাংশ সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাই এ কাজটি করে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ কেউ মারা গেলেও তাঁদের বার্তা ওভাবেই পাঠানো হয় বা প্রেসে জানানো হয়। সাধারণত এসব বার্তা প্রথাগতই বা গৎবাঁধাই হয়ে থাকে, কখনো ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম ঘটে। তাতে যোগ হয় অপ্রথাগত কিছু কথা। সেটা বিরল ব্যতিক্রম।
ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর মুহূর্ত দেরি না করে আমাদের সরকার ও বিরোধী দল থেকে অভিনন্দন জানানোর তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। স্তাবকতা বা চামচামি যে আমরা শুধু দেশের মধ্যেই করি তা নয়, তা ছড়িয়ে দিয়েছি বিশ্বব্যাপী। কোনো নির্বাচনে দশমিক শূন্য শূন্য এক (.০০১) শতাংশ ভোট পান না এমন নেতাও ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বার্তায় ট্রাম্পকে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁর বার্তায় বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ই আপনার অনন্যসাধারণ নেতৃত্বগুণ এবং আমেরিকার জনগণ ও বিশ্বমানবতার সেবা করার যোগ্যতার প্রমাণ।’ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বশান্তি ও মানবজাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন’ এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
যেসব কর্মকর্তা নেতাদের বাণী রচনা করেন, তাঁদের শব্দচয়নে সতর্ক হতে হয়। কোনো কিছুই মানুষের চোখ এড়ায় না। বাংলাদেশের নেতাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসামূলক বার্তা বাইরের দুনিয়ার মানুষের চোখে পড়েছে। সস্ত্রীক ট্রাম্পকে বাংলাদেশে দাওয়াত দেওয়ার কথাটিও। ব্রিটেনের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট‘মহামান্য’ ট্রাম্পের বিজয়ে বিশ্বের চতুর্থ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিনন্দনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, ‘মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রশংসাপূর্ণ বার্তায় আমেরিকার জনগণ ও বিশ্বমানবতার সেবায় তাঁর অনন্যসাধারণ নেতৃত্বের তারিফ করেছেন।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে থাকলেও তা তাঁকে বাংলাদেশের অভিনন্দন জানাতে বাধা হয়নি। অতি দ্রুত পাঠানো বার্তায় মুসলমানবিদ্বেষ নিয়ে ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য প্রসঙ্গেও কিছু ছিল না। ব্রিটিশ দৈনিকটি কিছু পুরোনো প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছে।
নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর কাজকর্ম ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা সফরে আসবেন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে, সে আশা যদি না–ও করি, তাহলেও বলতে হয়, ওই আমন্ত্রণ তিনি একটু থিতু হয়ে বসলে করলেই ভালো হতো। এখন তিনি আছেন টালমাটাল অবস্থার মধ্যে। আরব বসন্ত নয়, আমেরিকা বসন্তের শুরু কেবল। তাঁকে নিয়ে উত্তাল তাঁর নিজের দেশ। রাস্তায় কালো ও মুসলমান নয়, সাদাই বেশি।
ট্রাম্পের বিজয়ে বিশ্বের চতুর্থ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিনন্দনের বিষয়ে ইনডিপেনডেন্ট বলেছে, ‘মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রশংসাপূর্ণ বার্তায় আমেরিকার জনগণ ও বিশ্বমানবতার সেবায় তাঁর অনন্যসাধারণ নেতৃত্বের তারিফ করেছেন।’ ব্রিটিশ দৈনিকটি কিছু পুরোনো প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছে।
আমাদের কর্মকর্তাদের রচিত অভিনন্দনবার্তা শুধু নয়, ১৪-দলীয় বিশ্লেষকদের ট্রাম্পের বিজয়ে আনন্দের অন্ত নেই। ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের ‘মৌলবাদবিরোধী’ সরকারের জন্য আশীর্বাদ। তাঁর জয়কে ‘স্বাগত’ জানিয়ে এক সরকারপন্থী বিশ্লেষক বলেছেন, ‘এ রায় জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে। বিশ্বের প্রত্যাশা থেকে নিজেদের পৃথক করে এ রায়ে আমেরিকার জনগণের প্রত্যাশাকে বড় করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করবেন ট্রাম্প। জঙ্গিবাদ সম্পর্কে দুই দেশের অভিন্ন নীতি স্বভাবতই ট্রাম্প প্রশাসনকে বাংলাদেশের কাছে নিয়ে আসবে।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর]
এই মন্তব্য যখন ঢাকার ছাপাখানায় মধ্যরাতে ছাপা হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দিনের বেলা আমেরিকার রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে। ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ ঘোষণা করেছেন স্বাধীনতার, যে ক্যালিফোর্নিয়াকে মেক্সিকো থেকে যুদ্ধ করে ১৮৪০-এর দশকে আমেরিকা দখল করে নেয়। পৃথিবীর বহু দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বাধীন হতে দুই হাত উজাড় করে সাহায্য দেয় আমেরিকা। এখন ট্রাম্প কী করবেন? একদিকে মুসলিম অভিবাসীদের বিতাড়িত করবেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৪-দলীয় মহাজোটের সরকারের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ পাতবেন।
বাংলাদেশ সরকারের পাশে ভারত ও রাশিয়া ছিল। তাদের সঙ্গে গত মাসে এসে যোগ দিয়েছে বন্ধু চীন তার অর্থভান্ডার নিয়ে। আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে কাছে টেনে নেবে ট্রাম্পের আমেরিকা। একই সঙ্গে চীন ও আমেরিকা কোনো দেশের পাশে থাকলে তার পাশে অন্য কোনো দেশের না থাকলেও কুচ পরোয়া নেই।
ঘটনাক্রমে বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রবল প্রগতিশীল কেউ এ সত্য অস্বীকার করতে পারবে না। মুসলমান আর মৌলবাদী মুসলমান এক জিনিস নয়, যেমন ভাত আর পচা ভাত এক নয়। নীতিনির্ধারকদের সমীকরণ এ রকম: বাংলাদেশ ইসলামি জঙ্গিতে ভরে গেছে, তাদের দমনে সরকার কঠোর, তাই মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্পের সহানুভূতি পাওয়া যাবে। এই হিসাবনিকাশ হবে সবচেয়ে বড় ভুল।
৩০ লাখ অভিবাসীকে ট্রাম্প বিতাড়িত করবেন। তাঁদের মধ্যে হাজার হাজার বাঙালিও থাকতে পারেন। তাঁরা আমেরিকায় হাওয়া খাচ্ছেন না। সেখানকার অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। অভিবাসী তাড়ানো প্রভৃতি নিয়ে বহু দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর শুধু আমেরিকার জন্য নয়, তা তাঁর পশ্চিিম মিত্রদেশের জন্য বিপজ্জনক, সে কথা জার্মান অর্থমন্ত্রী ভলফগ্যাঙ শায়েবুল বলেছেন: ‘হিজ ডেমাগগিক পপুলিজম ইজ নট অনলি আ প্রবলেম ইন আমেরিকা, এল্সহোয়ার ইন দ্য ওয়েস্ট, টু।’ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ট্রাম্পকে পাঠানো বাণীতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি কাজ করতে চান ‘অন দ্য বেসিস অব শেয়ার্ড ভ্যালুজ’—মূল্যবোধের ভিত্তিতে। সে মূল্যবোধগুলোর নামও তিনি উল্লেখ করেন তাঁর বার্তায়। তা হলো—গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং গোত্র, ধর্ম ও লিঙ্গের সমঅধিকার। জার্মান টেলিভিশন জেডএফডি এক জরিপে বলেছে, ৮২ শতাংশ জার্মান মনে করেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া পৃথিবীর জন্য শুধু খারাপ নয়, অতি খারাপ—নট অনলি ব্যাড, ভেরি ব্যাড ফর ওয়ার্ল্ড।
শপথ গ্রহণের আগেই তাঁর অভিশংসনের দাবি উঠেছে। তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেও তাঁর দেশবাসী এখন তাঁকে চাইছে না। নজিরবিহীন আন্দোলন। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রক্ষা করাই কঠিন। তবে বাংলাদেশই রোল মডেল, পৃথিবীকে পথ দেখায়। খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনে যেমন বালুভর্তি ট্রাক রাখা হয়েছিল, সেই বালুবোঝাই ট্রাক দিয়ে ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ বিক্ষুব্ধ জনতার রোষ থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। আমরা তাঁর মঙ্গল কামনা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
প্রথম আলো’র সৌজন্যে (সংক্ষেপিত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন