বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬

নবীন প্রজন্ম তাদের ইতিহাস ফিরে দেখুক  

ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার বীজ পোঁতা হয়েছিল এখন থেকে প্রায় সাত দশকেরও আগে

একটি প্রেমের গল্প৷ ‘অ্যান ইজরায়েলি লাভ স্টোরি’ ছবির প্রধান চরিত্রে আদি বিয়েস্কি


শান্তির জন্য অতীতের অনুসন্ধান জরুরি৷ জানালেন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম জুরি, চিত্র পরিচালক ড্যান উলম্যানের সাক্ষাৎকার। কলকাতার এই সময় পত্রিকার পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শতরূপা বসু

আপনার ছবি ‘অ্যান ইজরায়েলি লাভ স্টোরি’ এ বার দেখানো হল৷ এটির প্রেক্ষিত ১৯৪৭৷ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের মধ্যে একটি প্রেমের কাহিনি৷

ড্যান উলম্যান: বছর দেড়েক আগে আমারই দেশের, ইজরায়েলের ৮৬-বছর বয়সী অভিনেত্রী নিনা গ্যারি (Pnina Gary) আমাকে ফোন করেন৷ আমার ‘ভ্যালু অফ স্ট্রেন্থ’ ছবিটি দেখেন এবং মনে করেন আমি কম বাজেটে ভালো ছবি বানাতে পারি৷ দুর্ভাগ্যবশত, এটাই আমার স্পেশালাইজেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে --- কম বাজেটে ছবি বানানো! গল্পটা ওঁর নিজের জীবনের ওপর আধারিত৷ যা নিয়ে নিনা আগে একটি বই ও নাটক লেখেন৷ নাটকটির ৬০০টি শো হয়৷ আমার ছবির অভিনেত্রী নিনার নাটকেরই অভিনেত্রী--- আদি বেইস্কি৷ এক তরুণ-তরুণীর গল্প যারা অস্থির সময়ে প্রেমে পড়ে৷ যখন ইজরায়েল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে (১৯১৭ -১৯৪৮ ) ছিল৷ ভারতের মতোই৷ ইহুদি এবং আরব উদ্বাস্ত্তদের সঙ্গে সংঘাতের সময়৷ যা আজ প্যালেস্টাইন৷ ইহুদি উদ্বাস্ত্তরা কিবুথ -এ (কমিউন ) থাকত৷ এখনও প্রায় ৫০০ মতো কমিউন আছে ইজরায়েলে৷ ছবিতে যুবকটি এ রকম একটা কমিউনে থাকে৷ এক তরুণী তার প্রেমে পড়ে৷ যুবক বলে, তার সঙ্গে থাকতে গেলে কমিউনেই থাকতে হবে৷ মেয়েটির তা পছন্দ হয় না৷ কারণ, সব কিছু --- পোশাক থেকে শুরু করে ছোট্ট উপহারও, যেমন রেডিয়ো --- সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে৷ মেয়েটির স্বপ্ন সে অভিনেত্রী হবে (যা পরে নিনা হন)৷ সে কমিউনে থিয়েটার করতে চায়৷ কিন্তু পারে না৷ কারণ সবার সমস্ত এনার্জি কমিউনেই দেওয়া উচিত বলে গণ্য হয়৷ বেসামাল পরিস্থিতির জন্য তারা ঠিক করে, তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে৷ যুবকটি এক প্রতিপত্তিশালী ইজরায়েলি ভদ্রলোকের ছেলে৷ যিনি পরে ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি হন৷ ২৫ বছরের সেই যুবক নিহত হয় আরব উদ্বাস্ত্তদের হাতে৷ এই ছবি

২০১৬ -তে বানালেন কেন?

আমার ছবিতে বয়স্ক চরিত্ররা বারবার আসে৷ আমার মনে হয়েছে, এটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গল্প৷ কারণ, এর মূলে আছে শান্তির বার্তা৷ যা আজ হানাহানির পৃথিবীতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়৷ গল্পে যেটা স্পেশ্যাল, সেটা হল এক নারী তার পছন্দের পুরুষকে পেতে চায়, পুরুষটি তাকে পাত্তা না দেওয়া সত্ত্বেও, বিব্রত হয়েও সে তাকে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ একটা মাধুর্য আছে ব্যাপারটায়৷ সাধারণত দেখা যায়, একটি পুরুষ একটি নারীকে পছন্দ করে সব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তাকে পেতে চায়৷ এ ধরনের ছবি বানানোটা প্রয়োজন কারণ, এখনকার প্রজন্ম (আমার মনে হয় আমি যখন ছোট ছিলাম তখনও এমনই হত) ইতিহাসের ব্যাপারে খুব উদাসীন৷ এটা ভারতের ক্ষেত্রেও সত্যি --- আমি কথা বললে টের পাই৷ এমনকি ৬০ বা ১০০ বছর আগের কোনও ইতিহাসের ঘটনা এরা জানে না --- সে রাজনৈতিক ঘটনা বা সিনেমা , যাই হোক না কেন৷ একজন প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে আমার একটা নির্দিষ্ট সময়ের স্পিরিট খুব গুরুত্বপূর্ণ --- সে পোশাক বা সংস্কৃতি --- যাই হোক না কেন৷ বিশেষ করে আমার দেশের কথা যদি ধরা যায়৷ একটা আদর্শবাদী স্ট্রাগলের মধ্যে দিয়ে আমরা গিয়েছি৷ তখন ইহুদিদের নিয়ে উত্তাল ইউরোপ৷ হাজার হাজার ইহুদি ইউরোপ ছেড়ে শান্তি আর স্থিতির জন্য ইজরায়েল চলে আসছেন৷ কিন্ত্ত সেখানেও ধীরে ধীরে আগুন ধরে যাচ্ছে৷ আমার মনে হয় সেই সময়টা সামনে আনাটা খুব জরুরি৷ কারণ আজকের অনেক সমস্যার বীজ এই সময়ে পোঁতা হয়েছিল৷

আপনার জন্ম ১৯৪১-এ৷ এক জন ইহুদি হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ পড়েনি আপনার ওপর?

আমার মায়ের জন্ম জার্মানিতে৷ দিদিমা ছিলেন ইহুদি, দাদু ক্রিশ্চিয়ান৷ মিক্সড কাপল্-এর ছেলেমেয়েদের পক্ষে খুব খারাপ সময় সেটা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা তাদের বারণ ছিল৷ আমার মামা, মাসিদের কনসেনট্রশন ক্যাম্পে চলে যেতে হয়৷ মা ইতালি চলে যান৷ বাবা এসেছিলেন পোল্যান্ড থেকে৷ তেমনই কাকাদেরও ক্যাম্পে চলে যেতে হয়৷ বাবা প্যালেস্তাইনের মানুষ৷ ডাক্তারি পড়েন ইতালিতে৷ তারপর মাকে প্যালেস্তাইন নিয়ে আসেন৷ তাই আমার উপর সরাসরি আঁচ এসে পড়েনি৷

তাও কেমন দেখেছেন সময়টা?

ছোটবেলার কিছু যুদ্ধের স্মৃতি মনে আছে৷ ১৯৪৮ -এর কথা৷ আমরা জেরুজালেমের যে জায়গাটায় থাকতাম তার উল্টো দিকে একটা দেওয়ালে আরব স্নাইপাররা ঘাপটি মেরে থাকত৷ তাই আমাদের বাইরে যাওয়া বারণ ছিল৷ আমাদের খেলার জায়গা ছিল বাড়ির পেছনে৷ মনে আছে , একবার আমাদের বাড়িতে বোমা পড়ে৷ পাশের বাড়ির একটি মহিলা গুরুতর আহত হয়েছিলেন৷ আমরা বাচ্চারা বুলেট, বোমার খোলা জমিয়েছিলাম ! বাবা বলতেন, সব আরবরা খারাপ নন৷ ভালো-খারাপ --- দুই -ই আছে৷ সেই শিক্ষায় বড় হয়েছি৷ আমাদের পাশের বাড়িতে এক আরব পরিবার থাকতেন৷ যখন জেরুজালেম আরবরা ‘সিজ’ করে, খাবার-দাবার কিচ্ছু নেই, তখন সেই পরিবারই আমাদের বাইরে থেকে খাবার এনে বাঁচিয়েছিলেন৷ এটাকেই বলে মনুষ্যত্ব৷ আমাদের বাড়িতে ইহুদিদের অস্ত্র লুকোনো থাকত৷ ব্রিটিশরা তল্লাশি চালাত অস্ত্রের জন্য৷ মাঝরাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেত৷ দেখতাম প্রচুর লোক আসছে৷ তারা আমাদের বাড়িতে রাতটা ঘুমিয়ে ভোরে চলে যেত৷শিশুর চোখ তার বেশি কিছু ঠাহর করতে পারত না৷ এই মনুষ্যত্বই বোধ হয় আমার ছবিতে ফিরে আসে৷

আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প জেতার পর আপনার দেশের পরিস্থিতি কেমন?

আজ পরিস্থিতি একেবারে অন্য রকম৷ যদিও সৌভাগ্যবশত আমরা এখনও গণতন্ত্রে থাকি৷ যার এক -চতুর্থাংশ জনসংখ্যা আরব৷ তবে আশপাশের দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ভালো হওয়া উচিত৷ বিচক্ষণ প্যালেস্তিনিয় আর আরব নেতাদের একসঙ্গে বসা উচিত খারাপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে৷ আমেরিকার প্রসঙ্গে বলি, সেখানে নানা পেশায় বিরাট ইহুদি জনসংখ্যা যুক্ত আছেন৷ তাই হিলারি আর ট্রাম্প --- দু’পক্ষই তাদের নিজের দলে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন৷ নানা রকম ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন৷ আমার ধারণা, আমেরিকায় থাকা বিশাল সংখ্যার ভারতীয়দেরও তাঁরা একই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন৷ তবে আমার মনে হয় ভোটের পরে ট্রাম্প হয়তো বদলাবেন৷ হয়তো তিনি আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য হবেন, বিচক্ষণ মানুষদের সান্নিধ্যে নিজেকে রাখবেন৷ হয়তো রিয়্যালিটি শো-টা বন্ধ হবে! নিজেকে আরেকটু ভদ্র-সভ্য করবেন৷ আশা করছি!

আপনার ছবি দেখতে দেখতে মার্কেজ-এর ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ মনে পড়ল৷ সংঘাতের থেকে প্রেমকে গুরুত্ব দিলেন কেন?

সরল, সোজাসাপটা গল্প নিয়ে তো ভালো কাহিনি হয় না৷ যখন সব ওলটপালট হয়ে যায়, তখনই তো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হয়৷ আরেকটা কারণ, আমি আশাবাদী৷ আমার সন্তান আছে, নাতি-নাতনি আছে৷ তাদের ভবিষ্যত্ কী ? যদি বলি আমার দেশটা খারাপ, তা হলে ওদের অন্য ভালো জাগায় চলে যেতে বলতে হয়৷ যেখানে যুদ্ধ, সংঘাত নেই৷ আমার সন্তানরা ফৌজি৷ কিন্ত্ত আমি চাই না আমার নাতিরা আর্মিতে যাক৷ যদি তারা দেশ ছাড়তে চায় তাহলে অবশ্য আমার আশীর্বাদ তাদের সঙ্গে থাকবে৷ আমার শিকড় আমার দেশের মাটিতে আষ্টেপৃষ্ঠে গাঁথা৷ পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসতে কি যে ভালো লাগে ! তাই এক আত্মম্ভরী দাদু হিসেবে আমি চাই আমার নাতিরা আমার দেশেই বড় হোক৷ আমরা এই মুহূর্তে খুব খারাপ সময় আছি৷ ইরান সারাক্ষণ শাসাচ্ছে যে ইজরায়েলকে তারা শেষ করে দেবে৷ চারদিকে আরও বহু শত্রু৷ কিন্ত্ত আমার ইজরায়েল খুব সুন্দর দেশ৷ জনসংখ্যা কম হলেও এখানকার মানুষের নানারকম এক্সাইটিং আইডিয়া আছে৷ দারুণ ঔপন্যাসিক, কবিরা এখানে থাকেন৷

ভারতীয় ছবির সম্বন্ধে আপনার ধারণা? 

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ আমেরিকায় ১৯৬২-তে সিনেমার ছাত্র থাকাকালীন মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট-এ ‘অপু ট্রিলজি’ দেখেছিলাম৷ নাড়িয়ে দিয়েছিল ছবিগুলো৷ তারপর ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’ দেখি৷ তারপর আবার ১৯৭৪ -এ দেখা হয়েছিল ‘সোনার কেল্লা’র সময়৷ খুব লাজুক ছিলাম৷ তারপর এ রকম লম্বা , সুঠাম চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম৷ এগিয়ে গিয়ে বেশি কথা বলতে পারিনি৷ ওঁর হাত ধরে সম্বোধন করতে গিয়ে টেনশনে আমার হাত ঘেমে একসা! ভারতীয় ছবির দৃশ্যে মাইক্রোফোন দেখা যায় --- সেটা ওঁকে বলাতে, উনি বলেন, ‘এটা তো আমাদের ছবিতে হামেশাই হয়’! কিছুদিন আগে দিল্লির ওশিয়ান উৎসবে হঠাত্ই আমার একটা ছবি সিলেকটেড হয়৷ মিডিয়া সেটা নিয়ে খুব ভালো লেখে৷ শশি কাপুরের সঙ্গে আলাপ হয়৷ উনি বলেন, আমার ছবির সেন্স অফ হিউমার খুব পছন্দ ওঁর৷ তারপরই সারা ভারত ঘুরি ছবি নিয়ে৷ ইফি -তে জুরি হই৷ কলকাতায়ও এ বার জুরি৷ এ ছাড়া শ্যাম বেনেগল, আদুর গোপালকৃষ্ণন -এর ছবি তো দেখেইছি৷


ড্যান উলম্যান: আমাদের পাশের বাড়িতে এক আরব পরিবার থাকতেন৷ যখন জেরুজালেম আরবরা ‘সিজ’ করে, খাবার-দাবার কিচ্ছু নেই, তখন সেই পরিবারই আমাদের বাইরে থেকে খাবার এনে বাঁচিয়েছিলেন৷ এটাকেই বলে মনুষ্যত্ব৷





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন