ট্রাম্পের থেকে ৬৩০৮৭৭টি বেশি ‘পপুলার ভোট’ পেয়েও হিলারি পরাজিত
আর্য ভট্টাচার্য
ট্রাম্প এখন আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতার ও দায়িত্বের হস্তান্তর চলছে, আরও বেশ কিছু দিন বাদে উনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে শুরু করবেন৷ এই নির্বাচনের ফলাফল অনেককে স্তম্ভিত করেছে, আমাকেও৷ নির্বাচনের দিন সকালে একটি ওয়েবসাইটে বিশেষজ্ঞের মতন লিখেছিলাম যে হিলারি জিতবে তার সম্ভাবনা একশো শতাংশ, এখন ব্যবধান কত হবে সেটাই দেখার৷ আমি ভুল প্রমাণিত হয়েছি৷ কারণ সবাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে, দু-একজন বাদে যারা বলেছিল ট্রাম্প জিতবে৷ এমনকী খবরের কাগজে পড়লাম যে ট্রাম্পের নিজের যে পোল --- সমস্ত নির্বাচনী ক্যাম্পেইনেরই নিজস্ব পোল থাকে --- সেটাও নাকি বলেছিল ট্রাম্প হারবে৷
জীবন ও জীবিকার তাগিদে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকি, আর জাতে বাঙালি, তাই নির্বাচনী উত্তেজনার আঁচ আমাকে স্পর্শ করবেই৷ এই নিয়ে এ দেশে আমার তৃতীয় নির্বাচন যা আমি খুব কাছ থেকে লক্ষ করলাম৷ এ বারের নির্বাচন আমার কাছে খুব ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যদিও আমি নিজে ভোট দিতে পারি না৷ যে দেশে আমার সন্তানেরা জন্মগ্রহণ করেছে সে দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে তাই নিয়ে আগ্রহ আছে৷ আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট-এর বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও রেটোরিক এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁর কিছু কিছু ঘটনা যা সামনে এসেছে তাতে ক্রমশ এই নির্বাচন আমার কাছে ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে৷ যে ব্যক্তি জাত ও বর্ণ দিয়ে সারা দেশকে ভাগ করেন, যে ব্যক্তি নারীদের অসম্মান করেন এবং তা প্রকাশ্যে এলে বলেন ও তো ছেলেদের কথা (locker room talk), সেই ব্যক্তি আমি যে দেশে দীর্ঘদিন ধরে ট্যাক্স দিই তার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না৷ কিন্তু আমরা জানি যে গণতন্ত্রে এমনটা হতেই পারে, তাকে মেনে নেওয়াই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা৷ কিন্তু আর একটি দিকও আছে, ভেবে দেখা যে কেন এমন হল৷ সত্যিই কি গরিষ্ঠসংখ্যক আমেরিকার নাগরিক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার অনুযায়ী মুসলমানদের দেশে ঢুকতে না দেওয়া, মেক্সিকোর সীমান্তে প্রাচীর তৈরি, গর্ভপাত করলে শাস্তি দেওয়া বা অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপের সপক্ষে ভোট দিল?
‘ইলেকটোরাল কলেজ’ নিয়মের আবির্ভাব দাসপ্রথার সময়৷ প্রতিটি রাজ্যে ভোটাররা সেই রাজ্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যাদের ‘ইলেকটর’ বলা হয়৷ কোন রাজ্যে কতজন ‘ইলেকটর’ থাকবে তা আগে থেকে নির্ধারিত কনস্টিটিউশনে৷ যে রাজ্যে ভোটাররা যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বেশি ভোট দেয় সেই রাজ্যের সমস্ত ‘ইলেকটর’ সেই প্রার্থীর৷
সেই আলোচনায় বিশদে যাবার আগে ছোট্টো করে বলে নিই যে ঠিক কী করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়৷ নির্বাচনে প্রতিটি রাজ্যে ভোটাররা সেই রাজ্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করে যাদের ‘ইলেকটর’ বলা হয়৷ আসলে তারাই শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে৷ সাধারণ জনগণ নির্বাচনের দিন কে প্রেসিডেন্ট হবেন সেই ভোটে ভোট দেয়, কিন্তু শেষে ‘ইলেকটর’রা ভোট দিয়ে পাকাপাকি ভাবে ঠিক করে কে প্রেসিডেন্ট হবেন৷ যেমন এ বারের ‘ইলেকটর’রা ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে ভোট দেবেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য৷ প্রতি রাজ্যেই প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যারা লড়ছে তারা নিজেদের ‘ইলেকটর’ ঠিক করে৷ কোন রাজ্যে কতজন ‘ইলেকটর’ থাকবে তা আগে থেকে নির্ধারিত আমেরিকার কনস্টিটিউশনে৷ যে রাজ্যে ভোটাররা যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বেশি ভোট দেয় সেই রাজ্যের সমস্ত ‘ইলেকটর’ সেই প্রার্থীর৷ তারা পরে অবশ্যই নিজের প্রার্থীকে নির্বাচন করে৷ ‘টেকনিকালি’ ট্রাম্পের ‘ইলেকটর’ হিলারিকে শেষে ভোট দিতে পারে, কিন্তু এমন হয় না৷ মেইন ও নেব্রাস্কায় একটু নিয়মটা আলাদা, সেখানে প্রতিটি কংগ্রসেনাল ডিস্ট্রিক্ট একটি করে ‘ইলেকটোরাল’ ভোট এবং বাকি দু’টি সমস্ত রাজ্যে যে বেশি ভোট পেয়েছে তার দিকে যায়৷ উদাহরণ নিলে, ক্যালিফোর্নিয়ায় সব মিলিয়ে ৫৫ টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পূর্বনির্ধারিত কনস্টিটিউশন অনুযায়ী৷ হিলারিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় বেশি মানুষ ভোট দিয়েছে৷ অতএব, সব ক’টি ইলেকটোরাল ভোট হিলারির পক্ষে গেল৷ সাধারণ জনগণ নির্বাচনের দিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য যে ভোট দিয়েছেন তা ওই ‘ইলেকটর’ ঠিক করার জন্য লাগে, পরে তার আর কোনও গুরুত্ব নেই৷ এই ভোটকে বলে ‘পপুলার ভোট’৷ হয়তো অনেকেরই জানা, কিন্তু এই ব্যাখ্যাটা জরুরি আমার লেখার পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য৷ এবারের ভোটের হিসেব অনুসারে (এই প্রতিবেদন লেখার সময় অবধি, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের হিসেব ) ইলেকটোরাল কলেজের ২২৮টি ভোট পেয়েছেন হিলারি, ট্রাম্প পেয়েছেন ২৯০টি ভোট৷ পপুলার ভোটের মধ্যে হিলারি পেয়েছেন ৬০, ৯৮১,১১৮ এবং ট্রাম্প ৬০,৩৫০,২৪১৷ হ্যাঁ, হিলারি ‘পপুলার ভোটে’ ৬৩০,৮৭৭ ভোট বেশি পেয়েছেন৷ অর্থাৎ শুধুমাত্র যদি জনগণের ভোটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হত তা হলে হিলারি আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হতেন৷ এ রকম কী করে সম্ভব হল? উত্তর হল ‘ইলেকটোরাল কলেজ ভোট’৷
২৭০-এর বেশি ‘ইলেকটোরাল কলেজ ভোট’ পেয়েছেন ট্রাম্প, আর আমেরিকার ‘কনস্টিটিউশন’ অনুযায়ী সেটাই নির্ধারিত করে কে প্রেসিডেন্ট হবেন৷ তা হলে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ আমেরিকান না চাইলেও শুধুমাত্র ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোটের হিসেব কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সম্ভব৷ আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবার নয়, সাম্প্রতিক অতীতে অ্যাল গোর, জর্জ বুশ জুনিয়রের কাছে ২০০০ সালে ঠিক এই ভাবেই পরাজিত হয়েছিলেন৷ আমেরিকার জনগণ অ্যাল গোর -এর পক্ষে ভোট দিলেও ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোটের হিসেবে গোর পরাজিত হয়েছিলেন৷ কিছুদিন আগে যখন ভোটের বাজার উত্তন্ত, এই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোটের ইতিহাস নিয়ে একখানি প্রবন্ধ পড়েছিলাম৷ লিখেছেন ইয়েল ল স্কুল-এর অধ্যাপক অখিল রিড আমর, পড়ান কনস্টিটিউশন ল৷ এই প্রবন্ধে অখিল দেখিয়েছেন এই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোটের ইতিহাস কী, কেন তা এখন কাজ করে না৷ এই লেখার পরবর্তী অধ্যায় অনেকাংশে সেই লেখাটির কাছে ঋণী৷ ইতিহাসআমেরিকার ‘কনস্টিটিউশন’-এ ১২তম অ্যামেন্ডমেন্টে লেখা আছে কী ভাবে দেশের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস -প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে৷ ১৮০৩ সনে এই অ্যামেন্ডমেন্ট প্রথাগত ভাবে সই সাবুদ করে ‘কনস্টিটিউশন’-এ জায়গা পায়৷ আর তখন থেকেই এই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’-এর ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়৷
কী কারণে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়? প্রচলিত যে কারণ পাঠ্যবইতে পড়ানো হয় এবং লোকে মেনে নেয় তা হল : এক, বড়ো ও ছোটো রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার সাম্য আনতে৷ যে রাজ্যে বেশি লোক থাকে তারা যাতে বেশি প্রাধান্য না পায়৷ দুই, সাধারণ জনগণের কাছে তথ্য বেশি থাকত না, তাই তারা জানতে পারত না যে অন্য কোনও রাজ্যের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তাদের জন্য বেশি উপযোগী কি না৷ অখিলের মতে এই সাধারণগ্রাহ্য কারণগুলোর মাঝে যা ঢাকা পড়ে যায়, তা হল আমেরিকার তৎকালীন কালো ইতিহাস---দাসপ্রথা৷ ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার সভায় জেমস উইলসন যখন সমস্ত জনগণের দ্বারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তাব আনেন তখন ভার্জিনিয়া রাজ্যের প্রতিনিধি জেমস ম্যাডিসন তার তীব্র প্রতিবাদ করেন ও বলেন দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জন্য এই প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য নয় ---‘The right of suffrage was much more diffusive [i.e., extensive]
in the Northern than the Southern States; and the latter could have no
influence in the election on the score of the Negroes.’ যদি সরাসরি নির্বাচন হত তা হলে দক্ষিণের রাজ্যের দাসরা ভোট দিতে পারত না, আর তাতে উত্তরের রাজ্যগুলোর সুবিধা হত৷ এই সভাতেই ম্যাডিসন ‘ইলেকটোরাল কলেজ’-এর প্রথম প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তী কালে তাই কার্যকরী হয়৷
কনস্টিটিউশন-এর প্রথম ছত্রিশ বছরের মধ্যে বত্রিশ বছর ভার্জিনিয়ার প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়৷ বর্তমান তা হলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতির দরকার কতটা? ইন্টারনেটের যুগে এখন সমস্ত তথ্য সবার কাছে চোখের পলকে পৌঁছে যায় অতএব, ‘ইলেকটরস’ বেশি খবর রাখেন তা আর সত্য নয়৷ আর এখন দাসপ্রথাও নেই, তা হলে? অখিল তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন যাঁরা এই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোটের পক্ষে, তাঁরা দশটি অজুহাত দেখান৷ যার মধ্যে আছে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না দেওয়া, টেনিসের মতন খেলার ‘অ্যানালজি’ যেখানে মোট পয়েন্টে না জিতেও খেলা জেতা যায়, ছোটো ছোটো শহরের লোকেদের কথা ভাবতে বাধ্য করা, ভৌগোলিক কারণে কোন এক জায়গায় বেশি লোকজন থাকলে সেখানকার লোকেদের ভোটের ওজন যাতে বেশি না হয় সেটা খেয়াল রাখা ইত্যাদি৷ উনি সবকটা অজুহাতকেই যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন৷ মূলত উনি যা বলেছেন তা হল যদি কোনও রাজ্যের গভর্নর সেই রাজ্যের ‘পপুলার ভোট’ দিয়ে নির্বাচন করা যায় তা হলে প্রেসিডেন্টকে যাবে না কেন? টেনিসের মতন খেলায় তাত্ক্ষণিক উত্তেজনা তৈরির জন্য যে অনিশ্চয়তার দরকার তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দরকার নেই৷ অখিল যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে দেখিয়েছেন কেন আজকের যুগে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ অচল৷ মূলত তাঁর যুক্তি হল সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সরাসরি ‘ইলেকটর’ বা ‘গভর্নর’ নির্বাচনের থেকে আলাদা কিছু না৷ অন্যগুলো যদি সরাসরি নির্বাচনে সম্ভব হয় তা হলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও সম্ভব৷ গণতন্ত্রে সবার কথাই ভাবা উচিত, ‘মাইনরিটির’ স্বার্থও যাতে রক্ষিত হয় সেটা দেখা একটা দিক, অন্য দিক হল একটা সীমিত অংশ বিরাট অংশের হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা যাতে না পায় সেটাও দেখা৷ মিশিগানে হিলারি মাত্র ১১,৮৩৭ ভোটে হেরেছেন, কেন তা বড়ো হয়ে দাঁড়াবে যেখানে ক্যালিফোর্নিয়ায় উনি ২ মিলিয়নেরও বেশি ভোটে জিতছেন?
একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে ১২ জন মহিলা যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন প্রকাশ্যে, সেই প্রার্থীই তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে ছাপিয়েছেন যে মুসলিমদের দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না, যিনি জাত ও বর্ণের ভিত্তিতে সারা দেশকে ভাগ করেছেন, তিনিই আজ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট৷ অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, পরিবেশ নীতি নিয়ে হতে পারে, কিন্ত্ত বর্ণবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্যকে মান্যতা দিয়ে বাকি সব কিছু সম্ভব তো? রাজনীতির একটা দিক তো সামাজিক, সেখানে চূড়ান্ত অস্থিরতা থাকলে অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব তো ? আর তাকে উন্নয়ন বলে তো? যদি এ সবের উত্তর নেতিবাচক হয় তা হলে আমেরিকাকে তার শতাব্দী -প্রাচীন পদ্ধতির সংস্কারের কথা ভাবতে হবে, নইলে আগামী প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে পারবে তো? সুপ্রসিদ্ধ গণতন্ত্রকেই তার উত্তর খুঁজতে হবে, বিশ্ব দেখছে৷
আর্য ভট্টাচার্য: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
খোদ সংবিধানই সেখানকার জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলনকে জিম্মি করে রেখেছে ।
উত্তরমুছুন