রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬

মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীর গণহত্যাসম নৃশংসতা ও নিপীড়ন

রোহিঙ্গাদের উপর নির্মমতা ও জ্ঞানপাপীদের অগ্রাধিকার!

সৈকত রুশদী

রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপরে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী পরিচালিত গণহত্যাসম নৃশংসতা ও নিপীড়নের জন্য সেদেশের ক্ষমতার প্রধান অং সান সূ চি-কে তীব্র নিন্দা করা এবং শান্তির জন্য তাঁকে দেয়া নোবেল পুরস্কার বাতিলের জোরালো দাবিতে আমিও একমত।

কিন্তু সূ চি'র নিন্দা করতে যেয়ে অনেকে, যাঁদের অনেককে আমি বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হিসেবে জানি, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের নাগরিক অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের সাথে সূ চি'র ২১ জুলাই ২০১৪ ইয়াঙ্গনে তোলা এই (প্রথম) ছবিটির ব্যবহার এবং 'গরীবের রক্ত চোষা' ও 'সুদখোর' বলে অভিহিত করে অধ্যাপক ইউনূসেরও নিন্দা করা ও অপপ্রচারকে এক ধরণের অসাধুতা বলেই আমার মনে হয়। কেননা অধ্যাপক ইউনূস যেমন কোন সরকার বা ক্ষমতার প্রধান নন, তেমনই তাঁর কোন আচরণই রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীর নৃশংসতার সাথে তুলনীয় নয়। এ যেন অধ্যাপক ইউনূসের উপর কালিমা লেপন করে বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট করার এক অপপ্রয়াস। যেন সূ চি'র সরকারের নৃশংসতার দায় ইউনূসের উপরও বর্তায়!
 
 অথচ সূ চি'র হাতে হাত রেখে হাস্যোজ্জ্বল বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ৩ মার্চ ২০১৪ মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিতো'য় তোলা (দ্বিতীয়) ছবিটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হলেও তা' আড়ালেই রাখা হচ্ছে। যাঁরা সূ চি'র নিন্দা করছেন, রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের কেউ একবারও কী উল্লেখ করছেন যে সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের অমানবিক আচরণ বন্ধে কী ভূমিকা রাখতে পারেন এবং কেন রাখছেন না? এক সরকার প্রধান তো প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার বন্ধে সেদেশের ক্ষমতার প্রধানকে অনুরোধ করতেই পারেন। নিদেনপক্ষে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের নিজের দেশের সরকার প্রধানকে তুষ্ট করাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বরং এই মানবিক সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত নয় কী?

স্মরণ করা যেতে পারে যে, মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগেই (৬ নভেম্বর) বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনায় 'ধর্মনিরপেক্ষ' বলে সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত ভারত সরকারের পক্ষে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক টুইট বার্তায় 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে প্রতিবেশী ভারত সরকারের উদ্বেগ জানাতে তিনি ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন।

'ধর্মনিরপেক্ষ' বলে সরকার ঘোষিত কিন্তু সাংবিধানিকভাবে 'ইসলাম' রাষ্ট্রধর্মের দেশ বাংলাদেশের সরকার প্রতিবেশী মিয়ানমারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস নিপীড়নের ঘটনায় এমন কোন উদ্বেগ এবং তা' প্রকাশে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দিয়েছেন কী? যদি না দিয়ে থাকেন, তবে উদ্বেগ প্রকাশ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নিজের দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করাটাই বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন নাগরিকদের জন্য স্বাভাবিক।

উপরন্তু নৃশংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা মুসলমানরা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ সরকার তার স্থল ও জলসীমান্তে প্রহরা জোরদার করেছে। সরকারের নির্দেশে নৌকা ভর্তি অসহায় শিশু ও নারীসহ শতাধিক রোহিঙ্গাকে ঘাটে ভিড়তে না দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রে। এই পরিস্থিতিতে নিজ দেশের সরকার প্রধানের উপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে নিপীড়ক সরকারের ক্ষমতা প্রধান সূ চি'র সাথে ছবি তোলা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের চরিত্র হনন প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলে বুঝতে হবে যেকোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়নের প্রতিবাদের চেয়ে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিই এখানে প্রধান। মূল সমস্যার সমাধানের চেয়ে অন্য উদ্দেশ্য এখানে অগ্রগণ্য।

এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় সেই কৌতুককর প্রবচনের কথা। যেখানে শিক্ষার্থী কেবল গরুর রচনা পড়ে আসার কারণে পরীক্ষায় নদীর রচনা লিখতে বসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নদীর পাড়ে এক গরু উপস্থাপিত করে গরুর রচনা লেখার প্রবণতা!

টরন্টো, ২০ নভেম্বর ২০১৬

সৈকত রুশদী: কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার ভিডিও দেখুন

https://youtu.be/UrQRYrpp2cI

1 টি মন্তব্য: