শুধুমাত্র বিনোদনের জন্যই মার্কিন নির্বাচনী সমীক্ষা!
আবার ভোটের ফল দেখে ভোট-সমীক্ষকরা লজ্জায় মুখ ঢাকছেন। এ বার মার্কিন দেশে। কেন বার বার ওপিনিয়ন পোল এমন ভুল প্রমাণিত হয়? সর্ষের মধ্যেই কি ভূত?
অতনু বিশ্বাস
জর্জ গ্যালাপ কে, যাঁকে ১৯৩৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তকমা দিয়েছিল ‘পোলস্টার’? এক কথায় পরিচয়, সাধারণ মানুষের রায় কোন দিকে যাচ্ছে, নমুনা সমীক্ষার মাধ্যমে তা মাপার পদ্ধতির জনক। ১৯৪৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ডেমোক্র্যাট হ্যারি ট্রুম্যান পাবেন ৪৪ শতাংশ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান টমাস ডিউই ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হবেন। আগের তিনটি নির্বাচনের ফল প্রায় নিখুঁত মিলিয়েছিলেন গ্যালাপ, ফলে এ বার তাঁর পূর্বাভাস প্রবল গুরুত্ব পেল। এতটাই, যে ভোটের পরের দিন ফলাফল বেরোনোর আগেই ‘শিকাগো ট্রিবিউন’ তাদের প্রাথমিক সংস্করণ ছাপিয়ে ফেলে। শিরোনাম: ‘ডিউই ডিফিটস ট্রুম্যান’।
সেই কাগজ ফিরিয়ে নিতে হয়েছিল শিকাগো ট্রিবিউনকে। কারণ ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, ট্রুম্যান পেয়েছেন ৫০ শতাংশ ভোট, আর ডিউই ৪৫ শতাংশ। শিকাগো ট্রিবিউনের কপি হাতে ট্রুম্যানের ব্যঙ্গাত্মক হাসির ছবি ইতিহাস হয়ে আছে। ‘নির্বাচনী সমীক্ষা’-এর সেই মহাপরাজয়ও ইতিহাস।
ব্রিটেনেও ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৯২ ভোটে সমীক্ষা ব্যর্থ হয়। গত বছর, ২০১৫-র ভোটে কোনও বড় সমীক্ষা কনজারভেটিভদের জয় অনুমান করতে পারেনি। ব্রেক্সিট-এর ইতিহাস তো বহুচর্চিত। আবার এই সে দিন ইজরায়েলে বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর নির্বাচনও ঠিকঠাক অনুমান করতে পারেনি ওপিনিয়ন পোল। আর ভারতে? ২০০৪-এ বাজপেয়ী জিতবেন— পূর্বাভাস করেছিল প্রায় সব সমীক্ষা। ২০১৫-র দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সমস্ত জনমত সমীক্ষা। ২০১৪’তে মোদীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অনেক সমীক্ষাকে অবাক করে দিয়েছিল।
এ বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যা ঘটল, সেটা তাই নতুন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা চলে না। এ বারের নির্বাচনেও ওপিনিয়ন পোল ডাহা ফেল। অধিকাংশ প্রাক-নির্বাচনী সময়কালে সমীক্ষার পূর্বাভাসে এগিয়ে থেকেও আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না হিলারি ক্লিন্টন। ওপিনিয়ন পোল ব্যর্থ হওয়ার ঐতিহ্য সমানে চলেছে। কেন?
যদি সমস্ত ভোটারকে নিয়ে সমীক্ষা করা যেত এবং সবাই সমীক্ষায় ঠিকঠাক জবাব দিত, তা হলে সমীক্ষায় নিখুঁত পূর্বাভাস পাওয়া যেত। কিন্তু সবাইকে নিয়ে তো আর সমীক্ষা করা সম্ভব নয়। সমীক্ষা করা হয় মোট জনসংখ্যার এক ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে, যাকে বলে স্যাম্পল বা নমুনা। তাই ভুলের সম্ভাবনা থেকে যায়। নমুনার সংখ্যা খুব কমে গেলে ফলাফল ঠিক অবস্থার থেকে অনেকটাই সরে যাওয়ার সম্ভাবনা। ফলাফল ঠিক না ভুল হবে, তা কিন্তু বলা যাবে না। আমরা বলি ‘ভুলের সম্ভাবনা’ বাড়তে থাকবে।
বেশির ভাগ সমীক্ষাতেই নমুনার সংখ্যা এত কম যে ভুলের সম্ভাবনা অনেকটাই। কিন্তু, ১৯৩৬-এর ‘লিটারারি ডাইজেস্ট’-এর সমীক্ষায় নমুনার সংখ্যা ২৪ লক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ভুল হয়েছিল। আসলে, শুধু নমুনার সংখ্যাই নয়, নজর রাখতে হয় আরও অনেক দিকে। মূল জনসংখ্যায় পুরুষ-নারীর একটা অনুপাত রয়েছে। বিভিন্ন বয়সের লোকেদের অনুপাতও নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট অনুপাত বিভিন্ন পেশার লোকেদের, শহরে-গ্রামে বাস করা লোকেদের, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের। রয়েছে শিক্ষা, জাতি, ধর্ম অনুসারে শ্রেণীবিভাগ। সমীক্ষায় এ সবের অনুপাত মূল জনগোষ্ঠীর মত করে না বাছলে ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ধরা যাক, এক জন প্রার্থী তরুণ ভোটারদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। সমীক্ষার লোকেদের মধ্যে তরুণদের অনুপাত যদি মূল জনগোষ্ঠীতে তরুণদের অনুপাতের তুলনায় বেশি হয়, সমীক্ষার ফলাফল হয়তো সেই বিশেষ প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে থাকবে। বাস্তব তেমনটা না-ই হতে পারে।
অধিকাংশ সমীক্ষাতেই এত শত দেখে সমীক্ষার লোকেদের বাছা হয় না। তাই ভুলের উপরে ভুল জমে পাহাড় হতে থাকে। একে বলে ‘সিলেকশন বায়াস’। ১৯৩৬ সালের সমীক্ষার জন্য ‘লিটারারি ডাইজেস্ট’-এর সমীক্ষার ক্ষেত্রে পত্রিকা টেলিফোন থাকা লোকদের বেছেছিল, যারা আবার সেই ম্যাগাজিনের গ্রাহক। সেই সময় এমন জনগোষ্ঠীকে কোনও ভাবেই দরিদ্র বলার উপায় ছিল না। অর্থাৎ, রুজভেল্টের শক্তির জায়গাগুলো থেকে কম নমুনা টেনেছিল ‘লিটারারি ডাইজেস্ট’। নমুনায় সমাজের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব পাওয়া যায়নি। তা ছাড়াও, তাদের সমীক্ষায় চার জনের মধ্যে উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র এক জন। ভুল তো হবেই।
এ সমস্যা দূর করতে গ্যালাপ শুরু করে ‘কোটা স্যামপ্লিং’। সমীক্ষকদের ‘কোটা’ বলে দেওয়া হয়। যেমন চল্লিশ বছরের নীচে পাঁচ জন শহুরে কালো পুরুষ, চল্লিশের উপরে সাত জন সাদা গ্রামীণ মহিলা, ইত্যাদি। কিন্তু যত সূক্ষ্ম ভাবেই ‘কোটা’ ঠিক করা হোক, কিছু ভাগ বাদ যেতে বাধ্য। কাকে সমীক্ষায় নেওয়া হবে, সে বিষয়েও সমীক্ষকের চূড়ান্ত স্বাধীনতা ছিল। কোনও সমীক্ষক ইচ্ছে করলে একটা সন্ধ্যায় কোনও পাবে গিয়ে কুড়ি জনকে সমীক্ষায় নিতে পারে। ফলে আসতে পারে এক অদ্ভুত ‘বায়াস’। ট্রুম্যান-ডিউই’র লড়াইয়ের জল মাপতে গ্যালাপ এই ভুলটাই করেছিল।
এর পর আসে, নমুনা কী ভাবে বাছা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন। বাছাইয়ের প্রক্রিয়া হওয়া উচিত ‘র্যান্ডম’, বা যদৃচ্ছ । ধরা যাক কোনও একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী, যেমন একটি শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, তরুণীর সংখ্যা দশ হাজার। এদের মধ্য থেকে দু’শো জনকে বাছতে হবে। নমুনায় নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা এই ১০,০০০ জনের প্রত্যেকের সমান হতেই হবে। না হলেই আবার ভুল হয়ে যেতে পারে।
আবার, কাকে ভোট দেবেন, সে প্রশ্নের উত্তরে কেউ সত্যি কথা নাও বলতে পারে। সমীক্ষা আর নির্বাচনের মধ্যের সময়ে অনেকের আবার মত পাল্টে যায়। বিশেষ করে, কোনও বড় ঘটনার অভিঘাতে।
নানা ভুল জমে জমে সাধারণ সমীক্ষাগুলোয় ‘ভুলের সম্ভাবনা’ বেশ ভালই হওয়ার কথা— পাঁচ-সাত শতাংশ বা তার বেশি। এই ‘ভুলের সম্ভাবনা’টাও অঙ্ক করে বের করা যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমীক্ষকরা এই অঙ্কগুলো আর কষে উঠতে পারেন না। আর, মানুষকে এই ‘ভুলের সম্ভাবনা’ বোঝানো ভীষণ কঠিন।
ধরা যাক কোন সমীক্ষায় ‘ভুলের সম্ভাবনা’ ছয় শতাংশ। আর জনমতে দুই প্রার্থীর শতাংশের পার্থক্য দুই কি তিন শতাংশ। সে ক্ষেত্রে কোন প্রার্থী এগিয়ে রয়েছে, সেটা বলাও জনসাধারণকে ভুল অভিমুখে চালনা করা। এ সব ক্ষেত্রে পূর্বাভাস যেন একটা প্রায়-নিরপেক্ষ কয়েন নিয়ে টস করা— হেড বা টেল পড়ার সম্ভাবনা প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। এ সব ক্ষেত্রে অন্তত দশ শতাংশের কম পার্থক্যে পূর্বাভাস না করাই ভাল। ট্রাম্প-ক্লিন্টন লড়াইয়ে ওপিনিয়ন পোলগুলো ছিল এমনই। হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনে জনমত হল শরতের আকাশের মতো। আর সংখ্যাতত্ত্বকে ঠিকমত ব্যবহার করতে না পারলে তা ডাহা মিথ্যেকেও ছাপিয়ে ওঠে।
নির্বাচনী সমীক্ষা বেশ ভালই। মুচমুচে। কিন্তু অধিকাংশ সমীক্ষা যে ভাবে করা হয় এবং তা থেকে যেমন আলপটকা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা বিপজ্জনক। তাই সবচেয়ে ভাল হয় যদি এর সঙ্গে দেওয়া থাকে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: ‘এটা কেবলমাত্র বিশুদ্ধ বিনোদনের জন্যে’।
অতনু বিশ্বাস: কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট-এ সংখ্যাতত্ত্বের শিক্ষক
বাস্তবসম্মত প্রতিবেদন ।
উত্তরমুছুন