শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬

শেষে বলিউডও খুলে ফেলল ঔদার্যের মুখোশ?

গৈরিক হুমকি, মেরু- দণ্ডহীন ইম্পা,  ফলত ভারতীয় চলচ্চিত্রে পাকিস্তানি শিল্পীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি। যে বলিউডে সৌভ্রাতৃত্বের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য, তাকেই আজ জড়িয়ে পড়তে হল মেরুকরণের সেই কুশ্রী খেলায়, যে খেলায় শেষ পর্যন্ত সকলেই হারে৷

 

প্রেমেন্দ্র মজুমদার


ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার প্রোডিউসারস্ অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ইম্পা’ গত ২৯ সেপ্টেম্বর যখন পাকিস্তানি শিল্পীদের ভারতীয় ছবিতে কাজ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল,তখনই বোঝা গিয়েছিল যে গৈরিক সন্ত্রাসের চাপে বলিউড এ বার তার এতাবদ্কালের সযত্নচর্চিত ঔদার্যের মুখোশ খুলে ফেলতে চলেছে৷ মৃদু কিছু প্রতিবাদ এ দিক ও দিক থেকে শোনা গেলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো মেরুদণ্ডের জোর যে বলিউডের নেই, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই তা প্রমাণ করেছে৷

কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতেছেন বলিউডের নয়নের মণি করণ জোহর৷ দেশপ্রেমের ঠিকা নেওয়া মাফিয়াদের কাছে মুচলেকা দিয়ে যিনি কার্যত একটা অপরাধের কাছে মাথা নুইয়েছেন৷ এই করণ জোহরেরই আপন মামা,যশরাজ চোপরা,যাঁর জন্ম লাহোরে,আজ জীবিত থাকলে কী ভাবে বিষয়টিকে দেখতেন জানতে ইচ্ছে করে৷

প্রথম ভারতীয় সবাক ছবির অন্যতম অভিনেতা মাস্টার বিঠলের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গ করার অপরাধে যখন ‘শারদা স্টুডিও’ মামলা রুজু করে তখন যে আইনজীবী তাঁর পক্ষে আদালতে লড়েছিলেন তাঁর নাম মহম্মদ আলি জিন্না৷

মহাত্না গান্ধীর সাথে মহম্মদ আলি জিন্না

‘ইম্পা’-র মতো একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত,সুপ্রাচীন সংগঠনের পক্ষে এমন একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত যে নিতান্তই দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার পরিচায়ক তা বলাই বাহুল্য৷ এই সিদ্ধান্ত বলিউডের দরাজ-দিল ভাবমূর্তিকে কালিমালিন্ত করেছে সন্দেহ নেই৷ ‘ইম্পা’র জন্ম ১৯৩৭ সালে৷ যে বছর মুক্তি পেল দাদা সাহেব ফালকের শেষ ছবি ‘গঙ্গাবতরণ’৷ এবং ভি শান্তারামের ‘প্রভাত ফিল্ম কোম্পানি ’র মারাঠি ছবি ‘সন্ত তুকারাম’ প্রথম ভারতীয় ছবি হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল ভেনিস চলচ্চিত্র উত্সবে৷ ভারতীয় সিনেমার গৌরবময় ইতিহাসের তখন শৈশব৷ মাত্র ছয় বছর আগে মুক্তি পেয়েছে প্রথম ভারতীয় সবাক ছবি আরদেশির ইরানির ‘আলম আরা’৷ ভারতীয় সিনেমায় সূচিত হয়েছে এক নতুন অধ্যায়৷ এই খান বাহাদুর আরদেশির ইরানির উদ্যোগেই তাঁর সহযোগী সাগর মুভিটোনের আর এক প্রতিষ্ঠাতা চিমনলাল দেশাই, রঞ্জিত স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা চন্দুলাল শাহ, ওয়াদিয়া মুভিটোনের প্রতিষ্ঠাতা হোমি ওয়াদিয়া সহ বেশ কয়েকজন মিলে ‘ইম্পা’ গড়ে তোলেন৷ সূচনাপর্বে যাঁরা ‘ইম্পা’র নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ভি শান্তারাম, দলসুখ পাঞ্চোলি, কিশোর সাহু, বিমল রায়, জে ওমপ্রকাশ, মেহবুব খান, জি পি সিপ্পি, আই এস জোহর, নার্গিস, প্রকাশ মেহরা, শক্তি সামন্ত প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ সে সময় কেউ কি কখনও ভেবেছিলেন যে এঁদের মধ্যে দলসুখ পাঞ্চোলি লাহোরের বিখ্যাত এম্পায়ার টকিজের কর্ণধার বলে বা তাঁর জন্ম করাচিতে বলে,বিমল রায়ের জন্ম পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরে বলে, জে ওমপ্রকাশ রাওয়ালপিন্ডিতে জন্মেছিলেন বলে, জি পি সিপ্পি পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের হায়দ্রাবাদ শহরে জন্মেছিলেন বলে, আই এস জোহরের জন্ম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে বলে কিংবা নার্গিস অর্থাৎ ফতিমা রসিদের বাবা আব্দুল রসিদ রাওয়ালপিন্ডি থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বলে তাঁরা ‘ইম্পা’র সভাপতির পদে বসতে পারবেন না? বলিউড নামক যে মিথ আজ প্রায় সারা দুনিয়া জুড়ে চলচ্চিত্র-চর্চার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে সে তো কেবল খণ্ডিত ভারতের ছদ্ম-দেশপ্রেমীদের একক প্রচেষ্টায় তৈরি হয়নি৷ একটি জাতির রক্তাক্ত ইতিহাসকে কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়? না তা আদৌ সম্ভব? তা হলে তো ঋত্বিক ঘটক নামক চলচ্চিত্র কিংবদন্তির জন্মই হত না৷ লাহোর থেকে বোম্বাই শহরে স্বপ্ন দেখতে আসা যে যুবকটিকে মারাঠি জৈন আন্নাসাহেব (ভি শান্তারাম) তাঁর ‘রাজকমল কলামন্দিরে’ একটি প্রশস্ত টেবিল দিয়ে বলেছিলেন,‘যত দিন না তোমার নিজের অফিস হচ্ছে এটাই তোমার ঠিকানা’--- তখন কি তাঁর একবারও মনে হয়েছিল,যশরাজ চোপরা নামক ওই তরুণটির জন্ম কোথায়? তা যদি হত তা হলে তো আজ বলিউডের ইতিহাস অন্য রকম ভাবে লেখা হত৷ বলিউড পারবে কাপুর-সাম্রাজ্যকে অস্বীকার করতে? ওই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পৃথ্বীরাজই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্মেছেন তাই নয়, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ-এর জন্মও পেশাওয়ারে৷ যে শহরে তাঁর মাত্র দু-বছর আগেই জন্মেছেন মহম্মদ ইউসুফ খান, পরবর্তীকালে দিলীপকুমার নামে যিনি বলিউডের অন্যতম নায়ক৷ এবং প্রায় একই সময় পাকিস্তানের গুরুদাসপুর জেলার এক শহরে জন্মেছেন ধরমদেব আনন্দ, অর্থাৎ বলিউডের চিরতরুণ নায়ক দেব আনন্দ৷ কাকে বাদ দেবেন? মীনাকুমারী অর্থাৎ মাহজাবিন বানোর বাবা আলি বক্স এসেছিলেন ও পারের পাঞ্জাব থেকেই৷ মধুবালা অর্থাৎ মুমতাজ জাহানের বাবা আতাউল্লা খান এসেছিলেন পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল থেকে৷ চেতন আনন্দ, ও পি নাইয়ার,অমরিশ পুরি, প্রেম চোপড়া,শেখর কাপুর সকলেরই জন্ম লাহোরে৷ গুলজারের জন্ম ও পারের ঝিলাম জেলায়৷ ওই একই জেলায় জন্মেছিলেন সুনীল দত্ত৷ অমিতাভ বচ্চনের মামার বাড়ি পাকিস্তানের পাঞ্জাবে৷ ওই একই প্রদেশে রাজেশ খান্নার পৈতৃক ভিটে৷ ঋত্বিক রওশনের পিতামহ সুরকার রওশনের জন্ম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায় এবং মাতামহ জে ওমপ্রকাশের জন্মও ও পারেই৷ সুরেশ ওবেরয়ের জন্ম বালুচিস্তানে৷ সাধনা ও গোবিন্দ নিহালনির করাচিতে৷ বলরাজ সাহানি রাওয়ালপিন্ডিতে৷ সুরাইয়া গুজরানওয়ালায়৷ কুমার সাহানি সিন্ধ প্রদেশের লারকানায়৷ অচলা সচদেব জন্মেছেন পেশাওয়ারে৷ শাহরুখ খানের পৈতৃক ভিটাও পেশাওয়ারে৷ সবচেয়ে বড়ো কথা, বলিউডের বা বলা ভালো ভারতীয় ছবির অন্যতম অনুরাগী, যিনি কিছু দিন চলচ্চিত্র সমালোচক হিসাবেও কাজ করেছেন, সেই স্বয়ং লালকৃষ্ণ আদবানির জন্মও তো করাচিতে৷ 

আসলে একটি দেশকে কেটে দু’টি বা তিনটি টুকরো করে ফেললেই তার সমস্ত ইতিহাস ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া যায় না৷ ইতিহাস তো ভুলে যাবে না যে প্রথম ভারতীয় সবাক ছবির অন্যতম অভিনেতা মাস্টার বিঠলের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গ করার অপরাধে যখন ‘শারদা স্টুডিও’ মামলা রুজু করে তখন সেই মামলায় যে আইনজীবী তাঁর পক্ষে আদালতে লড়েছিলেন তাঁর নাম মহম্মদ আলি জিন্না৷ কী করে আমরা ভুলে যাব ১৯৭২-এর জুলাই-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে বিখ্যাত সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় বাবার সঙ্গে সিমলায় বেড়াতে আসা উনিশ বছরের বেনজির ভুট্টোর অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে সিমলার রিৎজ থিয়েটারে সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘পাকিজা’ ছবির বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছিল৷ এ সব স্মৃতিই তো পারে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা দূর করতে৷

‘ইম্পা’র এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সিনেমা হল মালিকদের সংগঠন ‘পাকিস্তানি এক্সিবিটর অ্যাসোসিয়েশন’ পাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সে দেশে বলিউডের কোন ছবি প্রদর্শিত হবে না৷ বহু প্রচেষ্টার পর,২০০৭-এ জেনারেল মুশারফের রাজত্বকালে পাকিস্তানে সরকারি ভাবে ভারতীয় ছবির প্রদর্শনীর উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহূত হয়৷ ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় বলিউড৷ যার সাম্প্রতিক উদাহরণ সলমন খান অভিনীত যশরাজ ফিল্মসের ‘সুলতান’৷ মুক্তি পেয়েছে জুলাই-এ এবং শুধুমাত্র পাকিস্তানেই গত তিন মাসে আয় করেছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা৷ পাকিস্তানের বক্স অফিসের নিরিখেও যা সর্বকালীন রেকর্ড৷ কিন্ত্ত কাকস্য পরিবেদনা! বরং যুদ্ধং দেহি মনোভাব নিয়ে তাল ঠুকতে এগিয়ে এসেছে ‘সিনেমা ওনার্স এগজিবিটর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’৷ তারা ফরমান জারি করেছে,যে সব ছবিতে পাকিস্তানি অভিনেতা বা কলাকুশলীরা কাজ করবেন তা মহারাষ্ট্র, গুজরাট বা গোয়ায় দেখানো যাবে না৷ অর্থাৎ বলিউডকে নামিয়ে আনা হচ্ছে নিতান্তই এক কলতলার ঝগড়ায়৷

করাচির একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি হিসাবে যেতে হয়েছিল কয়েক বছর আগে৷ মহেশ ভাট, মুকেশ ভাট, মোহিত সুরি, তনুজা চন্দ্রা, জয়দীপ সাহানি, বিশাল ভরদ্বাজ, রেখা ভরদ্বাজ, গুলশন গ্রোভার-সহ বলিউডের এক বিরাট প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন সে উত্সবে৷ বিমান বন্দর থেকে মূল প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত কি বিপুল স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতায় এই প্রতিনিধিদের যে সংবর্ধিত করেছিলেন করাচির বিদগ্ধ চলচ্চিত্রমোদী দর্শক, এই প্রতিবেদক তার সাক্ষী৷ নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা পরে পৌঁছনোর পরও প্রেক্ষাগৃহের উপচে পড়া দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে যে ভাবে অজয় দেবগনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন অন্য কোনও অভিজাত চলচ্চিত্র উত্সবে তেমন কোনও অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে কি না জানা নেই৷ এ বছর গোয়ায় ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসাবে অজয় দেবগনের সেই স্মৃতি হয়তো মনে পড়বে৷

পাকিস্তানের আম জনতার বলিউড প্রেম এতই গভীর যে সে দেশের কোনও সরকার কোনও নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালেই তাকে কখনও বেঁধে রাখতে পারেনি৷ বলিউড ছবির মুক্তি সে দেশে আইনি হোক বা বেআইনি,পাকিস্তানের আম জনতার তাতে থোড়াই কেয়ার৷ মুম্বইয়ের দর্শক কোনও ছবি দেখলে করাচির দর্শক সে ছবি দেখবেনই৷ মুম্বই বা দিল্লির ট্যাক্সিতে বলিউডের যে জনপ্রিয় গান শোনা যায়,সেই একই গান শোনা যায় করাচি বা লাহোরের ট্যাক্সিতেও৷ কিন্ত্ত সকলের কানেই যে সেই গান পৌঁছবে তার কোনও কথা নেই৷ আর তা নেই বলেই ‘মুম্বই চলচ্চিত্র উৎসব’ থেকে বাদ দিতে হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত তৃন্তি মিত্র অভিনীত বিশ্ববন্দিত ছবি ‘জাগো হুয়া সবেরা ’৷ ১৯৫৯ সালে নির্মিত বিখ্যাত এই ছবিটির অপরাধ,এটি পাকিস্তানি ছবি৷ যে বলিউড প্রেম ও সৌভ্রাতৃত্বের এক বাতাবরণ বজায় রাখতে পেরেছিল এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে,সহস্র রাজনৈতিক প্ররোচনা সত্ত্বেও নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছিল এক সম্মানজনক সর্বজনীন উচ্চতায়,সেই বলিউডকেই আজ জড়িয়ে পড়তে হল মেরুকরণের চিরাচরিত সেই কুশ্রী খেলায়,যে খেলায় শেষ পর্যন্ত সকলেই হারে,জেতে না কেউই, তবু খেলে যায় ক্ষমতার নেশায়৷

প্রেমেন্দ্র মজুমদার: ইন্ডিয়ান ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সম্পাদক৷

দৈনিক এই সময়, কলকাতা, ভারত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন