বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬

মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কেরির সাথে বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন


সমশের মবিন চৌধুরী

ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনা ও জন কেরিমার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফর নানা বিবেচনাতেই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই জানি যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈরী অবস্থান ছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে তারা পরিষ্কারভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত নতুন ও পুনরায় নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। ওয়াশিংটন থেকেও তখন এবং পরে বিভিন্ন সময়ে একই ধরনের মনোভাব পাওয়া গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেই নির্বাচনের প্রায় আড়াই বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরের খুবই তাৎপর্য রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের একজন ও গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশ সফর আমাদের সরকারের জন্য স্বস্তি ও সন্তোষের একটি বিষয়। এই সফরের মূল যে দিকটি আলোচনায় রয়েছে তা হচ্ছে নিরাপত্তা ইস্যু ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা। এটা আমরা সবাই জানি যে আন্তর্জাতিক এই সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জঙ্গিদের সামাল দিতে বাংলাদেশেরও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাহায্য-সহযোগিতা জরুরি। আমরা জেনেছি যে এসব বিষয় নিয়ে এই সফরের সময়ে আলোচনা হয়েছে এবং দুই পক্ষই এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের ব্যাপারে তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনীতির মতো কূটনৈতিক সম্পর্কও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এটাই রাজনীতি ও কূটনীতির সৌন্দর্য।


তবে এই সহযোগিতার ধরন বা এর আকার কী হবে বা হতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। আর এ ধরনের একটি সফরে এসব বিস্তারিত ঠিক করাও সম্ভব হয় না। এ ধরনের সফরে দুই পক্ষের অবস্থান ও মনোভাব পরিষ্কার করা হয়। তার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলো ঠিক করা হয়। আর আমরা জানি যে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে গেছেন। নিরাপত্তা সহযোগিতা বা জঙ্গিবাদ মোকাবিলার বিষয়টির একটি দ্বিপক্ষীয় দিকের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দিকও রয়েছে। ফলে এ বিষয়গুলো সামনের দিনগুলোতে পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। আমাদের সরকারের তরফে তাদের অবস্থান ও চাওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বাণিজ্য ক্ষেত্রে তেমন কিছু হওয়ার সুযোগও নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের নানা বিষয়গুলো কংগ্রেসের ওপর নির্ভর করে। ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলেও যুক্তরাষ্ট্রে তা পায় না। এই বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জন কেরির বাংলাদেশ সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাঁর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন। তিনি সেখানে গেছেন এবং পরিদর্শক বইয়ে আবেগঘন মন্তব্য করেছেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বঙ্গবন্ধুর এক খুনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। এই সফরের সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এখন কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

গণতন্ত্র, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার—এ বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই কথা বলে। নাগরিক সমাজের সমাবেশে এই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। জন কেরির সফরের আরও একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের দেশে যে প্রধান বিরোধী দল ও এর নেতা রয়েছেন, তাঁরা খুব গুরুত্ব পাননি। এই বিরোধী দলকে যুক্তরাষ্ট্র খুব বিবেচনায় নিচ্ছে বলে মনে হয় না।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। তবে বৈঠকটি হয়েছে মার্কিন দূতাবাসে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দূতাবাসে গিয়ে বৈঠক করার বিষয়টি কেমন হলো, সে প্রশ্ন উঠেছে। এই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা বিএনপি মহাসচিবের তরফে আমরা জেনেছি। আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জঙ্গিবাদ—এসব প্রসঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায়। এখন বিএনপির তরফে এর বাইরে কী বলা হয়েছে বা নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা চাওয়া হয়েছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। ফলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কি না, তা আমরা জানি না।

জন কেরির এই সফরের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের ব্যাপারে তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনীতির মতো কূটনৈতিক সম্পর্কও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এটাই রাজনীতি ও কূটনীতির সৌন্দর্য।

সমশের মবিন চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগী।

কেরির কূটনৈতিক ক্যারিকেচারে সব দলই কুপোকাৎ!


২০১২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাঁর বক্তৃতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশটির সংলাপের তাগিদের কথা সবারই জানা। গত বছরের শুরুর দিকে ওয়াশিংটনে জন কেরির সঙ্গে বৈঠকের পর ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসবেন বর্তমান সরকারকে শক্তিশালী করতে। তাঁর ওই বক্তব্যের এক বছরেরও বেশি সময় পর গত সোমবার জন কেরি যখন ঢাকায় আসেন তখন সরকারও তার নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদের অর্ধেকের বেশি পার করে ফেলেছে। আর এ সফরে কেরির বক্তৃতা কিংবা সফর নিয়ে বিবৃতি বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি—কোথাও নতুন নির্বাচন বা সংলাপের আহ্বান স্থান পায়নি। এর ফলে কেরির সফর সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেনি। জন কেরি সফর শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের ক্ষেত্রে এটি নতুন দৃষ্টান্ত। আর বাংলাদেশ সফর স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে জন কেরির সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি বলেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, জন কেরি একটি নিরাপদ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের মুখ্য উপাদান হিসেবে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক বিরোধিতার সুযোগ থাকে এমন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এ ছাড়া দেশের জন্য হুমকিগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশি সমাজের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দেন তিনি। অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কেরির সঙ্গে বৈঠক করতে পেরে বিএনপিও স্বস্তিতে আছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি জন কেরির গুরুত্বারোপকে বিএনপি বড় বার্তা হিসেবে দেখছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, জন কেরির ঢাকা সফরে বড় পরিসরে এসেছে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবিলা প্রসঙ্গ। এ দেশে, এ অঞ্চলে ও বিশ্বে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবিলার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। জন কেরি তাঁর বক্তৃতায় কৌশলে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ দমনের অন্যতম উপাদান হিসেবে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কেরি মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন সেখানেও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি উঠেছে।

বাংলাদেশ জন কেরির ঢাকায় আসাকে ‘রুটিন সফর’ হিসেবেই দেখেছে। ওবামা সরকারের মেয়াদের একেবারে শেষ দিকে এ সফর যাত্রাবিরতির চেয়ে সামান্য বেশি কিছু হলেও এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। গত জুলাইয়ে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলাই মূলত জন কেরির সফরকে আবশ্যিক করে তুলেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তিনি বাংলাদেশের পাশে থাকার, সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার এবং সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছেন। বাংলাদেশ সফরে বিভিন্ন বৈঠকে তিনি শুধু নিজের প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেননি, অন্যপক্ষের বক্তব্য ও যুক্তিগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে শুনেছেন।

কেরি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের ইরাক ও সিরিয়ার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এ সফরে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং ঢাকাকে ওয়াশিংটনের সহযোগিতাবিষয়ক বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং তা আগামী দিনগুলোতেও চলবে। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর জন কেরি ইএমকে সেন্টারে রাখা বক্তব্যে বলেছেন, শুধু বঙ্গোপসাগর এলাকায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ই নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত উন্মুক্ত ও বড় পরিসরে সম্পৃক্ততা আছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সক্ষমতা বাড়াতে জিসিইআরএফ তহবিলে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করছে। কেরির মতে, তাঁর সফরের ফলে এ ইস্যুগুলো আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জনমনে আস্থা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেছেন, ‘তাই আমি মনে করি, আপনারা (বাংলাদেশিরা) এ ব্যাপারে আমাদের আরো কাজ, আরো সম্পৃক্ততা এবং আরো উপস্থিতি দেখতে পাবেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আট ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশ কী বার্তা পেল জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক বলেন, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। তারা আমাদের অভূতপর্ব অর্জন, অগ্রগতি ও নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে। আবার একইভাবে বাংলাদেশের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরে সেগুলো মোকাবিলায় এ দেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সুযোগে বাংলাদেশও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু তুলেছে।

প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা জিএসপি চাই না, শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার চাই।’ রাজনৈতিক দিক দিয়ে জন কেরির সফরের বার্তা বিষয়ে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমালোচনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাতে যে উষ্ণতা দেখা গেছে, তা এককথায় অসাধারণ। বৈশ্বিক বিভিন্ন ফোরামে দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেছেন। জন কেরি তাঁর ঢাকা সফরে আগামী মাসে নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশ নেওয়ার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে জন কেরির স্ত্রী থেরেসা হেইঞ্জের জন্য চমৎকার একটি জামদানি শাড়িও উপহার দিয়েছেন শেখ হাসিনা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর যে বিবৃতি দিয়েছিল, তাতে স্পষ্টভাবেই দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ ছিল। নির্বাচন-পরবর্তী কয়েক মাসেও দেশটির প্রতিনিধিরা তাঁদের এমন প্রত্যাশার কথা বারবার বলেছেন। ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে ঘিরে গত বছরের শুরুর দিকে অস্থিরতার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের স্বাক্ষর জাল করে রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রচারিত ভুয়া বিবৃতিও ওয়াশিংটনের দৃষ্টি কাড়ে। সে সময় দেশব্যাপী নির্বিচার নাশকতা এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধীদের কর্মসূচি পালনে বাধা—দুটিরই সমালোচনা করেন জন কেরি। গত রবিবার ঢাকা সফরের সময় জন কেরি নতুন নির্বাচন বা রাজনৈতিক সংলাপের মতো বিষয় যে সরাসরি তোলেননি তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বার্ষিক আলোচনার সর্বোচ্চ ফোরাম অংশীদারি সংলাপ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ যাবৎ অনুষ্ঠিত অংশীদারি সংলাপগুলোতেও নতুন নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসেনি। জন কেরি খুব কৌশলে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ দমনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা বলেছেন, যা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে আলাদা বৈঠকগুলোতেও কেরি মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, জন কেরি তাঁর প্রত্যাশা জানানোর পাশাপাশি সরকারেরও বক্তব্য শুনেছেন। ঢাকা সফরে তিনি এমন কিছু বলেননি যা সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। বরং স্পষ্টতই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বর্তমান সরকারের পাশে থাকার ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে শক্তিশালী করার কথাই বলেছেন তিনি। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বৈশ্বিক যোগসূত্র থাকার বিষয়ে জন কেরি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাও নতুন কিছু নয়। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকা সফরের সময়ও এমন যোগসূত্রের কথা বলেছিলেন। কেরিও যে এমন কিছু বলবেন তা অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও যে জন কেরি সাক্ষাৎ করবেন তাও অনুমেয় ছিল। বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্র বার্তা দিয়েছে, সংসদের বাইরে থাকলেও তারা এ দলটিকে বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে। অন্যদিকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও জন কেরির সঙ্গে কথা বলার সুযোগে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরতে পেরেছেন।

শরীরে এক মিনিট পেঁয়াজে ঘষে অবিশ্বাস্য সব উপকার



পেঁয়াজ কাটার সময়ে চোখে যতই জল আসুক না কেন, খাবার-দাবারের স্বাদ বাড়াতে পেঁয়াজ একেবারে অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু জানেন কি, পেঁয়াজের মধ্যে রয়েছে বিশেষ কিছু ডাক্তারি গুণ?

পেঁয়াজ কাটার সময়ে চোখে যতই জল আসুক না কেন, খাবার-দাবারের স্বাদ বাড়াতে পেঁয়াজ একেবারে অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু জানেন কি, পেঁয়াজের মধ্যে রয়েছে বিশেষ কিছু ডাক্তারি গুণ? আয়ুর্বেদ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, পেঁয়াজ খাওয়ার উপকারিতা তো রয়েছেই, পাশাপাশি শরীরে কাঁচা পেঁয়াজ ঘষারও বিশেষ কিছু উপকারিতা রয়েছে। কীরকম?
আসুন, জেনে নিই—

১. শরীরে কোথাও পুড়ে গিয়েছে? একটি পেঁয়াজ দু’ভাগ করে কেটে নিয়ে একটি ভাগ ঘষে দিন ওই অংশে। জ্বলুনি নিমেষে উধাও হবে।

২. শরীরের কোথাও কাঁটা ফুটে গিয়েছে? কাঁচা পেয়াঁজের একটি টুকরো কিছুক্ষণ ধরে রাখুন ওই জায়গায়। আর কোনও ব্যথা-বেদনা অনুভব করবেন না।

৩. কোনও কারণে নাক থেকে রক্ত ঝরছে? একটি পেঁয়াজ কেটে ধরে রাখুন নাকের নীচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হবে রক্ত পড়া।

৪. রাত্রে যাদের অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে তাঁরা শুতে যাওয়ার আগে একটি পেঁয়াজ কেটে গভীরভাবে পাঁচ থেকে দশ বার পেঁয়াজটির ঘ্রাণ গ্রহণ করুন। দেখবেন ঘুম চলে আসবে।

৫. মুখে যাঁদের কালো দাগ রয়েছে, তাঁরা জল দিয়ে মুখ দিয়ে ধোয়ার পরে একটি লাল রং-এর পেঁয়াজ কেটে সেটি ঘষে নিন ওই দাগ ধরা জায়গায়। কয়েকদিনের মধ্যেই উপকার পাবেন।

৬.  যাঁরা ব্রণ বা ফুসকুড়ির সমস্যায় ভোগেন, তাঁরা নিয়মিত কাঁচা পেয়াজ ঘষতে পারেন মুখে। ব্রণ যেমন কমবে, তেমনই মিলিয়ে যাবে ব্রণ বা ফুসকুড়ি হওয়ার ফলে মুখে হওয়া কালো দাগগুলিও।

কী এই এলইএমওএ (লেমোয়া )?

চীন-পাকিস্তানকে ‘রাগিয়ে’ ভারত-মার্কিন ঐতিহাসিক ‘লেমোয়া’ প্রতিরক্ষা চুক্তি
➠ দুই দেশ পরস্পরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে৷ স্থল, বায়ু ও নৌসেনা ঘাঁটির দরজা খুলল 
➠ ভারত ও আমেরিকা পরস্পরের সেনাবাহিনীকে রসদ জোগাতে পারবে৷ মিলবে খাদ্য -বস্ত্র থেকে চিকিৎসা পরিষেবা৷ জ্বালানি সংগ্রহ থেকে সামরিক যান মেরামতিতে সবুজ সঙ্কেত
➠ সন্ত্রাস মোকাবিলা, সমুদ্র নিরাপত্তা ও বিশেষ অভিযানের ক্ষেত্রে সুবিধা মিলবে৷ মানবিক সাহায্য ও ত্রাণকাজ আরও দ্রুত করা সম্ভব
দৈনিক এই সময়, কলকাতা

পাকিস্তান ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন৷ চীন উত্তেজিত৷ এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও হতে পারে সম্পর্কের অবনতি৷ সে সব ঝুঁকি নিয়েও ভারত আমেরিকার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগলো৷ সোমবার ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে ‘লেমোয়া’ নামে যে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তার মোদ্দা কথা হল --- এ বার থেকে আমেরিকা জ্বালানি ভরার জন্য বা অন্য কোনও সামরিক সহায়তার জন্য ভারতের যে কোনও সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে৷ যদিও আমেরিকার সেনাকে ঘাঁটি করতে দেওয়া হবে না বলে এই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে৷ তা ছাড়াও এই চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশের জল, স্থল ও বায়ুসেনা ঘাঁটিকে উভয়েই রসদ সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করতে পারবে৷ সন্ত্রাস মোকাবিলায় কার্যকরী হবে এটি৷

গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে , আমেরিকার সঙ্গে এই ধরনের সামরিক চুক্তি হবে কি না, তা নিয়ে টালবাহানা চলছে৷ তার কারণই হল দেশের অভ্যন্তরে এর রাজনৈতিক প্রভাব কী হবে ও কূটনৈতিক ভাবেই বা ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায় দাঁড়াবে৷ কিন্তু কেন এত প্রশ্ন উঠছে? কেনই বা একটি মার্কিন চুক্তি নিয়ে এত শোরগোল? সে জন্য ফিরে যেতে হবে স্বাধীনতা-উত্তর কালের প্রথম যুগে৷ জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই ভারত ‘নন -অ্যালাইনড মুভমেন্ট’-এর সদস্য৷ অর্থাৎ সে সময়ে শক্তির দু’টি উৎসস্থল --- আমেরিকা বা রাশিয়া --- কোনও দেশের সঙ্গেই কোনও সামরিক জোটে যাবে না ভারত৷ সে নীতি বজায় রাখেন ইন্দিরাও৷ যদিও তিনি রাশিয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েন৷ কিন্ত্ত তা সত্ত্বেও ভারতের বিদেশনীতিতে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি৷ প্রথম বার এর ব্যতিক্রম ঘটে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়৷ কুয়েতকে কেন্দ্র করে যখন আমেরিকা-ইরাক উপসাগরীয় যুদ্ধ চলছে , সেই সময় আমেরিকা ভারত সরকারকে অনুরোধ করে বিমানে তেল ভরার জন্য তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিতে৷ তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর তাতে রাজিও হয়ে যান৷ এই নিয়ে কংগ্রেস তীব্র আপত্তি করে৷ এমনকি সমর্থন তুলে নিয়ে চন্দ্রশেখর সরকারকে ফেলে দেওয়ার কথাও বলে৷ ফলে অনুমতি দেওয়ার এক সন্তাহের মধ্যেই জ্বালানি ভরার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় চন্দ্রশেখর সরকার৷ তখন সেই উপসাগরীয় যুদ্ধের বয়স ২ সপ্তাহ৷

ফলে সে বার মূলত কংগ্রেসের আপত্তিতেই চন্দ্রশেখর পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ সেই কংগ্রেসই কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই চুক্তি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি৷ বামেরা বরাবরের মতো সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে এই চুক্তির সমালোচনা করেছে৷ কিন্তু তার বাইরে এখনও কোনও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কূটনৈতিক মহল কিন্ত্ত মনে করছে, উপমহাদেশ অঞ্চলে এই চুক্তির ফল মারাত্মক হতে পারে৷ এর ফলে উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং চীন ও পাকিস্তান সম্পর্ক আরও মজবুত হবে৷ ইতিমধ্যেই বেজিং হুমকি দিয়ে রেখেছে, বালুচিস্তানে যদি ভারত কোনও আক্রমণ করে তা হলে তারা পাকিস্তানকে সব রকম সাময়িক সহায়তা দেবে৷

চীন সাগরকে কেন্দ্র করেও মার্কিন -চীন সম্পর্ক যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে কোনও সহজ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়৷ অন্য দিকে ভারত বলে রেখেছে তারা ভিয়েতনামকে দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে সামরিক সহযোগিতা ক রবে , যা আগে থেকেই বেজিংকে চটিয়ে দিয়েছে৷ আর পাকিস্তান তো রয়েইছে৷ তারা সব সময়ই ভারতের সামরিক চুক্তি ও পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তিত৷ পাশাপাশি , রাশিয়া ছিল ভারতের দীর্ঘদিনের সহযোগী দেশ৷ এই চুক্তির মাধ্যমে সম্ভবত তাতেও ছেদ পড়বে৷ তবে এ সব কোনও কিছুকেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে , মোদী একেবারেই নিজের মতো করে বিদেশনীতিতে বদল আনছেন৷ কারণ ভারত আমেরিকার ‘ন্যাচারাল অ্যালাই ’ হলেও , কখনওই সামরিক ক্ষেত্রে এতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না৷ এ বার সেটাই হয়ে গেল৷ আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্র জাপান , অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত এখন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে৷ চুক্তি স্বাক্ষরের পর কার্টার বলেছেন, ‘যে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘ সম্পর্ক, তাদের সঙ্গেই এ ধরনের চুক্তিতে যায় আমেরিকা৷ ভারত তাদের অন্যতম৷ তবে আমরা ভারতের মাটি থেকে যুদ্ধ করব না৷ ’ কিন্ত্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন , এর পর যে ভারতের মাটিকে আমেরিকা ব্যবহার করবে না , এ কথা বলা যায় না৷ পাকিস্তানের দৈনিক তো লিখেইছে, এই লেমোয়া চুক্তিতেই শেষ নয় , এর পর ভারত -মার্কিন সহযোগিতার আরও দু’টি চুক্তি হবে --- সিসমোয়া (কমিউনিকেশনস ইন্টারপোর্টেবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট ) ও বেকা (বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট ফর জিও -স্প্যাশিয়াল কো অপারেশন)। প্রথমটির ক্ষেত্রে চুক্তি হলে ভারতের মাধ্যমে নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবে আমেরিকা৷ দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানের ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি ও সমীক্ষার সুযোগ পাবে পেন্টাগন৷ এ দু’টি ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে পারিকরের জবাব, ‘সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে এত বছর লাগল৷ এর উপযোগিতা দেশের মানুষকে বোঝাতে হবে৷ তার পর অন্য বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
তবে লেমোয়ার জন্য যে দেশের অভ্যন্তরে মোদী সরকারকে বিরোধীদের প্রশ্নবাণ হজম করতে হবে, সেটা উপলব্ধি করেই সম্ভবত প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে চুক্তির পরিধি কতটা, তা স্পষ্ট করা হয়েছে৷ এই বোঝাপড়া সামরিক বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে, এর সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্রের কোনও সম্পর্ক নেই৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, এই চুক্তির ফলে কি মার্কিন বিমান বা যুদ্ধজাহাজ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সামরিক অভিযান চালানোর ছাড়পত্র পেয়ে গেল ? ভারতে কি আমেরিকা ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে ?

পারিকরের মন্তব্য, ‘এর সঙ্গে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না৷ কেউ কারও ভূখণ্ডে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে না৷ একসঙ্গে অভিযান চালানোর ব্যাপারও নেই৷ ’ তবে ফোর্বস ম্যাগাজিন কিন্ত্ত স্পষ্ট বলেছে , ‘এই লেমোয়ার ফলে মার্কিন নৌ ও বিমানবাহিনীর বিরাট সুবিধা হল৷ তাদের ভারতে ঘাঁটি থাকবে না ঠিকই , কিন্ত্ত তার থেকেও ভালো কিছু পাচ্ছে --- ভারতের সামরিক ঘাঁটি৷’স্বাভাবিক ভাবেই এই চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া দিয়েছে৷ নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ বলেন , ‘ভারত-মার্কিন এই সখ্য দেখে পাকিস্তান যথেষ্ট চিন্তিত৷ এর ফলে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক খারাপ হতে পারে৷’ চিনকে রুখতেই যে ভারত এতটা ‘সাহসী’ হয়ে উঠেছে, সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে বেজিংয়ের দৈনিকে ও পাক দৈনিকে৷ অন্য দিকে , চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দো -প্যাসিফিক অঞ্চলে সেনা বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে আমেরিকা৷ কাজেই এই একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতের এত দিনকার বিদেশনীতির মধ্যেই এল বিশাল বদলের সূচনা বার্তা৷ পরবর্তীকালে তা আরও কতটা বদলে যায় , সে বিশ্লেষণের সময় আসেনি৷ তবে এই চুক্তি যে মনমোহন সিংয়ের করা অসামরিক পরমাণু চুক্তির চেয়েও ব্যান্তিতে ও প্রভাবে অনেক বেশি , তা বুঝতে পারাটা বোধহয় কঠিন নয়৷


জাতিসংঘে বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক  ভাষণ

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন এবং সেই ভাষণে তিনি প্রায় ৫০টি ইস্যু তুলে ধরেন যা এখনও মানবজাতিকে নাড়া দেয় এবং সেই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য অতিসুন্দরভাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন যা এখনও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

তিনি উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করিয়া জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে।’ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব’ কারও প্রতি বিরূপ বা শত্রুতা নেই’ এবং এর ফলে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানের ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। জাতিসংঘে আমাদের দৃশ্যত শত্রুদেশ না থাকায় গেল ছয় বছরে আমরা জাতিসংঘের প্রায় ৫২টি কমিটি, কমিশন, ব্যুরো বা নেতৃত্বের আসনে নির্বাচিত হই। বস্তুত কোন নির্বাচনেই আমরা পরাজিত হইনি। এর মূল কারণ বঙ্গবন্ধুর নীতিÑ আমাদের কোন চিহ্নিত ‘শত্রুদেশ’ নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের নীতি ও উদ্যোগ ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর এবং তৃতীয়ত, আমরা যে সমস্ত কমিটি, কমিশন ইত্যাদিতে নির্বাচিত হয়েছি সে সমস্ত সংস্থায় আমরা সকলকে সঙ্গে নিয়ে, কার্যকরী বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে সকলের আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে পেরেছি। এতগুলো নির্বাচনে জয়লাভ বস্তুত শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থা ও বিশ্বাসের ফলশ্রুতি।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ সনদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং অদ্যাবধি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে তার কোন ব্যত্যয় হয়নি। তিনি ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং দ্ব্যর্থ ভাষায় জাতিসংঘে এর সপক্ষে জয়গান গান। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ বা ‘ন্যাম’ সংস্থার অন্যতম নেতা। এ বছরে এই সম্মেলনের চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশ কোন অজ্ঞাত কারণে তা বিসর্জন দেয়। এ বছর ১৩৩ দেশের সমন্বয়ে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার এশিয়া-প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোর ভাগে আসে এবং বাংলাদেশ এর দায়িত্বভার নেয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। বস্তুত, যখন আমাদের প্রার্থিতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তখন হঠাৎ করে আমাদের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারের ভাগ্য খুলে যায়। তারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ঢাকায় ন্যাম সম্মেলন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং কনভেনশন সেন্টারও তৈরি হয়। তবে বিএনপি সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা দখল করেই তা বাদ দেয়।

বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সংগ্রাম করার দৃঢ় প্রত্যয় শুধু ঘোষণা করেনি, তার সঙ্গে সকল দেশকে একত্রিত হয়ে তা দূর করতে আহ্বান জানান। সুখের বিষয় এই যে, আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ পরিচালনায় দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে এবং গেল বছরে জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সম্মতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বিশ্ব থেকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য যে ১৭টি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা এবং ১৬৯টি টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এখন অবশ্য এই ‘টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও টার্গেট অর্জনে’ দেশজুড়ে সকলকে নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করার সময় এসেছে এবং তা করতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ অর্জন সম্ভব। তাহলেই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার স্বপ্ন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি ‘উন্নত, সমৃদ্ধশালী, শান্তিময়, স্থিতিশীল অর্থনীতি’ -যা যে কোন উন্নত দেশের সমকক্ষ হবে- তা অর্জন সফল হবে।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ‘শান্তি ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার’ জোরালো অঙ্গীকার করেন এবং সুখের বিষয়, আজ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ এক নম্বরে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হন এবং দেশ ও দশের জন্য তাঁরা সুনাম বয়ে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে সমধিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপোস-মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশের শান্তির কাঠামো এবং দায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করবে।’ তাঁর ভাষণটি প্রফেটিক এ জন্য যে, আজ শেখ হাসিনার কারণে উপমহাদেশে বাংলাদেশ ন্যায়নীতি, পরিপক্বতা ও সমঝোতার পররাষ্ট্রনীতি প্রচলন করেছে। বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সমঝোতায় কোন প্রকার যুদ্ধ বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আইনের মাধ্যমে সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে। ৬৫ বছরের অমীমাংসিত বেরুবাড়িসহ সীমান্ত ছিটমহলগুলোর হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ করেছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের মধ্যে ট্রানজিট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উদ্ঘাটিত হচ্ছে। আজ বাংলাদেশ ‘ভারত ও নেপাল’ এবং ‘ভারত ও ভুটানের’ মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব গভীর ও অর্থবহ করার ক্ষেত্রে মডারেটরের ভূমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী আজ সম্পূর্ণ হাড়ে হাড়ে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ শান্তির অগ্রদূত হিসেবে শুধু ভারত উপমহাদেশে স্বীকৃতি লাভ করেনি, আজ সারা বিশ্বে বাংলাদেশ শান্তির মশাল নিয়ে সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সারা বিশ্বে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’র প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ মনে করে, মানব জাতির মধ্যে বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণী-গোত্র ইত্যাদিগত বৈষম্যের কারণে হিংসা-দ্বেষ যা তৈরি হয় তা দূর করে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই মানুষে-মানুষে সংঘাত, খুন-খারাবি, অশান্তি ও যুদ্ধবিগ্রহ কমানো যেতে পারেÑ বাংলাদেশ এ ব্যাপারে বিশ্বনেতা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতিসংঘের ভাষণে নিপীড়িত মানবজাতির সপক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনী নিপীড়িত জনগণের বৈধ অধিকারের প্রতি সমর্থন জানান। আজও বাংলাদেশ তার সেই নীতিতে অবিচল এবং সোচ্চার।

বঙ্গবন্ধু আণবিক বোমার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং ভারত মহাসাগর ও উপমহাদেশকে ‘শান্তি এলাকা’ হিসেবে ঘোষণার স্বপ্ন দেখেন। তিনি মানুষ-বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রোধ করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সকল সংস্থায় আণবিক বোমা বন্ধ ও নিশ্চিহ্নকরণ এবং অধিকতর মারণাস্ত্র তৈরি বাবদ খরচ বন্ধ করে তা ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-রোগ নিরাময়ে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যয় করার জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে। ২০১৩ সালে বিশ্বের সমরনায়ক দেশগুলো ১৭৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শুধু প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে এবং এর ফলে বিশ্বের প্রতিরক্ষা বৃদ্ধির পরিবর্তে বরং শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক অধিকতর বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, বিশ্বের ৪৮টি অতিদরিদ্র এলডিসি রাষ্ট্রগুলোর জন্য ধনিক দেশগুলো প্রতিবছর মাত্র ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রতিরক্ষা বাবদ খরচের মাত্র শতকরা ২.২৮ ভাগ সাহায্য প্রধান করে থাকে। ‘টেকসই লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের জন্য প্রতিবছর যে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে তার কিছুটা এই প্রতিরক্ষা বাবদ খরচ কমিয়ে মেটানো উচিত বলে বাংলাদেশ মনে করে।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তা অর্জনের জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। দু’-তিন বছর ধরে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন বাংলাদেশে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা’ বিষয়ক জাতিসংঘের একটি দফতর স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেয়। বস্তুত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ২০১১ সালে যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন তা পেশ করা হয় এবং মহাসচিব তা বিবেচনা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। এসব আলোচনা যখন চলছিল তখন তুরস্ক জাতিসংঘের এই প্রযুক্তিবিষয়ক দফতর তার দেশে স্থাপনের জন্য ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেবে বলে ঘোষণা দেয়। উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রযুক্তিবিষয়ক ডাটা ব্যাংক কোথায় হবে তা সুপারিশ করার জন্য একটি কমিটি কাজ করছে এবং ওই কমিটিতে একজন বাংলাদেশী চৌকস প্রফেশনালকে মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ চেষ্টা করলে সে প্রযুক্তি ব্যাংক বাংলাদেশে স্থাপন করতে পারে। তার গ্রাউন্ড-ওয়ার্ক করা আছে। তবে তার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ অবস্থা জাতিসংঘে তুলে ধরেন। সুখের কথা যে, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য এক নম্বর মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করার জন্য সকল রাষ্ট্রের বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন। বর্তমান জাতিসংঘ ‘পার্টনারশিপের’ ওপর জোর দিচ্ছে। তবে পার্টনারশিপের সংখ্যা আরও বিস্তৃত হয়েছেÑ বর্তমানে সকল স্টেকহোল্ডারস; রাষ্ট্র, সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সিভিল সোসাইটি ইত্যাদির নেতৃত্বের সময়ন্বয়ে ও যৌথ উদ্যোগের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে খাদ্য উৎপাদন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর জোর দাবি তোলেন এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি কমানোর তাগিদ দেন। তিনি সব জাতির ঐক্যের প্রতি জোর দেন এবং সব জাতির পারস্পরিক স্বনির্ভরতার স্বীকৃতি প্রদানে জোরালো ভূমিকা রাখেন।

বন্ধবন্ধু প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকারকে নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা ভোগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেন। সম্মিলিত জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সকল ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরী এবং তাহা সমগ্র বিশ্বের নর-নারীর গভীর আকাক্সক্ষারও প্রতিফলন ঘটাইবে এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিই দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে।’ তাঁর বক্তব্য ও উপলব্ধি আজও নিরেট সত্য এবং বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, সংঘাত ও যুদ্ধের মূলে রয়েছে অন্যায়-অবিচার ও জোর দখলের প্রতিবাদ।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে তেষট্রি হাজার পাকিস্তানী পরিবারকে পাকিস্তানে নিয়ে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য দাবি তোলেন এবং সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আরও একটি জরুরী সমস্যা হইল সাবেক পাকিস্তানের পরিসম্পদ বণ্টন।’ তিনি বলেন, ‘উপমহাদেশের জনগণের কল্যাণের স্বার্থে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এইসব অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হইবে, যাহাতে স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া সফল হইতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে।’ আজও বাংলাদেশ তার প্রস্তাবিত পথনির্দেশনা মেনে চলছে। তবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিবর্জিত সরকারগুলো ক্ষমতায় থাকায় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও বিহারীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি চাপা পড়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে, আমরা ওই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন যে, বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট শুধুমাত্র শান্তি ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার পরিবেশেই সমাধান করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি বিভিন্ন সঙ্কটে ও সমস্যা সমাধানে ‘মডারেটারের ভূমিকা পালন করে অসনধংংধফড়ৎ ড়ভ ঈড়হংবহংঁং বা ‘সম্মতি অর্জনের দূত’ উপাধি অর্জন করেন।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, অস্ত্রের ঝংঝনানির বিরুদ্ধে, বেআইনীভাবে ভূখ-ও দখলের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, বর্ণবৈষম্যবাদ ও মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে, মানবিক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে এমনকি অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ তোলেন এবং একই সঙ্গে নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়কে সমর্থন দেন- তিনি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগমুক্ত এক উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের শুধু নেতৃত্ব নয়, সাধারণ জনগণেরও হৃদয় স্পর্শ করেন। তিনি জাতিসংঘে ঘোষণা করেন, জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি আকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো সেই সব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকা-কেও সহজতর করিবে ইহাতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব। বঙ্গবন্ধুর কন্যার কণ্ঠে আমরা একই প্রত্যয়ের প্রতিফলন দেখি।

বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাস এবং মানবের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও সৃজনী শক্তির ওপর দৃঢ়চিত্ততা সম্মিলিত জাতিসংঘের ভাবাদর্শকে প্রভাবিত করে এবং এর ফলে বর্তমানে জাতিসংঘ সর্বক্ষণ সবার অংশগ্রহণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় তাঁর ভাষণ প্রদান করে দেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিশ্বসভায় সম্মানিত করেন এবং তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরই কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা পর পর ছয়বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে সবাইকে চমকিত করেন। বঙ্গবন্ধু একবার মাত্র জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে নকশা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেলেন তা আজও আমাদের আলোর দিশারী। মানবজাতির কঠিন সমস্যাগুলো যা তিনি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন সেগুলো আজও বিশ্ববাসীর জীবনকে করে তুলেছে সঙ্কটময় এবং বিপদসঙ্কুল। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাই এক অনন্য ভাষণ-এর ব্যাপ্তি, এর এ্যাপিল এর আহ্বান আজও অবাক হওয়ার।

জয় বাংলা

জয় বঙ্গবন্ধু

ড. এ কে আব্দুল মোমেন : রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি



মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ জন কেরি

১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেথ মুজিবুর রহমানের সাথে  মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার । এ সফরকালে  কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ বলেছিলেন

আজ থেকে ৪২ বছর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’। অর্থাৎ তলাবিহীন ঝুড়ি। এখানে যত অর্থই ঢালা হবে, তলা না থাকায় কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ঢাকা সফরে এসে বলেছেন, বাঙালি জাতির মেধা, পরিশ্রম আর একাগ্রতার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে একসঙ্গে কাজ করতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাঙালি জাতি সোনার বাংলা গড়ে তুলেছে। স্বাধীনতার মাত্র ৪২ বছরে বাংলাদেশ ৬ শতাংশের প্রবৃদ্ধির বৃত্ত ভেঙে ৭ শতাংশে উন্নীত করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে।নিরক্ষতা দূর হচ্ছে, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের কাছে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের সময় কেবল অর্থনীতি-ব্যবসা বাণিজ্যেই নয়, আর্থ-সামাজিক নানা সূচকেই অনেক পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় চরম দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আর স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বিদেশি রাষ্ট্রের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ বেশ পুষ্ট হয়েছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বহু পথ এগিয়েছে বাংলাদেশ। আর এ অর্জনে কেবল পাকিস্তানকেই নয়, অর্থনীতি ও সামাজিক নানা সূচকে ভারতের চেয়েও বেশ এগিয়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প কোনো প্রকার বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইনডিকেটরস ডাটাবেজে এবং আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ৫৮তম অবস্থানে ছিল। ২০১৫ সালে ২০৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার জিডিপি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির আঙিনায় ১৪ ধাপ ওপরে উঠে ৪৪তম স্থানে অবস্থান করছে। জানা গেছে, ১৯৭২ সালে দেশের রপ্তানি আয় ছিল ৩৩ কোটি ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলারে। একই সময়ে আমদানি ব্যয় ২৯ কোটি ডলার থেকে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নিয়ে তৎকালীন বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর মধ্যে একদলের ধারণা ছিল বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে বিদেশি সাহায্য লাগবে। আরেক দলের ধারণা ছিল, সাহায্য দিলেও কাজ হবে না। তাই সে সময় মার্কিন মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’। অর্থাৎ তলাবিহীন ঝুড়ি, এখানে যত অর্থই ঢালা হবে, তলা না থাকায় কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আমাদের সেই অপবাদ ঘুচেছে। সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনামে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ, ‘বাস্কেট কেস’ নো মোর।’

বাংলাদেশ এগোচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে গড়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি বাড়েনি। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। আর গত ১২ বছর ধরে দেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এখন তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।

কাশ্মীরিদের ‘আজাদি’

হ্যাপিমন জ্যাকব 



দেড় মাস ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, তারা যেন কাশ্মীরের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আলোচনায় বসে। সংসদে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সর্বদলীয় সভায় অংশগ্রহণকারীরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রাজনৈতিক সমাধান বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলও জম্মু ও কাশ্মীরের ‘সকল অংশীজনের’ সঙ্গে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এত কিছু সত্ত্বেও বিজেপি এসব উপদেশের আলোকে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে, উপত্যকাকে শান্ত করতে পারেনি। 

বিজেপি এখনো কাশ্মীরের বিষয়টিকে পাকিস্তান বা হিন্দু-মুসলমান পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং যে এই অবস্থার পুরো দায়টা পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপাতে চান বা তিনি যে দিল্লির মুসলিম ধর্মনেতাদের কাশ্মীরিদের কাছে যেতে বলছেন, এতেই বোঝা যায়, বিজেপির এই মনোভাবটা ভুল। বাস্তবতা হচ্ছে, কাশ্মীরে যা হচ্ছে সে বিষয়ে ভারতীয় মুসলমানদের যেমন কিছু করণীয় নেই, তেমনি সেখানকার ‘আজাদি’ সংগ্রামও একদম বিশুদ্ধ ইসলামি আন্দোলন নয়। না, ক্ষমতার দম্ভ বা রাজনৈতিক অজ্ঞতার কারণে যে বিজেপি এই সমাধান বের করতে বাজেভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, তা নয়। একদম গোড়ার কথা হলো, বিজেপির রাজনীতির প্রতীক ও কাশ্মীরের ‘আজাদি’ আন্দোলনের প্রতীকের মধ্যে যে সংঘাত রয়েছে, তার ফলেই এই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কাশ্মীরের ব্যাপারটা যেমন একদিকে বাস্তব, তেমনি তার প্রতীকী মূল্য রয়েছে। ফলে ‘আজাদি’ আন্দোলনের প্রতীকী মূল্যকে আমলে না নিয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

বিজেপির অতি-জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের আওতায় ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের পৃথক পতাকা ও সংবিধান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। কাশ্মীর-বিষয়ক বিজেপির রাজনৈতিক মনোভঙ্গির গোড়ায় রয়েছে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির এক দেশ, এক প্রতীক ও এক সংবিধানের নীতি। যদিও বাস্তবে জম্মু ও কাশ্মীরের পৃথক পতাকা ও সংবিধান ভারতীয় সংবিধান ও পতাকার ঊর্ধ্বে নয়, আর ৩৭০ নম্বর ধারা তো বিগত বছরগুলোতে সব অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ৩৭০ নম্বর ধারা বিলোপ করা হলে কাশ্মীরিদের কাছে তা পূর্ণাঙ্গ ‘ভারতীয় দখলদারি’ হিসেবে চিহ্নিত হবে, আর বিজেপি ও সংঘ পরিবারের কাছে তা হবে কাশ্মীরকে ভারতের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার শামিল। ওদিকে আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্ট (স্পেশাল পাওয়ার) বা এএফএসপিএর কী হবে? কাশ্মীরিদের কাছে এই নিবর্তনমূলক আইনটি কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতীক। আর বিজেপি মনে করে, এটা তুলে নেওয়ার মানে হলো, কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে প্রতীকী পরাজয়।
কাশ্মীর থেকে কেন্দ্রীয় সেনাদের প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিন্তু বিজেপির পক্ষে এটা করা কঠিন, চাইলে

কংগ্রেস হয়তো তা করতে পারত। কাশ্মীরিদের কাছে এর প্রভূত মূল্য রয়েছে। ওদিকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব রয়েছে। পাকিস্তান বুঝতে পেরেছে, নানা কারণেই কাশ্মীরের বর্তমান মানচিত্র বদল করা সম্ভব নয়। ফলে তারা সেখান থেকে ‘সম্মানজনক বিদায়ের’ পথ খুঁজছে। কারণ, এই কাশ্মীরের সমস্যা তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই পারভেজ মোশাররফ নতুন সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন: বিদ্যমান বন্দোবস্ত বজায় রেখে সমাধান বের করা।


ড. মনমোহন সিং মোশাররফের সূত্রের প্রতীকটা বুঝতে পেরেছিলেন। সে কারণে তিনি মোশাররফকে কাশ্মীরের ‘সীমান্তকে অপ্রাসঙ্গিক’ করে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মনমোহন সিং যে এটা যথাযথভাবে করতে পেরেছিলেন তার কারণ হচ্ছে, তাঁর ও কংগ্রেসের রাজনীতির প্রতীকী তাৎপর্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত সমাধানের অমিল ছিল না।
বিজেপি যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে পারছে না, তার একটি কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। বিজেপি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে নিজে থেকে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে মোদি যে সংকট শুরু হওয়ার এক মাস পর অনিচ্ছা নিয়ে এ বিষয়ে কথা বললেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বিজেপির কাশ্মীর নীতি ভোটের রাজনীতির আলোকে নির্ধারিত হয়। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালিত হয় জাতীয়তাবাদী প্রতীক, জাতীয় মর্যাদা, শক্তি, সভ্যতার মহত্ত্ব প্রভৃতি বর্গের ভিত্তিতে। ফলে উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাটের নির্বাচনের আগে তারা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না।

কথা হচ্ছে, কাশ্মীরের বর্তমান ‘আজাদি’ আন্দোলন আসলে নয়াদিল্লির প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। যেটা আসলে ভারতীয় ‘দখলদারি’ থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। কাশ্মীরিরা মনে করে, শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাইরের মানুষের দ্বারা শাসিত হওয়াটা আসলে প্রতারিত হওয়ার শামিল। আর নয়াদিল্লি কথা রাখতে পারেনি। তার সঙ্গে আছে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান—সবকিছু মিলে কাশ্মীরের আজ এ অবস্থা হয়েছে। এটাও ঠিক, আজাদি দাবির বাস্তব রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে।

বিদ্রোহ সব সময় প্রতীকে ঠাসা থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আখ্যানকে পরাজিত করতে অতিরিক্ত পাল্টা-প্রতীক ব্যবহার করে এবং তাদের প্রতীকী চাহিদাকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আখ্যানই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ফলে নয়াদিল্লি যদি কাশ্মীরের সমস্যার মূলে যেতে চায়, তাহলে তাকে ‘আজাদি’ আন্দোলনের প্রতীককে আমলে নিতে হবে। অর্থাৎ ‘আজাদি’ কী ও কেন, তা বুঝতে হবে।

হ্যাপিমন জ্যাকব: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

দ্য হিন্দু থেকে অনুদিত

সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৬

সাংবাদিকের প্রশ্ন, নাকি দলীয় কর্মীর স্তুতি, অনুমোদন ও সমর্থন!


সৈকত রুশদী

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ভূমিকা এবং সাংবাদিকতার সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্তত: আওয়ামী লীগের শাসনামলে। 

শনিবার (২৭ আগস্ট ২০১৬) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকদের কয়েকজনের ভূমিকা দেখে তাই মনে হয়েছে আমার কাছে। 

প্রশ্ন করার নামে সাংবাদিকদের সরকার ও সরকার প্রধানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া, সরকারের বিতর্কিত প্রকল্পের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রকাশ এবং সাংবাদিক হিসেবে সেই বিতর্কিত প্রকল্প 'অনুমোদন' করার জন্য নিশ্চয়ই সংবাদ সম্মেলনের প্রয়োজন হয়না। সেজন্য ভিন্ন, দলীয় ফোরাম রয়েছে। 

বাংলাদেশের সুপরিচিত কয়েকজন সাংবাদিকের প্রশ্নের নামে যে বক্তব্য এই প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, তা' থেকে মনে হয় সাংবাদিকতার সংজ্ঞাও বদলে গেছে। সাংবাদিক ও স্তুতিকারের পার্থক্য ঘুচে গেছে। 

সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি যদি সাংবাদিকের ব্যক্তিগত সমর্থন থেকেও থাকে, সেটি কী সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করাটা সাংবাদিক হিসেবে জরুরী? নাকি তার পিছনে অন্য কারণ আছে? বিশেষ করে টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের সময় সরকার প্রধানের প্রতি আনুগত্য, অথবা তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন প্রকাশের বিশেষ তাৎপর্য্য রয়েছে!

একজন বাদে এই সাংবাদিকরা সকলেই আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। কেউ কেউ তিন দশক বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে। এঁদের মধ্যে অন্তত: দুইজন অনুজ সতীর্থ আবার আমার ফেসবুক বন্ধুও! 

১৯৭৮ সালে সাংবাদিকতার সূচনা থেকে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে বিগত ৩৮ বছরের পেশাগত জীবনে কখনও দেখিনি বা শুনিনি যে সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকরা প্রশ্নের পরিবর্তে, অথবা প্রশ্নের আগে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকদের এবং তাদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রশংসা করতে। 

সংবাদপত্র পাঠ করতে শেখার সময় থেকে, অর্থাৎ বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে জেনে এসেছি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকরা নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান গ্রহণ করবেন। অন্তত: প্রকাশ্যে। নিজেও সেই ধারার চর্চা করে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার সব কিছুই ভুল!

টরন্টো
২৭ আগস্ট ২০১৬

নব্য জেএমবির লক্ষ্য, আইএসের সাহায্যে বৃহত্তর বাংলাদেশ স্থাপন!



জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের ৬৫ নম্বর শাখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। উদ্দেশ্য  বাংলাদেশকে ভাঙা৷ খবর কলকাতার দৈনিক ‘এই সময়‘ পত্রিকার।

সোমবার ‘এই সময়‘ লিখেছে:

আপাতত সেই শাখাই দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গোয়েন্দাদের৷ কারণ, বাংলাদেশের গুলশান হামলার পর সে দেশের জেএমবি জঙ্গিদের গ্রেফতার করে বাংলাদেশের পুলিশ জানতে পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির যে সংগঠনটি কাজ করছে, সেটাই তাদের ৬৫ নম্বর শাখা৷ মূল সংগঠনের কাছে এই শাখার পরিচিতি বৈদেশিক শাখা হিসেবে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে ভারতে এসে নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বহু মানুষ৷ আর এ বার জঙ্গি সংগঠনের বৈদেশিক শাখা খোলা হয়েছে খাস বাংলাদেশকে ভাঙার জন্য৷ কারণ, নব্য জেএমবির লক্ষ্য, আইএসের সাহায্য নিয়ে বৃহত্তর বাংলাদেশ স্থাপন করার৷

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা-ময়মনসিংহের মেন রোডের ধারে ত্রিশালে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয় জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সালাউদ্দিন এবং জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে৷ এর পরেই তারা পালিয়ে ভারতে ঢুকে গা ঢাকা দেয় বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন৷ তবে জেএমবির কাজ কারবার সবার সামনে আসে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর৷ বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পর৷ এই ঘটনার তদন্ত করে আদালতে চার্জশিটও জমা দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা৷ খাগড়াগড়ের তদন্ত করতে বাংলাদেশে এনআইএ -র একটি দলও যায়৷ তারা পলাতক ৮ জনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ঢাকাকে চিঠিও লেখে৷ পলাতকদের মধ্যে তালহা শেখ , কওসর -সহ বোমারু মিজানের নামও রয়েছে৷ ওই ঘটনায় মোট তিনজন বাংলাদেশের নাগরিক এখনও পলাতক৷ গোয়েন্দাদের বক্তব্য , জেএমবির পশ্চিমবঙ্গের শাখার মাথায় রয়েছে সোহেল মেহফুজ ওরফে হাতকাটা মেহফুজ৷ বাকি চাঁইয়েরা হল বোমারু মিজান এবং সালাউদ্দিন৷ তাদের লক্ষ্য , বাংলাদেশে নাশকতা মূলক কাজ করা৷ সম্প্রতি গুলশানের ঘটনার পর যে জেএমবি নেতাদের র্যাব গ্রেন্তার করেছে , তাদের জেরা করেই এই তথ্য সামনে এসেছে৷ ফলে এ সব তথ্য এনআইএ -কে দেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে৷ জানা গিয়েছে , মুর্শিদাবাদ , মালদহ এবং নদিয়া , এই তিন জেলা নিয়েই মূলত বৈদেশিক শাখা প্রথমে খোলা হয়৷ যার সদস্য সংখ্যা এখন বিভিন্ন জেলাতে প্রায় ১০০৷ এদের নেতৃত্বে রয়েছে হাতকাটা মেহফুজ৷ এরা মূলত মালদহ সীমান্ত দিয়ে জাল নোট এবং মাদকের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ এবং ব্যবসা থেকে উপার্জিত মোটা অঙ্কের টাকা সংগঠনের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হত৷ খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সময় থেকে এ রাজ্যে জেএমবির অস্তিত্ব জানা গেলেও , তারও বহু আগে থেকেই জামাতুল মুজাহিদিন এ পারের জমি ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নাশকতার কাজ শুরু করে৷ ফলে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সন্দেহ , কল্যাণপুর এবং নারায়ণগঞ্জের সফল অপারেশনের পর ওই সংগঠনের অনেক সদস্যই এখন পালিয়ে এ পারে এসে এখানকার সংগঠনের চাঁইদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে৷ ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা হবে বলেও দাবি করা হয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার তরফে৷ তবে গুলশান হামলার মূল চক্রান্তকারী তামিম আহমেদের মৃত্যুর ঘটনার পরে বাংলাদেশ গোয়েন্দাদের নজরে এখন নুরুল ইসলাম মারজান৷ যার পরিচিতি নব্য জেএমবির ন্যাশনাল অপারেশন কম্যান্ডার হিসেবে৷ গোয়েন্দাদের সন্দেহ, পুলিশের তত্পরতা বেড়ে যাওয়ায় সে পালিয়ে ভারতে চলে আসতে পারে৷ পাশাপাশি নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হওয়া আনসার-্আল-ইসলামের নেতা মেজর জিয়ার খোঁজেও তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ৷ নব্য জেএমবির সঙ্গে থাকলেও , মূলত মুক্তমনা লেখক এবং ব্লগারদের হত্যা করাই ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য৷ ২০১০ সালে জেএমবির নেতা আমির সইদুর রহমান ধরা পড়ার পর জেএমবির পশ্চিমবঙ্গ শাখা খোলার বিষয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা প্রথম জানা যায়৷ এমনকি , ২০০৫ সালে বাংলাদেশে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের সময় এ পারের দুষ্কৃতীদের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল বলেও ধৃতেরা জেরার জবাবে জানিয়েছে৷ ৷

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে সাংবাদিকদের করা প্রশ্ন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শনিবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সবগুলো অভিযোগ করেছেন। এর পর ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে সাংবাদিকরা তাদের প্রশ্নে যা বলেছেন, তা নিয়ে অন্য সাংবাদিকরাই বিভিন্ন সংবাদক্ষেত্রে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন। দেখে নেয়া যাক সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো কি ছিল:

মোজাম্মেল বাবু

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এরা কেউ এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ার না। আমার বন্ধু হাছান মাহমুদ ছাড়া আমিই বোধহয় একমাত্র কোয়ালিফাইড এনভায়রনমেন্টালিস্ট। তাই প্রশ্নটা প্রথমে আমি করছি। বুয়েটের যারা দাবি করেন, তারা কেউ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যাদের আমরা মিডিয়ায় বিশেষ বিশেষ পরিবেশবিদ বলি। আপনার কয়েকটি শব্দের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। পরিবেশবাদী এক জিনিস, পরিবেশ-বাণিজ্য আরেক জিনিস। পরিবেশ নিয়ে যারা আন্দোলন করেন, সেটা একটা বাণিজ্য। পরিবেশ রাজনীতি আরেকটা জিনিস। তারা পরিবেশ নিয়ে রাজনীতি করে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যারা ডলারে বেঁচে থাকে, তারা পরিবেশজীবী। পরিবেশ রাজনীতিবিদ এবং পরিবেশবিদদের নিয়ে চিন্তা করবেন না।  তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে আপনি যখন সাময়িক সমস্যার সমাধান করছিলেন, তখন তারা বলবে কেন কয়লা পুড়ছেন না। কয়লা পুড়লে সাশ্রয় হবে। আপনি কয়লা তুলতে যাবেন, বলবে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। বলবে, এমন জায়গায় করেন, যেখানে মানুষ কম। আপনি মানুষ কমের জায়গায় সিলেক্ট করলেন, তখন বলবে সুন্দরবনের এই কাছে, সেই কাছে। আপনি বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, আইসিস তৈরি করেছে ইহুদিরা। সে রকম এই সব পরিবেশবাদি আন্দোলনের পেছনে কাজ করে পেট্রোল ডলার। এই সব পেট্রোল বাণিজ্য অব্যাহত রাখার জন্যই কয়লার বিরোধিতা। আমাদের এগুলো শোনার কোনও সময় নেই। আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, ২০৩০-৪০ সাল পর্যন্ত ফুয়েল ডাইভারশনের মাধ্যমে ৫০ ভাগ সাশ্রয়ী কয়লা, ১০ শতাংশ সোলার এবং ২০ শতাংশ, ২৫ শতাংশ গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে যুগপোযোগী পরিকল্পনা আপনি করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ। আপনার দ্বারাই সম্ভব জ্বালানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমি নসরুল হামিদের (বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ) কাছে সাংবাদিক হিসেবে, আপনার (প্রধানমন্ত্রী) লেখা একটা চিরকূট দেখে বিস্মিত হয়েছি। আপনি লিখেছেন, সোলার বিদ্যুৎ করা হবে, তবে এমন জমিতে করা যাবে না, যেখানে ফসল হয়। যদি করাও হয়, তবে এটুকু গ্যাপ-গ্যাপ  দিয়ে করা হয়, যেন কিছু আলো আর কোনও না কোনও ফলন হয়। তো এই রকম একজন নেতৃত্বকে যখন পরিবেশের কথা বলা হয়, সেটা সত্যিই মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন পৃথিবীতে সব প্রযুক্তি আছে। আমাদের খালেদা জিয়া লন্ডনে গিয়ে যেই পানি খান সেটা হচ্ছে স্যুয়ারেজের পানি। স্যুয়ারেজের পানিকে রিসাইক্লিন করে লন্ডনের সিটি করপোরেশন পানের উপযুক্ত করে দিচ্ছে, এক শ শতাংশ গ্যারান্টিসহ।

পশুর নদীর পানি রিসাইক্লিন থেকে শুরু করে সব কিছুই সম্ভব। সব প্রযুক্তি আছে, শুধু আমার একটাই প্রশ্ন এই সমস্ত যেই ইঞ্জিনিয়ারিং সেটা আপনি নিজে মনিটরিং করবেন কিনা? কারণ আমাদের আস্থা একটু কম। আপনি একটি পৃথক সংস্থা করবেন। পরিবেশ, খাদ্য, জ্বালানি সব কিছু দেখার জন্য একটা বডি প্রয়োজন, সব কিছু একবারে দেখার জন্য। পৃথকভাবে দেখা সম্ভব না। আমি আপনার নেতৃত্বে এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রস্তাব দিচ্ছি, যারা এই তিনটা বিষয়ের নিরাপত্তার সমন্বয় করবে। এটুকুই আমাদের প্রস্তাব।

মোল্লা আমজাদ হোসেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিনের সঙ্গে কাজ করি। গত দুই দশক আমি জ্বালানি নিয়ে কাজ করছি। আপনাকে ধন্যবাদ, রামপাল ইস্যু বিশেষ করে কয়লা নিয়ে যেই আলোচনা হচ্ছে এজন্য। আমাদের এখানে পরিবেশবাদী ও বাম ঘেরানার রাজনীতিবিদরা একাকার হয়ে গেছেন। যেকোনও কিছুতেই তারা বিরোধিতা করেন।  বাবু ভাই যথাযথই পয়েন্ট আউট করেছেন। যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সময়ও তারা একই রকমের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা বলছেন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে, অন্য কোথাও হোক। তবে বাঁশখালীতে যখন কয়লাবিদ্যুৎ করা হচ্ছে আবার তখনও তারা বিরোধিতা করছেন। আমি নিশ্চিত তাদের উদ্দেশ্য অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানিখাতের উন্নতি, অগ্রগতি এটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আজকে যে সস্তায় জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে, তার সূত্রপাত ঘটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। নইলে আজকে আমাদের গ্যাস আমদানি করে বা বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কিনে বিদ্যুৎখাত চালাতে হতো। এমনিতেই এই একটি গোষ্ঠীর মিথ্যাচারের  কারণে আমরা নিজস্ব উচ্চমানের কয়লা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছি। এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। উপরন্তু আমরা যখন আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার উদ্যোগ নিয়েছি, তখন এই কমিউনিটি এটার বিরোধিতা করছে। যার কারণে এতদিন ধরে আমাদের মনে হচ্ছিল সরকারের মধ্যেও বিভ্রান্তি রয়েছে। কারণ সরকারের মধ্যে এমন দুই একজন মন্ত্রী আছেন, যাদের দলের লোকজনকেও আমরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখি। তখনই এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সুনির্দিষ্ট কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। এটা আমি আমার বিশ্বাস থেকে, হৃদয় থেকে নিশ্চিত। তবে সুন্দরবন অঞ্চলে শিল্পায়নের যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যদি নদীর দুই ধারে জমি দখল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, সেটা সুন্দরবনের ক্ষতি করতে পারে। পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও দূষণমুক্ত শিল্পায়নে আপনার সরকার কী করবে জানতে চাই?

গোলাম সারওয়ার

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি সমকালে কাজ করি। মোজাম্মেল বাবুর অনেক তীর্যক মন্তব্য উপভোগ করলাম। যেমন আপনি করেছেন। এতেই বোঝা যায়, আসলে প্রশ্ন করার অবকাশ খুব কম আছে। কিন্তু আপনি সুবিস্তারে এই রামপাল প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন, যে প্রশ্নগুলো আমাদের মনে ছিল এবং আছে, তার প্রত্যেকটির জবাব আপনি দিয়েছেন। সুতরাং, আপনি অনেক সময় বলেন, প্রশ্ন করেন, প্রশ্ন করেন। কিন্তু প্রশ্ন করার তেমন কিছুই নেই। আমরা আপনার সঙ্গে কিছু যোগ করতে পারি। সে ক্ষেত্রে এটি বলি যে, আপনি আজ যে কথাগুলো বললেন, আমার কেন জানি মনে হয়, আরও আগে যদি এগুলো বলা হতো, তাহলে এই পর্যায়ে তারা যেতে পারত না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি বলছি, সারা দেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করা। কালকে সংবাদপত্রে ছাপা হবে, আজকে টেলিভিশনে যাচ্ছে, কিন্তু সারাদেশে এটা চলা দরকার। যারা এর বিরুদ্ধে কাজ করছে, তারা কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। আর আমি একটা কথা বলতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে, আপনার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি দেশের ক্ষতি করছেন, দেশকে বিক্রি করছেন। কিন্তু যিনি দেশের জন্য জীবন দিতে পারেন, তাকে নিয়ে এই কথা। আমি মনে করি এর জোরালো প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বিদ্যুতের কথা বলেছেন। এই বিএনপি আমলে আমরা বিদ্যুতের কথা জানি। বিদ্যুতের অভাবে ঘুমাতে পারতাম না। এখন আমরা বিদ্যুতবিলাসী হয়ে পড়েছি। বিদ্যুৎ গেলে বিদ্যুৎ গেল কেন, এরকম বলাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরেকটি কথা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বেশ কয়েক বছর আগে সাতজন সাংবাদিক ভারত সফরে গিয়েছিলাম। আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা সারাদিন থেকেছিলাম। চমৎকার একটি গ্রাম। দেখে মনে হয় ছবির মতো সাজানো। সেখানে অ্যাশ ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা আছে। শত-শত ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, অ্যাশ নেওয়ার জন্য। আমাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছি। কি উজ্জ্বল! কি হাসিখুশি ছেলেমেয়ে! দিল্লি থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারে; আর রামপালে হতে পারবে না, এ কথা আমরা মানতে রাজি নই। আরেকটা ব্যাপার আমি বলি, শ্রীলঙ্কায় এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পর পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করেছিল। তখন একটা প্রস্তাব দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। সেটি হচ্ছে, এলএনজির মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা সম্ভব কিনা। তারা অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখেছে, এটা আর্থিকভাবে কিছুতেই সম্ভব নয়। অনেক বেশি খরচ হবে। তারা এটা নাকচ করে দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিদ্যুৎকেন্দ্র ওখানেই হবে, ওখানেই করতে হবে। দেশের স্বার্থের চেয়ে আমরা বিদেশের স্বার্থ কিছুতেই মানতে পারি না। আমরা আপনার সঙ্গে আছি।

মনজুরুল আহসান বুলবুল

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি যোগাযোগ-বিজ্ঞানের ছাত্র। যোগাযোগ-বিজ্ঞানে বলা হয়, অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় সঠিক তথ্য দিয়ে। রামপাল নিয়ে যেসব তথ্য বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তার বিপরীতে আপনি যে তথ্য দিলেন, আমরা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি তা সঠিক তথ্য। এই লড়াইটি চালু রাখতে হবে; শুধু আজকের প্রেস কনফারেন্স নয়, সব জায়গাতেই। আমি শুধুমাত্র একটি জায়গায় বলতে চাই, আজকেও আমরা একটি পত্রিকায় খবর দেখিছি যে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ১৭৭টি অর্গানাইজেশন ভারতের এক্সিম ব্যাংককে রিকোয়েস্ট করেছে, তারা যেন এই প্রকল্পটিতে অর্থায়ন না করে। এবং আপনি আপনার বক্তব্যে বলেছেন যে, এক্সিম ব্যাংক প্রায় ৭০ পারসেন্ট বিনিয়োগ করবে। এখন ১৭৭টি অর্গানাইজেশনের চাপে এক্সিম ব্যাংক যদি কোনও ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে রামপাল প্রসঙ্গে আমাদের কোনও বিকল্প চিন্তা আছে কিনা? এটা হলো এক।

আরেকটি হলো, আপনার প্রেসসচিব বলেছেন যে, এই বিষয় (রামপাল) ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে রামপালের বাইরে একটি বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাই। (এরপর প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেয়ে) আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশে আসছেন। গত কয়েক বছর ধরে আমরা ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা বিষয়ের ওঠানামা দেখেছি। সেটা কখনও জিএসপি নিয়ে, কখনও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে, কখনও পদ্মা সেতু নিয়ে। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, ওবামা প্রশাসনের শেষ মুহূর্তে জন কেরি কি বিশেষ কোনও বার্তা নিয়ে আসছেন?  কৌশলগত কোনও বিষয়ে ঐকমত্যের ব্যাপার আছে?

রেজওয়ানুল হক রাজা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করি। পার্লামেন্ট সেশন কাভার করতে গিয়ে একটি টার্ম আপনাদের কাছ থেকে শিখেছি। সেটা হচ্ছে, বিএনপি রিসেন্টলি এই ইস্যুতে যুক্ত হয়েছে। গত পরশুদিন তারা ব্রিফিং করেছে। তাদের ওই বক্তব্যের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে। আমি তা বাদ দিচ্ছি। বাট রামপাল নিয়ে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন হচ্ছে। এবং আজ আপনি অনেক তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন। তারা যখন ব্রিফিং করেন, নানা তথ্য-উপাত্ত দেন। কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা, আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা তা অতোটা বুঝতে পারি না। আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই যে, জঙ্গিবাদের কারণে আমরা দেশের মধ্যে একটা অস্বস্তির মধ্যে আছি। এই মুহূর্তে এই রামপাল ইস্যু নিয়ে যদি একটা গোলযোগ হয়, সেটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হবে। যারা আন্দোলন করছেন, তাদের মধ্যে আপনার একজন বন্ধুও আছেন; এটা সম্ভব কিনা—তাদের সঙ্গে বসে একটা আলোচনা করে বিষয়টি রিকনসিডার করার সুযোগ আছে কিনা?    

শাবান মাহমুদ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাতে কাজ করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই দেশে যখন স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল আপনার বাবার নেতৃত্বে, তখন একটি অংশ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। আবার আপনি যখন ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়নে বারবার কাজ করছেন, তখন আমরা দেখেছি, ওই অংশেরই একটা অংশ, যারা উত্তরাধিকার সূত্রে বংশ পরস্পরায় তারা বেড়ে উঠেছে, তারা আপনার বিরোধিতা করে আসছে। এর ফলে আমরা দেখি, বাংলাদেশের উন্নয়নের বিপক্ষে একটি গ্রুপ বরাবরই সক্রিয় রয়েছে। তার ভেতর দিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারপ্রধান হিসেবে কেবল আপনার কাছে আমি জানতে চাইব, এই অংশটি দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর।  তারা যদি ক্ষতিকর হয়ে থাকে, দেশপ্রেমী জনগণ তাদের কিভাবে বয়কট করতে পারে? সরকারপ্রধান হিসেবে, উন্নয়নের নেত্রী হিসেবে, দেশের একজন গণমানুষের নেত্রী হিসেবে আপনি কী মনে করেন?


আনিস আলমগীর

আমি এশিয়ান টিভিতে কাজ করি। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতি অনুপস্থিত। আমি দেখছিলাম, রামপাল ইস্যুতে আন্দোলন করছিল বাম রাজনৈতিক দলগুলো। তো হঠাৎ করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যুক্ত হওয়াতে আপনি কি মনে করেন, ভারতবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে একটা ট্রামকার্ড হিসেবে ইউজ হবে? আর আমার সেকেন্ড কোশ্চেন হচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে রামপাল নিয়ে আমার নিউট্রাল পজিশন ছিল। আর আজ আপনার প্রেজেন্টেশনের পরে আমার মনে হচ্ছে যে, বিদ্যুৎ প্রকল্প যে দরকার, এটা নিয়ে আমার আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা বিষয় ক্লিয়ার হইনি আমি। টাকাটা আমরা দিচ্ছি। কিন্তু বিদ্যুৎ ভাগের ক্ষেত্রে ফিফটি-ফিফটি কেন? এটা কিন্তু সোস্যাল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার আছে, বিদ্যুৎটা অর্ধেক নিয়ে যাবে কেন?

শেখ নাজমুল হক সৈকত

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি এটিএন বাংলায় কাজ করি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, রামপাল নিয়ে বাম দলগুলো বিরোধিতা করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএনপি। তাদের এই বিরোধিতার কারণে কি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যহত হবে কিনা? আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে, আজকে এক মাস্টারমাইন্ড জঙ্গি নিহত হয়েছে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি।

সৌজন্যে বাংলা ট্রিবিউন


মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না: প্রধানমন্ত্রী


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।

শনিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধীদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মনে হচ্ছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। বিরোধীদের কথায় আমার কিছু যায়-আসে না। আপনাদের কথায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলে বিদ্যুৎ পাবেন না। হারিকেন নিয়ে অন্ধকারে বসে থাকতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। ভবিষ্যতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে শংকা রয়েছে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি হবে না। ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক যুক্তি দিয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। আর এর পেছনে উসকানি রয়েছে বিএনপির।'  

প্রধানমন্ত্রী বলেন, '১৯৯৬ সালে আমরা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছিলাম। তখন আমরা উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা পরের বার ক্ষমতায় যেতে পারিনি। এরপর ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমরা করণীয় ঠিক করি। এরই অংশ হিসেবে নির্মাণ করি একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র।'

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সস্তা পরিবহনের জন্য নদীর কাছেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়। যোগাযোগ সুবিধার কারণে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে।’ এসময় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনে আছে, বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রকল্প নির্মাণ করা যাবে না। আমরা সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করছি। তবুও বলা হয়, ভারত কেন ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে তাদের দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে দেয়নি। আমি বলবো, ভারতের মতো বড় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের তুলনা করা ঠিক না। এখানকার লোকের বিদ্যুতের চাহিদা বেশি এবং রিসোর্স অনেক কম।’

রামপালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। গত ১২ জুলাই বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট বাস্তবায়নে মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ পরিবেশবাদীদের অনেকে দাবি করে আসছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বহুল আলোচিত হওয়ার কারণ এর নির্মাণস্থল ও পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ)। কেন্দ্রটির নির্মাণস্থল সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তসীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে।

রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা আছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে তার চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি খরচ হবে। রামপাল প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ১৫ বছরের জন্য কর মওকুফ করেছে, যার আর্থিক মূল্য ৯৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে কয়লা আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নদী খনন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের খুটির জোর এতোদিন পাওয়া যায়নি। এবার আন্দোলনের খুটির জোর পাওয়া গেছে। বিএনপি নেত্রী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এসেছেন। আমার মনে হয় এটার মধ্যে ষড়যন্ত্র আছে। তাহলে এতোদিন বিএনপি নেত্রী বিরোধীতা করেননি কেন। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে যদি কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই থাকত, তাহলে তারা অনেক আগেই তা জনসম্মুখে প্রকাশ করত। বিরোধীতাকারীরা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে নাকি সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আসলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।

রামপাল বিদ‌্যুৎকেন্দ্র যে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না_তা জোরালোভাবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্প সরানোর দাবি প্রত‌্যাখ‌্যান করেন।

প্রধানমন্ত্রী লিখিত বক্তব‌্যে বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু ভালো মনে হবে, আমি সেগুলো করব। আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আমি এমন কোনো কাজ আগেও করিনি, ভবিষ্যতেও করব না যা দেশের এবং দেশের মানুষের সামান্যতম ক্ষতি করে।

শেখ হাসিনা বলেন, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে সর্বাধুনিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে এতে সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং এই প্রকল্প থেকে বছরে ৩০ কোটি টাকা সিএসআর ফান্ডে জমা হবে; যা এলাকার মানুষের উন্নয়নে ব্যয় হবে।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এখানে যে কয়লা ব্যবহার করা হবে তার গুণগত মান অনেক উন্নত। এসব কয়লা আসবে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।

রামপাল নিয়ে আন্দোলনে অর্থায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, এই যে শত শত মানুষ একখানে করে রোডমার্চ করে। বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের জন‌্য ফুয়েল লাগে, উনারা ফুয়েল কোথা থেকে পাচ্ছেন?

পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পুরো বক্তব্য 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

আসসালামু আলাইকুম এবং শুভ অপরাহ্ন।

আপনারা জানেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রধান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু গ্যাসের মজুদ দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আর গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। মূল্য এবং প্রাপ্যতার দিক থেকে বিচার করলে কয়লা-ই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি। তাই উন্নত দেশগুলো যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের মোট বিদ্যুতের ৪০ থেকে ৯৮ শতাংশ উৎপাদন করে কয়লা দিয়ে। বাংলাদেশে কয়লা দ্বারা উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশের সামান্য বেশি (১.৩৩%)।

দেশের অব্যাহত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ এবং যৌক্তিক মূল্যে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য সরকার দেশে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। রামপালে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এগুলোর মধ্যে একটি।

কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে দেশের উন্নয়ন-বিরোধী একটি মহল বেশ কিছুদিন যাবত ভিত্তিহীন, কাল্পনিক ও মনগড়া বক্তব্য এবং তথ্য দিয়ে এ প্রকল্প সম্পর্কে মানুষের মনে এক ধরণের  নেতিবাচক মনোভাব এবং ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছিল। অবশেষে গত ২৪ আগস্ট থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। এতদিন অন্তরালে থেকে ইন্ধন যোগালেও, ঐদিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রেস কনফারেন্স করে এই অপপ্রচারে প্রকাশ্যে সামিল হয়েছেন।

আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে বিএনপি’র এই অপপ্রচারে প্রকাশ্যে যোগ দেওয়ার পিছনে গভীর কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। তা নাহলে এ কেন্দ্রটির কাজ শুরু করার এতদিন পর এ ধরণের প্রতিক্রিয়া কেন আসবে? এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে যদি কোন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই থাকত, তাহলে তারা অনেক আগেই তা জনসম্মুখে প্রকাশ করত।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতাকারীরা বলতে চাচ্ছেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে নাকি সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আজকে আমি আপনাদের সামনে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে প্রমাণ করে দিব, বাস্তবায়নাধীন রামপাল-বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোন ক্ষতি করবে না।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

প্রথমেই আমাদের ঐক্যমতে আসতে হবে আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে কি না। আমার মনে হয় না, দেশের কোন নাগরিকই এক মিনিট বিদ্যুতবিহীন অবস্থায় থাকতে চাইবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকার এসেছে, সরকার গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোন টেকসই পরিকল্পনা কেউ গ্রহণ করেনি। আর আমাদের প্রাক্তন বিরোধীদল বিএনপি’র তো কোন কথাই নেই। ১৯৯১ সালের পর দু’দুবার সরকারে থেকেছে, কিন্তু এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। বরং ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে শুধুমাত্র খাম্বা কেনা-বেচার ব্যবসা করেছে। খাম্বা বেচাকেনায় নাকি লাভের পরিমাণ বেশি ছিল।

১৯৯৬ সালে আমরা যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেই তখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬০০ মেগাওয়াট। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেই। ৫ বছর পর দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪৩০০ মেগাওয়াট।

এরপর আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ২ বছর সামরিক-বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা পেলাম মাত্র ৩২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সাত বছরে ১১০০ মেগাওয়াট নেই। চারদিকে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার, অসহ্য লোডশেডিং। কলকারখানায় উৎপাদন বন্ধ। বিদ্যুতের অভাবে নতুন কলকারখানা স্থাপনের কোন উদ্যোগ নেই। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া চাপাইনওয়াবগঞ্জে বিদ্যুতের জন্য আন্দোলনরত গ্রামবাসীর উপর গুলি চালিয়ে ১৪ জন মানুষকে হত্যা করে।

২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। আমরা সেই লক্ষ্যমাত্রা ধরে স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদী পথনকশা তৈরি করি।

স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় আমরা কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেই। কারণ একটি বড় প্লান্ট তৈরি করতে ৯/১০ বছর সময় লেগে যায়। আপনারা লক্ষ্য করেছেন, সে সময়ও একদল মানুষ এর বিরোধিতা করেছিল।

বিগত সাড়ে সাত বছরে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছি। ১০৫টির মত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ৭৮ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ১ কোটি ১২ লাখ নতুন গ্রাহকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কুইক-রেন্টাল কোন স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় কয়লার ব্যবহার ছাড়া কোন উপায় নেই। অন্য বিকল্প পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আমরা সেদিকেও অগ্রসর হচ্ছি। রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। আমরা যখন স্থায়ী এবং টেকসই পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের দিকে যাচ্ছি, আবারও সেই মহল এর বিরোধিতা শুরু করেছে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজন সস্তা পরিবহন ব্যবস্থা। সেজন্য কয়লা খনির কাছাকাছি অথবা সমুদ্র উপকূল বা গভীরতা-সম্পন্ন নদীর তীরে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়ে থাকে। আরেকটি বিবেচ্য দিক হচ্ছে যতদূর সম্ভব কম সংখ্যক মানুষের স্থানান্তর করা। আমরা প্রাথমিকভাবে যেসব কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি সেগুলোর স্থাপিত হবে রামপাল, মাতারবাড়ি, পায়রা, আনোয়ারা, খুলনা এবং মুন্সিগঞ্জে। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন এবং সিঙ্গাপুর এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা করছে।

বিএনপি নেত্রীর বৃহস্পতিবারের বক্তব্য অনেকটা ‘মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি’-এর মত। ১৯৯৭ সালে আমাদের সরকারের উদ্যোগে সুন্দরবনকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করি।

আন্তর্জাতিকভাবে গভীর বনভূমির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার আইন আছে। আমাদের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের প্রান্ত সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই এলাকার বায়ুপ্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে। অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ ক্ষতিকারক বায়বীয় পদার্থও যদি নিঃসরণ হয়, তবে তা সুন্দরবনের দিকে নয়, উল্টোদিকে প্রবাহিত হবে।

বিএনপি নেত্রী তাঁর পুরো বক্তব্যে উদ্ভট, বানোয়াট এবং অসত্য উপাত্ত পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন।

আমি কতগুলো উদাহরণ দিচ্ছি:

#    উনি বলেছেন ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির উপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে। আসলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জায়গা নেওয়া হয়েছে ৯১৫ একর। এর মধ্যে ৪৬৫ একরে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকবে। বাদ বাকী জায়গায় সোলার প্যানেল বসবে এবং সবুজায়ন (Green Belt) করা হবে।

#    তিনি বলেছেন, যে স্থানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে নাকি জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৮২ জন। আট হাজারের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। জমি তিন ফসলী। প্রকৃতপক্ষে এলাকাটিতে মানুষের কোন স্থায়ী বসতি ছিল না। কোন বসতি উচ্ছেদ করা হয়নি। নীচু, পতিত জমি মাটিভরাট করে উঁচু করা হয়েছে।

#    তিনি বলেছেন: রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পশুর নদী থেকে প্রতি ঘন্টায় ১৪৪ কিউসেক পানি নেওয়া হবে। ব্যবহারের পর সেই পানি নাকি পরিবশে দূষণ করবে। তাঁর এই বক্তব্য সঠিক নয়। পশুর নদীর পানিতে লবন আছে। সেই পানি শোধন করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। ব্যবহৃত পানি শীতল করে পুনরায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। কোন দূষিত বা গরম পানি পশুর নদীতে ফেলা হবে না। যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হবে তা অত্যন্ত নগণ্য। শুষ্ক মওসুমে পশুর নদীর প্রবাহের মাত্র (০.০৫%) দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ অর্থাৎ ২ হাজার ভাগের এক ভাগ পানির প্রয়োজন হবে।

#    এই পশুর নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করা হবে। পানি চলাচল বাড়বে। নাব্যতা বৃদ্ধি পেলে মংলা বন্দরে নৌযান চলাচল বৃদ্ধি পাবে। আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

#    উনি ভারতে বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটার মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আইনী বাধার কথা বলেছেন। ভারত একটি বিশাল আয়তনের দেশ। বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের সঙ্গে তুলনা সঠিক নয়।

# কয়লা পরিবহনের সময় সুন্দরবন এলাকায় শব্দ দূষণ, আলো দূষণ ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন। আমরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ। শব্দ ও আলো দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য আমরা সব ধরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। গভীর সমুদ্র হতে কাভার্ড বার্জে কয়লা পরিবহন করা হবে। বার্জে ব্যবহৃত হবে ঢাকনাযুক্ত কম শব্দযুক্ত ইঞ্জিন। ফলে পরিবেশ দূষণের কোন সম্ভাবনা নেই। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শব্দ দুষণ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকবে। ১৪ কিলোমিটার দূরে শব্দ যাবেনা। ২০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

#    উনি আমেরিকার টেক্সাসে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের কথা বলেছেন। কিন্তু কত সংখ্যক কয়লাভিত্তিক প্লান্ট চালু আছে তা কি তাঁর জানা আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে কয়লা থেকে। সেখানে ৭ হাজারের বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে।

# তিনি বলেছেন বিদ্যুতের দাম নাকি ৮.৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ অসত্য কথন। এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে কয়লার দামের উপর ভিত্তি করে।

#    ভারতের NTPCএবং আমাদের পিডিবি’র সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। উভয় সংস্থা ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করবে। বাকী ৭০ শতাংশ দিবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। এই ৭০ শতাংশ অর্থায়নের ব্যাংক গ্যারান্টর থাকবে বাংলাদেশ। অজ্ঞাতবশতঃ কেউ কেউ এটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। গ্যারান্টর হওয়া মানে তো বিনিয়োগ করা নয়। কোন কারণে যদি কোম্পানি ব্যর্থ হয়, তখন ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসবে। সে রকম হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। একটা ব্যক্তিগত লোন নিতে গেলেও তো গ্যারান্টর লাগে। আর স্থাপনা যেহেতু বাংলাদেশে, গ্যারান্টর হতে তো কোন দোষ দেখি না। বাংলাদেশের স্থাপনায় ভারত কেন গ্যারান্টর হতে যাবে?

#    রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ মান বজায় রাখার জন্য আমরা বিশ্বের প্রথিতযশা ফার্ম জার্মানীর ফিশনার (Fichtner) গ্রুপকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি। কাজেই কাজের মান নিয়ে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। আমরা এ বিষয়ে কোন আপোষ করব না।

#    তিনি বলেছেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নাকি লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করবে। এ কথা মোটেই সত্য নয়। বরং, এটি নির্মিত হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।  সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষের চুরি করে গাছ কাটার প্রয়োজন হবে না। এলাকার লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হবে। কোম্পানি থেকে বছরে ৩০ কোটি টাকা সিএসআর ফান্ডে জমা হবে। তা দিয়ে এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কাজ করা হবে।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

একটা কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে উন্নত প্রযুক্তি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে। রামপালে আমরা আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি। একটি সাধারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা পোড়ানোর দক্ষতা যেখানে ২৮%, সেখানে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্টের দক্ষতা ৪২-৪৩%। অর্থাৎ একই পরিমাণ কয়লা পুড়িয়ে আমরা দেড়গুণ বিদ্যুৎ পাব। সবচেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন কয়লা এখানে ব্যবহার করা হবে। কয়লা আমদানি করা হবে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।

দূষণ প্রতিরোধে সর্বাধুনিক যত ধরণের প্রযুক্তি পাওয়া যায় সেগুলো আমরা ব্যবহার নিশ্চিত করব। ফ্লু গ্যাস টেম্পারেচার, নাইট্রোজেন, সালফার-ডাই-অক্সাইড কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদির নিঃসরণ পর্যবেক্ষণের জন্য রিয়েল টাইম কন্টিনিউয়াস এমিশন মনিটরিং সিস্টেম (CEMS)  থাকবে। যাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। পাশাপাশি অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি বসানো হবে।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইএসপি (Electro-static Precipitator) থাকবে যা উদগীরণকৃত ফ্লাই অ্যাসের ৯৯.৯৯ শতাংশ ধরে রাখতে সক্ষম হবে। এই ছাই সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত হবে। একইভাবে এফজিডি (Flue gas desulphurization) স্থাপনের ফলে ৯৬ শতাংশ সালফার গ্যাস শোষিত হবে। এই সালফার গ্যাস থেকে জিপসাম সার তৈরি হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনীর উচ্চতা হবে ২৭৫ মিটার। এই চিমনি দিয়ে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হবে তা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য যে সমস্ত গ্যাস সামান্য পরিমাণে বের হবে সেগুলোর ঘনত্ব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক কম থাকবে।

যারা বলেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ক্ষতি করে, তাদের একটু বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘুরে আসতে বলছি। বড়পুকুরিয়া একটি সাব-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট। সাব-ক্রিটিক্যাল এবং আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্লান্টের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। সাব-ক্রিটিক্যালের তুলনায় সুপারক্রিটিক্যালে ৪০ শতাংশ কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাস নিঃসরণ কম হয়। আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্লান্টে যে কোন দূষণের মাত্রা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করি ২০০০ সালে। খালেদা জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করেনি। তখন পরিবেশের জন্য তো মায়াকান্না করেননি।

বরং ফুলবাড়িতে ওপেনপিট কয়লা খনির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মানুষের উপর গুলি করে আধা ডজন মানুষ হত্যা করেছিল খালেদা জিয়া।

সাব-ক্রিটিক্যাল প্লান্ট ব্যবহার করলেও ঘনবসতি এবং সবুজে ঘেরা বড়পুকুরিয়া এলাকায় বিগত দশ বছরে পরিবেশ এবং জনজীবনে কোন বিরূপ প্রভাব পড়েনি। উল্টো সেখানকার জমি আরও ঊর্বর হয়েছে। ফসল ভালো হচ্ছে।  (ছবি)

বিশ্বের বহুদেশে বনভূমির মাঝখানে, শহরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

আমি কিছু দেশের বনভূমির কাছাকাছি এবং ঘনবসতি এলাকায় স্থাপিত কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ এবং ছবি আপনাদের দেখাতে চাই।

-যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া কোল পাওয়ার প্লান্ট, ক্ষমতা ১৩০০ মেগাওয়াট। ন্যাশনাল পার্কের এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। ২০১৫ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মোট বিদ্যুতের ৯৪ শতাংশ কয়লা থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

-কুয়াং নিন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভিয়েতনাম, ১২০০ মে.ওয়াট। হ্যালং বে (উইনেস্কো ঐতিহ্য) এর মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে।

-ইসোগো বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইওকোহোমা, জাপান, ১২০০ মেগাওয়াট। আবাসিক এলাকার সন্নিকটে।

-তাইচুং বিদ্যুৎ কেন্দ্র, তাইওয়ান, ৫৫০০ মেগাওয়াট। শহরের প্রাণকেন্দ্রে।

-জলিং বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জার্মানি, ৫০০ মেগাওয়াট। অ্যামপার নাটুরা ২০০০ এর বিশেষায়িত সংরক্ষিত এলাকা থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে।

-হেইলব্রোন হ্যাফেন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জার্মানি, ৭৫০ মেগাওয়াট। শহর সংলগ্ন এবং নদী তীরবর্তী।

-ক্রাফটওয়ার্ক-মুরবার্গ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জার্মানি, ১৬০০ মেগাওয়াট। শহর সংলগ্ন এবং নদীর তীরে।

-রেইনহফেন ড্যাম্ফক্রাফট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জার্মানি, ১৪৬২ মেগাওয়াট। শহর সংলগ্ন এবং নদীর তীরবর্তী।

এরকম শত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দেওয়া যাবে যেগুলো বনাঞ্চলে বা ঘন বসতি এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। কোন দেশে কেউ এসব নিয়ে এমন হৈচৈ করে না। কিন্তু আমাদের দেশের জ্ঞানপাপীরা হৈচৈ করছে। এরা কারা? এরা নিজেরা ভালো কিছু করতে পারে না, আবার কেউ ভালো কিছু করতে গেলে তাতে বাধা দেয়। রামপালে সুন্দরবনের কথা বলে বিরোধিতা করছে, কিন্তু আনোয়ারায় সে সুন্দরবন নেই। কিন্তু সেখানেও বিরোধিতা করছে কেন? এদের কথা শুনতে গেলে তো কোন উন্নয়ন কাজেই হাতে নেওয়া যাবে না।

কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট যদি এতই দূষণ সৃষ্টি করত, তাহলে জাপানের মত দেশ নতুন নতুন কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট তৈরির উদ্যোগ নিত না। ক’দিন আগে জাপান সরকার ৭০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। চীনে প্রায় ৩০০ কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ কাজ চলছে।

আরেকটা কথা বলি। এই যে শত শত মানুষ জড় করে রোডমার্চ করে, সমাবেশ করে, এগুলো করতে টাকা কে দেয়? পকেটের পয়সা থেকে কেউ নিশ্চয়ই খরচ করে না। এরা বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির দাবার ঘুটি। তাদের এজেন্ট হয়ে কাজ করে। এসি-লাগানো বাড়িতে থেকে, এসি গাড়িতে ঘুরে মানুষকে হয়ত সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু মানুষ ঠিকই এসব মতলববাজদের এজেন্ডা বুঝতে পারে।

আপনারাই দেশপ্রেমিক, সুন্দরবন প্রেমিক; আপনারাই শুধু পরিবেশ বোঝেন আর আমরা কিছুই বুঝি না! একটা কথা বলে রাখি, যদি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দবনের সামান্যতম ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তাহলে আমিই হতাম প্রথম ব্যক্তি যে এটা স্থাপনের বিরোধিতা করত।

সুন্দরবন সংরক্ষণের জন্য আমিই প্রথম ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছি। আজকে যে সুন্দরবন আমরা দেখছি ১০০ বছর আগেও এর ব্যাপ্তি অনেক বড় ছিল। ছোট হতে হতে আজকে এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সুন্দরবন কি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য এভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা দূষণ ভৌগলিকভাবে সীমাবদ্ধ নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কোন কারণ সুদূর আমেরিকায় ঘটলে, তার প্রভাব আমাদের এখানেও পড়বে। তাহলে আমেরিকা, জাপান, চীন, ভারতকে বলুন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ রাখতে।

সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ মরে গেছে। মানুষ গাছপালা কেটে সাবাড় করেছে। মানুষের যাতে সুন্দরবনের উপর নির্ভর করতে না হয়, সে জন্য আমরা তাঁদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। সুন্দরবনে নতুন করে বৃক্ষরোপনের ব্যবস্থা করেছি। গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আমাদের নেওয়া পদক্ষেপের ফলে সুন্দরবনের আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছের ঘনত্ব বাড়ছে।

উপকূল এলাকায় সবুজবেস্টনী সৃষ্টি করা হয়েছে। নতুন জেগে উঠা চরে বৃক্ষ রোপন করে সেগুলোর ভূমিক্ষয় রোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

 বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আমরা আইন তৈরি করেছি। বাঘ সংরক্ষণে টাইগার অ্যাকশন প্লান গ্রহণ করেছি। আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে দেশে বনভূমির পরিমাণ ২০০৫-০৬ সালের ৭-৮ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪-১৫ সালে ১৭.০৮ শতাংশ হয়েছে।

পরিবশে সংরক্ষণে আধা ডজনের বেশি আইন করেছি। পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য আমরা সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনেছি। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে ১৮ ক নামে একটি নতুন সংযোজন করেছি।

গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়ায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। বিএনপি সরকার এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। আমরা ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পাদন করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করি। ফলে ঐ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েছে। আমরা গড়াই নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু করেছিলাম ২০০১ সালে। বিএনপি এসে তা বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আবার তা শুরু করেছি।

পরিবেশের নাজুকতা সম্পর্কে সামান্য হলেও আমার যেমন ধারণা আছে, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষমতার উপরও আমার পূর্ণ আস্থা আছে। প্রযুক্তিকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। আগে কলেরায়, কালাজ্বরে, গুটি বসন্তে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। মানুষের আবিষ্কৃত ওষুধে জীবনহানি বন্ধ হয়েছে।

কয়লা পোড়ালে ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসরণ হবে- এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা এমন সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, যেগুলো ক্ষতিকারক পদার্থগুলোকে পরিবেশে ছড়াতে দিবে না। উল্টো সেগুলোর কোন কোনটিকে রাসায়নিকভাবে পরিবর্তন করে মানুষের উপকারি বস্তুতে পরিণত করা হবে।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি এটা অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। বাংলাদেশ কেন এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশ কেন স্বনির্ভর হবে, মানুষ কেন ভালো থাকবে - এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না। এজন্যই একটা অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করছে তারা।

যারা নিজেদের পরিবেশবাদী হিসেবে জাহির করেন, তাদের কাছে প্রশ্ন: পরিবেশ সংরক্ষণে একটা গাছ লাগিয়েছেন জীবনে? নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করুন, যা করছেন সেগুলো কি মানুষের মঙ্গল বয়ে আনবে? ভুল, মনগড়া, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। আপনারা যেসব তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করছেন, সেগুলো ৬০’র দশকের। বিশ্ব অনেক বদলে গেছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। এসব মান্ধাতা আমলের তথ্য দিয়ে জনগণকে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

২০১৩-১৫ সালে পেট্রোল বোমা মেরে একশোর বেশি মানুষ হত্যা করে, জঙ্গিদের মদদ দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ মেরে, হলি আর্টিজান এবং শোলাকিয়ায় ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে, ফায়দা আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেত্রী এবার ভাবছেন, একটা মওকা পাওয়া গেছে! রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র-বিরোধী আন্দোলনকে উস্কে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবেন। জনগণকে অত বোকা ভাববেন না। জনগণ আপনার দুরভিসন্ধি বোঝে।

একটা নন-ইস্যুকে ইস্যু করে কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে চায়, তাহলে তা কঠোর হাতে দমন করতে আমরা পিছ পা হব না।

দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু ভালো মনে হবে, আমি সেগুলো করবই। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ, আপনারা আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আমি এমন কোন কাজ আগেও করিনি, ভবিষ্যতেও করব না, যা দেশের এবং দেশের মানুষের সামান্যতম ক্ষতি করে। রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াদের অপপ্রচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না।

আসুন, আমরা সকলে মিলে এই বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলি। সবাইকে ধন্যবাদ।

খোদা হাফেজ।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

'কোথাও কোন ক্রন্দন নেই'-এর কবি শহীদ কাদরীর (১৯৪২-২০১৬) প্রয়াণ!

কবি শহীদ কাদরী

সৈকত রুশদী

পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলা কবিতার অগ্রগামী পথপ্রদর্শক কবি শহীদ কাদরীকে। অসুস্থতার সাথে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যিনি চিরবিদায় নিয়েছেন আজ (২৮ আগস্ট ২০১৬) সকালে। নিউ ইয়র্কের নর্থ শোর হাসপাতালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪।

আমার তারুণ্যে, কবিতা লেখার প্রথম প্রহরে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ও পরবর্তীকালে তুমুল আলোড়িত হয়েছি তাঁর কবিতায়। মননে, উপমা নির্বাচনে, শব্দ চয়নে ও প্রয়োগ কৌশলে সাহস ও নান্দনিকতা বোধের এক অনুপম যুগলবন্দী উপস্থাপনায় কেবলই অবিমিশ্র মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়েছি। কবিতার প্রতি ভালবাসা আরও দৃঢ় হয়েছে।
বিরলপ্রজ এই প্রতিভাকে সংখ্যার হিসাবে তাঁর মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থ 'উত্তরাধিকার', 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা', 'কোথাও কোন ক্রন্দন নেই' ও 'আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও' এবং কিছু অগ্রন্থিত রচনার মধ্য দিয়ে বিচার করা যাবেনা। তাঁর মুক্তার মতো নির্বাচিত শব্দগুলো মিলিতভাবে এক টুকরো হীরকখন্ডের মতো দ্যুতিময় একেকটি কবিতা হয়ে উঠেছে।

নিভৃতচারী, স্বল্পবাক ও প্রচারবিমুখ এই কবিকে ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে দেখেছি ঢাকায়, কবিতার আসরে অথবা অন্য কোনখানে, কিন্তু বিনম্র সৌজন্য প্রকাশ ছাড়া কথা বলা হয়ে ওঠেনি। কাছে গেলে মনে হয়েছে এতো সুন্দর করে যিনি সৃষ্টি করেন কবিতা, সেই প্রজ্ঞার কাছে আমার কিইবা বলার আছে শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়া!

সঙ্গতি / শহীদ কাদরী

(অমিয় চক্রবর্তী, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের- তোমরা দু'জন একঘরে পাবে ঠাঁই
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
(কাব্যগ্রন্থ : কোথাও কোন ক্রন্দন নেই)