বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬

মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কেরির সাথে বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন


সমশের মবিন চৌধুরী

ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনা ও জন কেরিমার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফর নানা বিবেচনাতেই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই জানি যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈরী অবস্থান ছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে তারা পরিষ্কারভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত নতুন ও পুনরায় নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। ওয়াশিংটন থেকেও তখন এবং পরে বিভিন্ন সময়ে একই ধরনের মনোভাব পাওয়া গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেই নির্বাচনের প্রায় আড়াই বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরের খুবই তাৎপর্য রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের একজন ও গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশ সফর আমাদের সরকারের জন্য স্বস্তি ও সন্তোষের একটি বিষয়। এই সফরের মূল যে দিকটি আলোচনায় রয়েছে তা হচ্ছে নিরাপত্তা ইস্যু ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা। এটা আমরা সবাই জানি যে আন্তর্জাতিক এই সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জঙ্গিদের সামাল দিতে বাংলাদেশেরও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাহায্য-সহযোগিতা জরুরি। আমরা জেনেছি যে এসব বিষয় নিয়ে এই সফরের সময়ে আলোচনা হয়েছে এবং দুই পক্ষই এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের ব্যাপারে তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনীতির মতো কূটনৈতিক সম্পর্কও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এটাই রাজনীতি ও কূটনীতির সৌন্দর্য।


তবে এই সহযোগিতার ধরন বা এর আকার কী হবে বা হতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। আর এ ধরনের একটি সফরে এসব বিস্তারিত ঠিক করাও সম্ভব হয় না। এ ধরনের সফরে দুই পক্ষের অবস্থান ও মনোভাব পরিষ্কার করা হয়। তার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলো ঠিক করা হয়। আর আমরা জানি যে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে গেছেন। নিরাপত্তা সহযোগিতা বা জঙ্গিবাদ মোকাবিলার বিষয়টির একটি দ্বিপক্ষীয় দিকের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দিকও রয়েছে। ফলে এ বিষয়গুলো সামনের দিনগুলোতে পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। আমাদের সরকারের তরফে তাদের অবস্থান ও চাওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বাণিজ্য ক্ষেত্রে তেমন কিছু হওয়ার সুযোগও নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের নানা বিষয়গুলো কংগ্রেসের ওপর নির্ভর করে। ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলেও যুক্তরাষ্ট্রে তা পায় না। এই বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জন কেরির বাংলাদেশ সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাঁর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন। তিনি সেখানে গেছেন এবং পরিদর্শক বইয়ে আবেগঘন মন্তব্য করেছেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বঙ্গবন্ধুর এক খুনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। এই সফরের সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এখন কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

গণতন্ত্র, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার—এ বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই কথা বলে। নাগরিক সমাজের সমাবেশে এই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। জন কেরির সফরের আরও একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের দেশে যে প্রধান বিরোধী দল ও এর নেতা রয়েছেন, তাঁরা খুব গুরুত্ব পাননি। এই বিরোধী দলকে যুক্তরাষ্ট্র খুব বিবেচনায় নিচ্ছে বলে মনে হয় না।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। তবে বৈঠকটি হয়েছে মার্কিন দূতাবাসে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দূতাবাসে গিয়ে বৈঠক করার বিষয়টি কেমন হলো, সে প্রশ্ন উঠেছে। এই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা বিএনপি মহাসচিবের তরফে আমরা জেনেছি। আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জঙ্গিবাদ—এসব প্রসঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায়। এখন বিএনপির তরফে এর বাইরে কী বলা হয়েছে বা নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা চাওয়া হয়েছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। ফলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কি না, তা আমরা জানি না।

জন কেরির এই সফরের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের ব্যাপারে তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনীতির মতো কূটনৈতিক সম্পর্কও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এটাই রাজনীতি ও কূটনীতির সৌন্দর্য।

সমশের মবিন চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন