বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬

কী এই এলইএমওএ (লেমোয়া )?

চীন-পাকিস্তানকে ‘রাগিয়ে’ ভারত-মার্কিন ঐতিহাসিক ‘লেমোয়া’ প্রতিরক্ষা চুক্তি
➠ দুই দেশ পরস্পরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে৷ স্থল, বায়ু ও নৌসেনা ঘাঁটির দরজা খুলল 
➠ ভারত ও আমেরিকা পরস্পরের সেনাবাহিনীকে রসদ জোগাতে পারবে৷ মিলবে খাদ্য -বস্ত্র থেকে চিকিৎসা পরিষেবা৷ জ্বালানি সংগ্রহ থেকে সামরিক যান মেরামতিতে সবুজ সঙ্কেত
➠ সন্ত্রাস মোকাবিলা, সমুদ্র নিরাপত্তা ও বিশেষ অভিযানের ক্ষেত্রে সুবিধা মিলবে৷ মানবিক সাহায্য ও ত্রাণকাজ আরও দ্রুত করা সম্ভব
দৈনিক এই সময়, কলকাতা

পাকিস্তান ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন৷ চীন উত্তেজিত৷ এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও হতে পারে সম্পর্কের অবনতি৷ সে সব ঝুঁকি নিয়েও ভারত আমেরিকার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগলো৷ সোমবার ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে ‘লেমোয়া’ নামে যে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তার মোদ্দা কথা হল --- এ বার থেকে আমেরিকা জ্বালানি ভরার জন্য বা অন্য কোনও সামরিক সহায়তার জন্য ভারতের যে কোনও সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে৷ যদিও আমেরিকার সেনাকে ঘাঁটি করতে দেওয়া হবে না বলে এই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে৷ তা ছাড়াও এই চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশের জল, স্থল ও বায়ুসেনা ঘাঁটিকে উভয়েই রসদ সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করতে পারবে৷ সন্ত্রাস মোকাবিলায় কার্যকরী হবে এটি৷

গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে , আমেরিকার সঙ্গে এই ধরনের সামরিক চুক্তি হবে কি না, তা নিয়ে টালবাহানা চলছে৷ তার কারণই হল দেশের অভ্যন্তরে এর রাজনৈতিক প্রভাব কী হবে ও কূটনৈতিক ভাবেই বা ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায় দাঁড়াবে৷ কিন্তু কেন এত প্রশ্ন উঠছে? কেনই বা একটি মার্কিন চুক্তি নিয়ে এত শোরগোল? সে জন্য ফিরে যেতে হবে স্বাধীনতা-উত্তর কালের প্রথম যুগে৷ জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই ভারত ‘নন -অ্যালাইনড মুভমেন্ট’-এর সদস্য৷ অর্থাৎ সে সময়ে শক্তির দু’টি উৎসস্থল --- আমেরিকা বা রাশিয়া --- কোনও দেশের সঙ্গেই কোনও সামরিক জোটে যাবে না ভারত৷ সে নীতি বজায় রাখেন ইন্দিরাও৷ যদিও তিনি রাশিয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েন৷ কিন্ত্ত তা সত্ত্বেও ভারতের বিদেশনীতিতে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি৷ প্রথম বার এর ব্যতিক্রম ঘটে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়৷ কুয়েতকে কেন্দ্র করে যখন আমেরিকা-ইরাক উপসাগরীয় যুদ্ধ চলছে , সেই সময় আমেরিকা ভারত সরকারকে অনুরোধ করে বিমানে তেল ভরার জন্য তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিতে৷ তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর তাতে রাজিও হয়ে যান৷ এই নিয়ে কংগ্রেস তীব্র আপত্তি করে৷ এমনকি সমর্থন তুলে নিয়ে চন্দ্রশেখর সরকারকে ফেলে দেওয়ার কথাও বলে৷ ফলে অনুমতি দেওয়ার এক সন্তাহের মধ্যেই জ্বালানি ভরার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় চন্দ্রশেখর সরকার৷ তখন সেই উপসাগরীয় যুদ্ধের বয়স ২ সপ্তাহ৷

ফলে সে বার মূলত কংগ্রেসের আপত্তিতেই চন্দ্রশেখর পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ সেই কংগ্রেসই কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই চুক্তি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি৷ বামেরা বরাবরের মতো সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে এই চুক্তির সমালোচনা করেছে৷ কিন্তু তার বাইরে এখনও কোনও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কূটনৈতিক মহল কিন্ত্ত মনে করছে, উপমহাদেশ অঞ্চলে এই চুক্তির ফল মারাত্মক হতে পারে৷ এর ফলে উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং চীন ও পাকিস্তান সম্পর্ক আরও মজবুত হবে৷ ইতিমধ্যেই বেজিং হুমকি দিয়ে রেখেছে, বালুচিস্তানে যদি ভারত কোনও আক্রমণ করে তা হলে তারা পাকিস্তানকে সব রকম সাময়িক সহায়তা দেবে৷

চীন সাগরকে কেন্দ্র করেও মার্কিন -চীন সম্পর্ক যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে কোনও সহজ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়৷ অন্য দিকে ভারত বলে রেখেছে তারা ভিয়েতনামকে দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে সামরিক সহযোগিতা ক রবে , যা আগে থেকেই বেজিংকে চটিয়ে দিয়েছে৷ আর পাকিস্তান তো রয়েইছে৷ তারা সব সময়ই ভারতের সামরিক চুক্তি ও পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তিত৷ পাশাপাশি , রাশিয়া ছিল ভারতের দীর্ঘদিনের সহযোগী দেশ৷ এই চুক্তির মাধ্যমে সম্ভবত তাতেও ছেদ পড়বে৷ তবে এ সব কোনও কিছুকেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে , মোদী একেবারেই নিজের মতো করে বিদেশনীতিতে বদল আনছেন৷ কারণ ভারত আমেরিকার ‘ন্যাচারাল অ্যালাই ’ হলেও , কখনওই সামরিক ক্ষেত্রে এতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না৷ এ বার সেটাই হয়ে গেল৷ আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্র জাপান , অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত এখন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে৷ চুক্তি স্বাক্ষরের পর কার্টার বলেছেন, ‘যে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘ সম্পর্ক, তাদের সঙ্গেই এ ধরনের চুক্তিতে যায় আমেরিকা৷ ভারত তাদের অন্যতম৷ তবে আমরা ভারতের মাটি থেকে যুদ্ধ করব না৷ ’ কিন্ত্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন , এর পর যে ভারতের মাটিকে আমেরিকা ব্যবহার করবে না , এ কথা বলা যায় না৷ পাকিস্তানের দৈনিক তো লিখেইছে, এই লেমোয়া চুক্তিতেই শেষ নয় , এর পর ভারত -মার্কিন সহযোগিতার আরও দু’টি চুক্তি হবে --- সিসমোয়া (কমিউনিকেশনস ইন্টারপোর্টেবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট ) ও বেকা (বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট ফর জিও -স্প্যাশিয়াল কো অপারেশন)। প্রথমটির ক্ষেত্রে চুক্তি হলে ভারতের মাধ্যমে নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবে আমেরিকা৷ দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানের ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি ও সমীক্ষার সুযোগ পাবে পেন্টাগন৷ এ দু’টি ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে পারিকরের জবাব, ‘সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে এত বছর লাগল৷ এর উপযোগিতা দেশের মানুষকে বোঝাতে হবে৷ তার পর অন্য বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
তবে লেমোয়ার জন্য যে দেশের অভ্যন্তরে মোদী সরকারকে বিরোধীদের প্রশ্নবাণ হজম করতে হবে, সেটা উপলব্ধি করেই সম্ভবত প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে চুক্তির পরিধি কতটা, তা স্পষ্ট করা হয়েছে৷ এই বোঝাপড়া সামরিক বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে, এর সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্রের কোনও সম্পর্ক নেই৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, এই চুক্তির ফলে কি মার্কিন বিমান বা যুদ্ধজাহাজ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সামরিক অভিযান চালানোর ছাড়পত্র পেয়ে গেল ? ভারতে কি আমেরিকা ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে ?

পারিকরের মন্তব্য, ‘এর সঙ্গে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না৷ কেউ কারও ভূখণ্ডে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে না৷ একসঙ্গে অভিযান চালানোর ব্যাপারও নেই৷ ’ তবে ফোর্বস ম্যাগাজিন কিন্ত্ত স্পষ্ট বলেছে , ‘এই লেমোয়ার ফলে মার্কিন নৌ ও বিমানবাহিনীর বিরাট সুবিধা হল৷ তাদের ভারতে ঘাঁটি থাকবে না ঠিকই , কিন্ত্ত তার থেকেও ভালো কিছু পাচ্ছে --- ভারতের সামরিক ঘাঁটি৷’স্বাভাবিক ভাবেই এই চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া দিয়েছে৷ নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ বলেন , ‘ভারত-মার্কিন এই সখ্য দেখে পাকিস্তান যথেষ্ট চিন্তিত৷ এর ফলে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক খারাপ হতে পারে৷’ চিনকে রুখতেই যে ভারত এতটা ‘সাহসী’ হয়ে উঠেছে, সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে বেজিংয়ের দৈনিকে ও পাক দৈনিকে৷ অন্য দিকে , চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দো -প্যাসিফিক অঞ্চলে সেনা বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে আমেরিকা৷ কাজেই এই একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতের এত দিনকার বিদেশনীতির মধ্যেই এল বিশাল বদলের সূচনা বার্তা৷ পরবর্তীকালে তা আরও কতটা বদলে যায় , সে বিশ্লেষণের সময় আসেনি৷ তবে এই চুক্তি যে মনমোহন সিংয়ের করা অসামরিক পরমাণু চুক্তির চেয়েও ব্যান্তিতে ও প্রভাবে অনেক বেশি , তা বুঝতে পারাটা বোধহয় কঠিন নয়৷


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন