কাশ্মীরিদের ‘আজাদি’
হ্যাপিমন জ্যাকব
দেড় মাস ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, তারা যেন কাশ্মীরের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আলোচনায় বসে। সংসদে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সর্বদলীয় সভায় অংশগ্রহণকারীরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রাজনৈতিক সমাধান বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলও জম্মু ও কাশ্মীরের ‘সকল অংশীজনের’ সঙ্গে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এত কিছু সত্ত্বেও বিজেপি এসব উপদেশের আলোকে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে, উপত্যকাকে শান্ত করতে পারেনি।
বিজেপি এখনো কাশ্মীরের বিষয়টিকে পাকিস্তান বা হিন্দু-মুসলমান পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং যে এই অবস্থার পুরো দায়টা পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপাতে চান বা তিনি যে দিল্লির মুসলিম ধর্মনেতাদের কাশ্মীরিদের কাছে যেতে বলছেন, এতেই বোঝা যায়, বিজেপির এই মনোভাবটা ভুল। বাস্তবতা হচ্ছে, কাশ্মীরে যা হচ্ছে সে বিষয়ে ভারতীয় মুসলমানদের যেমন কিছু করণীয় নেই, তেমনি সেখানকার ‘আজাদি’ সংগ্রামও একদম বিশুদ্ধ ইসলামি আন্দোলন নয়। না, ক্ষমতার দম্ভ বা রাজনৈতিক অজ্ঞতার কারণে যে বিজেপি এই সমাধান বের করতে বাজেভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, তা নয়। একদম গোড়ার কথা হলো, বিজেপির রাজনীতির প্রতীক ও কাশ্মীরের ‘আজাদি’ আন্দোলনের প্রতীকের মধ্যে যে সংঘাত রয়েছে, তার ফলেই এই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কাশ্মীরের ব্যাপারটা যেমন একদিকে বাস্তব, তেমনি তার প্রতীকী মূল্য রয়েছে। ফলে ‘আজাদি’ আন্দোলনের প্রতীকী মূল্যকে আমলে না নিয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
বিজেপির অতি-জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের আওতায় ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের পৃথক পতাকা ও সংবিধান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। কাশ্মীর-বিষয়ক বিজেপির রাজনৈতিক মনোভঙ্গির গোড়ায় রয়েছে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির এক দেশ, এক প্রতীক ও এক সংবিধানের নীতি। যদিও বাস্তবে জম্মু ও কাশ্মীরের পৃথক পতাকা ও সংবিধান ভারতীয় সংবিধান ও পতাকার ঊর্ধ্বে নয়, আর ৩৭০ নম্বর ধারা তো বিগত বছরগুলোতে সব অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ৩৭০ নম্বর ধারা বিলোপ করা হলে কাশ্মীরিদের কাছে তা পূর্ণাঙ্গ ‘ভারতীয় দখলদারি’ হিসেবে চিহ্নিত হবে, আর বিজেপি ও সংঘ পরিবারের কাছে তা হবে কাশ্মীরকে ভারতের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার শামিল। ওদিকে আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্ট (স্পেশাল পাওয়ার) বা এএফএসপিএর কী হবে? কাশ্মীরিদের কাছে এই নিবর্তনমূলক আইনটি কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতীক। আর বিজেপি মনে করে, এটা তুলে নেওয়ার মানে হলো, কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে প্রতীকী পরাজয়।
কাশ্মীর থেকে কেন্দ্রীয় সেনাদের প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিন্তু বিজেপির পক্ষে এটা করা কঠিন, চাইলে
কংগ্রেস হয়তো তা করতে পারত। কাশ্মীরিদের কাছে এর প্রভূত মূল্য রয়েছে। ওদিকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব রয়েছে। পাকিস্তান বুঝতে পেরেছে, নানা কারণেই কাশ্মীরের বর্তমান মানচিত্র বদল করা সম্ভব নয়। ফলে তারা সেখান থেকে ‘সম্মানজনক বিদায়ের’ পথ খুঁজছে। কারণ, এই কাশ্মীরের সমস্যা তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই পারভেজ মোশাররফ নতুন সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন: বিদ্যমান বন্দোবস্ত বজায় রেখে সমাধান বের করা।
ড. মনমোহন সিং মোশাররফের সূত্রের প্রতীকটা বুঝতে পেরেছিলেন। সে কারণে তিনি মোশাররফকে কাশ্মীরের ‘সীমান্তকে অপ্রাসঙ্গিক’ করে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মনমোহন সিং যে এটা যথাযথভাবে করতে পেরেছিলেন তার কারণ হচ্ছে, তাঁর ও কংগ্রেসের রাজনীতির প্রতীকী তাৎপর্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত সমাধানের অমিল ছিল না।
বিজেপি যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে পারছে না, তার একটি কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। বিজেপি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে নিজে থেকে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে মোদি যে সংকট শুরু হওয়ার এক মাস পর অনিচ্ছা নিয়ে এ বিষয়ে কথা বললেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বিজেপির কাশ্মীর নীতি ভোটের রাজনীতির আলোকে নির্ধারিত হয়। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালিত হয় জাতীয়তাবাদী প্রতীক, জাতীয় মর্যাদা, শক্তি, সভ্যতার মহত্ত্ব প্রভৃতি বর্গের ভিত্তিতে। ফলে উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাটের নির্বাচনের আগে তারা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না।
কথা হচ্ছে, কাশ্মীরের বর্তমান ‘আজাদি’ আন্দোলন আসলে নয়াদিল্লির প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। যেটা আসলে ভারতীয় ‘দখলদারি’ থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। কাশ্মীরিরা মনে করে, শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাইরের মানুষের দ্বারা শাসিত হওয়াটা আসলে প্রতারিত হওয়ার শামিল। আর নয়াদিল্লি কথা রাখতে পারেনি। তার সঙ্গে আছে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান—সবকিছু মিলে কাশ্মীরের আজ এ অবস্থা হয়েছে। এটাও ঠিক, আজাদি দাবির বাস্তব রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে।
বিদ্রোহ সব সময় প্রতীকে ঠাসা থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আখ্যানকে পরাজিত করতে অতিরিক্ত পাল্টা-প্রতীক ব্যবহার করে এবং তাদের প্রতীকী চাহিদাকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আখ্যানই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ফলে নয়াদিল্লি যদি কাশ্মীরের সমস্যার মূলে যেতে চায়, তাহলে তাকে ‘আজাদি’ আন্দোলনের প্রতীককে আমলে নিতে হবে। অর্থাৎ ‘আজাদি’ কী ও কেন, তা বুঝতে হবে।
হ্যাপিমন জ্যাকব: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
দ্য হিন্দু থেকে অনুদিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন