এদিকে জন কেরির সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি বলেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, জন কেরি একটি নিরাপদ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের মুখ্য উপাদান হিসেবে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক বিরোধিতার সুযোগ থাকে এমন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এ ছাড়া দেশের জন্য হুমকিগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশি সমাজের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দেন তিনি। অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কেরির সঙ্গে বৈঠক করতে পেরে বিএনপিও স্বস্তিতে আছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি জন কেরির গুরুত্বারোপকে বিএনপি বড় বার্তা হিসেবে দেখছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, জন কেরির ঢাকা সফরে বড় পরিসরে এসেছে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবিলা প্রসঙ্গ। এ দেশে, এ অঞ্চলে ও বিশ্বে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবিলার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। জন কেরি তাঁর বক্তৃতায় কৌশলে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ দমনের অন্যতম উপাদান হিসেবে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কেরি মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন সেখানেও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি উঠেছে।
বাংলাদেশ জন কেরির ঢাকায় আসাকে ‘রুটিন সফর’ হিসেবেই দেখেছে। ওবামা সরকারের মেয়াদের একেবারে শেষ দিকে এ সফর যাত্রাবিরতির চেয়ে সামান্য বেশি কিছু হলেও এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। গত জুলাইয়ে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলাই মূলত জন কেরির সফরকে আবশ্যিক করে তুলেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তিনি বাংলাদেশের পাশে থাকার, সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার এবং সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছেন। বাংলাদেশ সফরে বিভিন্ন বৈঠকে তিনি শুধু নিজের প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেননি, অন্যপক্ষের বক্তব্য ও যুক্তিগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে শুনেছেন।
কেরি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের ইরাক ও সিরিয়ার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এ সফরে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং ঢাকাকে ওয়াশিংটনের সহযোগিতাবিষয়ক বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং তা আগামী দিনগুলোতেও চলবে। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর জন কেরি ইএমকে সেন্টারে রাখা বক্তব্যে বলেছেন, শুধু বঙ্গোপসাগর এলাকায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ই নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত উন্মুক্ত ও বড় পরিসরে সম্পৃক্ততা আছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সক্ষমতা বাড়াতে জিসিইআরএফ তহবিলে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করছে। কেরির মতে, তাঁর সফরের ফলে এ ইস্যুগুলো আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জনমনে আস্থা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেছেন, ‘তাই আমি মনে করি, আপনারা (বাংলাদেশিরা) এ ব্যাপারে আমাদের আরো কাজ, আরো সম্পৃক্ততা এবং আরো উপস্থিতি দেখতে পাবেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আট ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশ কী বার্তা পেল জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক বলেন, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। তারা আমাদের অভূতপর্ব অর্জন, অগ্রগতি ও নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে। আবার একইভাবে বাংলাদেশের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরে সেগুলো মোকাবিলায় এ দেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সুযোগে বাংলাদেশও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু তুলেছে।
প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা জিএসপি চাই না, শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার চাই।’ রাজনৈতিক দিক দিয়ে জন কেরির সফরের বার্তা বিষয়ে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমালোচনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাতে যে উষ্ণতা দেখা গেছে, তা এককথায় অসাধারণ। বৈশ্বিক বিভিন্ন ফোরামে দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেছেন। জন কেরি তাঁর ঢাকা সফরে আগামী মাসে নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশ নেওয়ার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে জন কেরির স্ত্রী থেরেসা হেইঞ্জের জন্য চমৎকার একটি জামদানি শাড়িও উপহার দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর যে বিবৃতি দিয়েছিল, তাতে স্পষ্টভাবেই দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ ছিল। নির্বাচন-পরবর্তী কয়েক মাসেও দেশটির প্রতিনিধিরা তাঁদের এমন প্রত্যাশার কথা বারবার বলেছেন। ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে ঘিরে গত বছরের শুরুর দিকে অস্থিরতার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের স্বাক্ষর জাল করে রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রচারিত ভুয়া বিবৃতিও ওয়াশিংটনের দৃষ্টি কাড়ে। সে সময় দেশব্যাপী নির্বিচার নাশকতা এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধীদের কর্মসূচি পালনে বাধা—দুটিরই সমালোচনা করেন জন কেরি। গত রবিবার ঢাকা সফরের সময় জন কেরি নতুন নির্বাচন বা রাজনৈতিক সংলাপের মতো বিষয় যে সরাসরি তোলেননি তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বার্ষিক আলোচনার সর্বোচ্চ ফোরাম অংশীদারি সংলাপ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ যাবৎ অনুষ্ঠিত অংশীদারি সংলাপগুলোতেও নতুন নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসেনি। জন কেরি খুব কৌশলে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ দমনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা বলেছেন, যা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে আলাদা বৈঠকগুলোতেও কেরি মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, জন কেরি তাঁর প্রত্যাশা জানানোর পাশাপাশি সরকারেরও বক্তব্য শুনেছেন। ঢাকা সফরে তিনি এমন কিছু বলেননি যা সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। বরং স্পষ্টতই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বর্তমান সরকারের পাশে থাকার ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে শক্তিশালী করার কথাই বলেছেন তিনি। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বৈশ্বিক যোগসূত্র থাকার বিষয়ে জন কেরি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাও নতুন কিছু নয়। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকা সফরের সময়ও এমন যোগসূত্রের কথা বলেছিলেন। কেরিও যে এমন কিছু বলবেন তা অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও যে জন কেরি সাক্ষাৎ করবেন তাও অনুমেয় ছিল। বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্র বার্তা দিয়েছে, সংসদের বাইরে থাকলেও তারা এ দলটিকে বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে। অন্যদিকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও জন কেরির সঙ্গে কথা বলার সুযোগে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরতে পেরেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন