বাংলাদেশের অগ্রগতিতে শরিক হতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র গর্বিত
আমি সেই সঙ্গে তাঁর সব সহকর্মীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ আমরা জানি এখানে যে কাজ হচ্ছে, সবাই মিলেমিশে করছেন। আর তাঁদের সবার সঙ্গে আমি একটু পরে সাক্ষাৎ করব। তাঁরা সবাই কঠোর পরিশ্রম করছেন। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টার কাজে আমরা সবাই কঠোর পরিশ্রম করছি। আর আজ এই বিকেলে আপনারা যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।
বাংলাদেশে এসে এডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টার পরিদর্শন করতে পারা ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য একটা দারুণ সুযোগ। আমি জানি, টেড কেনেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং এ দেশের মানুষের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। এর কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজের দূরদৃষ্টি এবং সমর্থনের বিষয়ে তিনি ছিলেন দ্ব্যর্থ, দ্বিধাহীন।
তাঁকে আমি অনেক অনেক বছর ধরে দেখেছি। আমার যখন ১৮ বছর বয়স, তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ১৯৬২ সালের কথা। তখন সবে আমি হাই স্কুল পাস করে বেরিয়েছি। পুরো একটি গ্রীষ্ম আমি টেড কেনেডিকে মার্কিন সিনেটের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করার কাজে বিনা পয়সায় দায়িত্ব পালন করি। এটা ছিল তাঁর প্রথম নির্বাচন। টেড কেনেডি প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির শূন্য আসনে নির্বাচন করেছিলেন। টেডের ভাই জন কেনেডি দুই বছর আগেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনের সেই প্রচারণা ছিল দুর্দান্ত। আমি তাতে অংশ নিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম তা অনেক বছর পর সিনেট সদস্য হতে আমাকে সহায়তা করে। ছাত্রজীবনে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সময় আমার কখনো মনে হয়নি বড় হয়ে আমিও একজন জুনিয়র সিনেটর হব, সিনেটর টেড কেনেডির সহযোগী হয়ে সিনেটে কাজ করব। আমরা ২৯ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। কয়েক বছর হলো তিনি নেই। মারা গেছেন। তবে আমি সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি। আর আজ তাঁর নামাঙ্কিত একটি প্রতিষ্ঠানে আসতে পেরে নিজে সম্মানিত বোধ করছি।
এখানে একটি বিষয় যোগ করতে চাই। আমার মনে হয় তাঁর ও আমার এই যে জুনিয়র-সিনিয়র সিনেটরের জুটি তা মার্কিন সিনেটের মধ্যে দীর্ঘতম। আমি তো ভাবতাম, সারাটি জীবন যদি ওভাবেই কেটে যেত! সিনেটর স্ট্রম থার্মন্ড ছিলেন ফ্রিত্জ হলিংয়ের সঙ্গে সবচেয়ে বয়সী ব্যক্তি। তিনি শতায়ু পেয়েছিলেন। তাই আমিও বলতাম, শত বছর! খুব ভালো তো। আমারও এমন সুযোগ হবে।
আমি যে ঢাকায় আসতে চেয়েছি এর অনেক কারণ রয়েছে। এখানে আমি যে সংবর্ধনা পেয়েছি তার জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই ভালো আলোচনা হয়েছে। এখানে আমি একটি কথা জোর দিয়ে বলতে চাই।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সুন্দর সংস্কৃতিগুলোর একটি। এ দেশ সত্যিকার অর্থেই আ ‘গোল্ডেন বাংলা’, ‘সোনার বাংলা’।
প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) এবং আমার মধ্যে অত্যন্ত গভীর ও বিশদ আলোচনা হয়েছে; পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলীসহ (এ এইচ মাহমুদ আলী) অন্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও হয়েছে। আজকের এসব আলোচনার মধ্য দিয়ে সুযোগ হয়েছে স্বাধীনতার পর গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশ কত দূর এগিয়েছে এবং আমাদের দুটি দেশ স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা থেকে বৈশ্বিক নিরাপত্তার মতো বিষয়ে কিভাবে একযোগে কাজ করতে পারে তার ওপর আলোকপাত করার।
আমি আপনাদের জানাতে চাই, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে শরিক হতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র অনেক গর্বিত। বাংলাদেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তিনটি প্রধান উন্নয়ন উদ্যোগের বিষয় স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন ইস্যুর অংশীদার। এই অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই।
এখন আমি জানি যে সব সময়ই কেউ না কেউ আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কিছু টানাপড়েন অনুভব করেছে এবং এটা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭১ সালে আমি বয়সে তরুণ। সবে কলেজ থেকে ফিরেছি এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফিরেছি। আমরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক ছিলাম। তবে আমি এই ভেবে গর্বিত যে একা সিনেটর টেড কেনেডিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন করেননি, আমরা সবাই সমর্থন করেছি। ম্যাসাচুসেটস বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ছিল। এ জন্যও আমি গর্ব বোধ করছি।
আমরা সবাই জানি, এখন আমরা খুবই অন্য রকম এবং খুবই কঠিন এক সময় পার করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলো খুবই জনবহুল। তাদের অবস্থান উপকূলের কাছে। সাইক্লোন ও হারিকেনের মতো দুর্যোগের ঝুঁকিও তাদের বেশি। এ কারণেই বাংলাদেশ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষের একদম কাছাকাছি রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ তাদের আবাস হারাতে পারে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি আমাদের স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। কারণ উপকূলীয় এলাকার সম্পদের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ বাংলাদেশি মানুষের সহযোগিতায় জলবায়ু সহিষ্ণুতা সৃষ্টি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির নানা প্রকল্পে সহায়তা, জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।
আপনারা সবাই জানেন, জলবায়ু পরিবর্তন যে সংকট নিয়ে এসেছে তার সমাধান গোপন কিছু নয়। তা হচ্ছে জ্বালানিনীতি, যা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আপনারা যদি সঠিক জ্বালানিনীতি গ্রহণ করতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। আজই আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (এ এইচ মাহমুদ আলী) সঙ্গে বৈঠকে মন্ট্রিল প্রটোকলের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছি। আমরা কথা বলেছি হাইড্রোকার্বন থেকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়েও। শুধু এ কৌশল গ্রহণ করেই আমরা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি আধাডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে ফেলতে পারি। কাজেই এ বিষয়ে আমাদের করার অনেক কিছুই আছে। এই পরিবর্তন আনার জন্য যেসব দেশ লড়াই করছে তাদের শীর্ষে বাংলাদেশের থাকা প্রয়োজন আছে এবং যু্ক্তরাষ্ট্রও এটা প্রত্যাশা করছে।
আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করবে; অতীতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা যেমনটা বাংলাদেশের পাশে থেকেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ, যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি, শ্রমিক ও নারী অধিকার এগিয়ে নেওয়া এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে শত শত কোটি ডলার দিয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ, আমরা বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগেরও (এফডিআই) প্রধান উৎস।
আমাদের এ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক শিল্প। আপনাদের দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশে রাখার কাজেও এটি ভূমিকা রেখেছে। তবে শুধু প্রবৃদ্ধির জন্যই প্রবৃদ্ধি আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। আপনারা উন্নতি করতেই থাকলেন, করতেই থাকলেন, করতেই থাকলেন। কিন্তু এই উন্নতি হতে পারে ভুল মূল্যবোধ ঘিরে। আপনাদের উন্নতির মন্দ ফলও হতে পারে। এমনও হতে পারে, প্রবৃদ্ধি হলো; কিন্তু মানুষ অধিকার পাচ্ছে না, ন্যায্য উপার্জন পাচ্ছে না বা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই একমাত্র প্রবৃদ্ধিই কাঙ্ক্ষিত সূচক হতে পারে না। রানা প্লাজার ধস এবং এর আগে তাজরীন ফ্যাক্টরিতে আগুন—এ দুই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা একটি মৌলিক সত্য আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। আর তা হচ্ছে, যতক্ষণ না বাংলাদেশে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে ততক্ষণ এ দেশ তার মানুষের আশা পূরণ করতে পারবে না এবং উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছবে না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আর এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার, বেসরকারি খাত, ট্রেড ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাতে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানায়। উদ্যোগগুলো হচ্ছে কারখানার নিরাপত্তায় পরিদর্শন বাড়ানো, নিম্নমানের কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, শ্রমিক নিগ্রহের কোনো বিষয়ে নির্ভয়ে অভিযোগ করার ব্যবস্থা থাকা।
তবে এসব উদ্যোগ একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার অংশ। শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের অধিকারও বাড়াতে হবে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানায় শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, তাদের ইউনিয়ন করার অধিকার, দরকষাকষির অধিকারের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক খাত সত্যিকার অর্থে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। কাজটি কঠিনও নয়, সহজ। আর তা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, শোষিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে এমন স্থানে কাউকে কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না।
বেশ কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা আপনাদের বলতে চাই। আমি তখন উত্তর ম্যাসাচুসেটসের লাওয়েল নামের একটি এলাকায় থাকি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রথম পরিকল্পিত জনপদ। শিল্প বিপ্লব এবং ইংল্যান্ডের প্রথম দিকের উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করেই এলাকাটি বিকশিত হয়। এ এলাকার নদীর তীরে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে উঠেছিল। কারণ এ নদীর পানি কারখানার জন্য দরকার ছিল। কাপড়সহ নানা দ্রব্য উৎপন্ন হতো কারখানায়। আমেরিকার জন্য এ উৎপাদন দরকারও ছিল। তবে বিশাল এসব কারখানায় অনেক সময় শিশু শ্রমিক কাজ করত। তারা দুপুরের খাবারের বিরতি পেত না। টয়লেটের বিরতিও তাদের দেওয়া হতো না। ১৬ ঘণ্টা ধরে কাজ করতে হতো। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের অধিকার দান এবং উন্নত কাজের পরিবেশের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। পরিবর্তনও আসে।
আজকের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকান। আমরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে বিকশিত হয়েছি। আমরা এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। চীনও দ্রুত উন্নতি করছে। চীনের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। একদিন চীন আরো বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখনো উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতার অর্থনীতি ধরে রেখেছে। আমাদের অর্থনীতি মানুষকে অধিকতর অধিকার দেয়। কিশোরদের কলেজে যাওয়ার সুযোগ দেয়। তাদের অভিভাবকদের ভালো কাজের সুযোগ করে দেয় এবং উত্তর প্রজন্মও ভালো জীবনযাপনের পরিবেশ পায়। আর তা সম্ভব হয়েছে মূলত এ জন্য যে আমরা শ্রমিকদের অধিকার দিয়েছি এবং তাদের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন সাধন করেছি। আমরা সবার উপকারের কথা বিবেচনা করার মাধ্যমেই জাতি হিসেবে উন্নত হয়েছি। আসলে যখন একটি দেশের সবাই সুবিধা পায় তখন পুরো জাতিই উন্নতি করে। এটাই আসল তত্ত্ব। এ তত্ত্ব আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছি। এখন আমরা যা করার চেষ্টা করছি তা হচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যে এই অর্জনের জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। কাজটা সহজ ছিল না। এসব পরিবর্তনের কিছু কিছু হয়েছে মাত্র গত ১৫ বছরে। সিনেটর টেড কেনেডি এবং অন্যদের ধন্যবাদ, আমাদের দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়ার জন্য তাঁরা কাজ করেছেন এবং তখন আমিও ভোট দিয়েছিলাম, আমাদের দেশ আজ যে অধিকতর শক্তিশালী, এর পেছনে ওই সিদ্ধান্তের অবদান আছে।
কিন্তু আমরা এখনো নানা ক্ষেত্রে লড়াই করছি। সুতরাং আপনাদের প্রতি আমার বার্তা হলো, কখনো ক্ষুব্ধ হবেন না। কারণ রাতারাতি কিছু হয় না। সব কিছুর জন্যই সময় ও শ্রম লাগে। আপনাদের নিজেদের স্বার্থে, জাতির অগ্রগতির প্রয়োজনে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি সমাজের মানুষ নিরাপত্তা বোধ করে কি না তার সঙ্গে সমৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। আর উগ্রবাদীরা এমন স্থানকেই নিজেদের কর্মকাণ্ডের স্থল হিসেবে বেছে নেয়, যেখানে মানুষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের প্রান্তিক, অবহেলিত বোধ করে। সহিংসতার মধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং তা ধরে রাখা অনেক কঠিন। বিনিয়োগের সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক আছে। আপনারা যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশা করেন, তাদের জন্য অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সুধীসমাজ, সেই সঙ্গে গণমানুষের মত প্রকাশের ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করতে হবে। কোনো বিষয়ে দৃষ্টি কাড়ার জন্য উগ্রপন্থা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই, যেন কেউ এমন ভাবার পরিবেশ না পায়।
এসব কারণেই সন্ত্রাসীদের, বিশেষ করে আল-কায়েদা ও দায়েশকে (আইএস) পরাজিত করতে বাংলাদেশ এবং প্রতিটি মহাদেশের অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত রাখবে। ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা ছিল চরম নিষ্ঠুরতা। ওই হামলার স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে বিভক্ত করা এবং সুন্দর এই সমাজকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এর আগে কয়েক বছর ধরে ছোট মাত্রার আরো অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিদেশি নাগরিক, ব্লগার কিংবা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। হামলাগুলোর উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা আপনাদের বিভক্ত করতে চায়। তারা মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তারা চায় অভ্যন্তরীণ বিবাদ।
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে এ ধরনের ঘৃণ্য সহিংসতা আমাদের খুব রূঢ়ভাবে মনে করিয়ে দেয় যে যারা এ ধরনের হামলা চালায় বা মদদ দেয়, তাদের ভৌগোলিক সীমানার প্রতি সম্মান, অন্যের অধিকারের বিষয়ে বিবেচনা এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। তারা বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বও করে না। তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইরাকে মানুষ ইয়াজিদি, শিয়া ও খ্রিস্টান শুধু এ-জাতীয় পরিচয়ের কারণে আইএস জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। আইএস সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে হামলার লক্ষ্য করছে। এ কারণেই আমি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। এ সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে আমাদের এক প্রজন্ম বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। তবে আমি বলতে চাই, আইএসকে আমরা হারাতে যাচ্ছি, তারা হারবেই। আমরা বোকো হারাম ও আল-শাবাবকেও পরাজিত করব। আমরা সেই লক্ষ্যে সঠিক পথে রয়েছি।
তবে আমাদের লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হবে। আর তা শুধু মাঠের লড়াইয়ে নয়, মানসিকতার ক্ষেত্রে। যদি এমন হয়, অনেক তরুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, বেকারত্ব কিংবা হতাশা তাদের পেয়ে বসেছে—উগ্রবাদীরা তাদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। তখন এ সহিংসতা বন্ধ করা যাবে না।
মনে রাখবেন, কোনো দেশই সন্ত্রাসবাদ থেকে নিরাপদ নয়। আর আতঙ্ক ছড়ানো সহজ। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিনে ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাত দিন এবং বছরে ৩৬৫ দিন সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু কেউ যদি মনে করে, যেকোনো দিন সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে পারে। নিজেকে এবং আরো কিছু মানুষকে হত্যাও করতে পারে। এ নিয়ে চমক সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সন্ত্রাসবাদের এ-জাতীয় ঘটনাগুলো খুব ফলাও করে প্রচার যদি না করে, আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক হয়। ঘটনা হচ্ছে, আমাদের সবাইকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সন্ত্রাসীদের পরাজিত করতে হলে আমাদের গণতন্ত্রের মূলনীতি থেকে সরে না এসে, গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতারণা না করে একে বরং আরো সুদৃঢ় করতে হবে। একজন মানুষ কেন সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে? এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর হয়তো নেই। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম। কারণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। যখন মানুষ স্বাধীনভাবে বিতর্ক করতে পারে তখন মিথ্যার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, শান্তির ধর্ম ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা এবং নাশকতায় জড়িয়ে পড়ার সুযোগটি কমে আসে।
অতএব, আজ মানুষের জন্য এই দায়িত্ববোধ বর্তায় যে তারা সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে, সহিংসতার মাধ্যমে ধ্বংস করার দিকে যাবে না। এখন কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, যখন বিভিন্ন দেশ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে, এমন মুহূর্তে গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলো মেনে চলা খুবই কঠিন। আমিও বিষয়টি বুঝি। তবে এখন আমার-আপনার সামনে দুটি পথ খোলা। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখাটাই এ সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি তা না করেন, বিরোধিতা, আতঙ্ক ও উন্মাদনা থেকে সমস্যা আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বন্ধুরা, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ভবিষ্যতের ব্যাপারে বিশ্বাসের এক নতুন বোধ নিয়ে আজ আমি এখান থেকে বিদায় নেব। আর এ নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। আরো বেশি সময় এখানে অবস্থান করার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু সমসাময়িক সংঘাতময় অবস্থা এবং দায়িত্বের বোঝা আমাকে কোথাও বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ দেয় না। এ ব্যাপারে আমার স্ত্রী-সন্তানদেরও জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে আমি আপনাদের প্রাণবন্ত, গতিশীল সমাজের শক্তিটা অনুভব করতে পারছি। আমি তা অনুধাবন করতে পারছি। এখানে দারুণভাবে দায়িত্বশীল মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাকে এ বিষয়ে অবগত করেছেন। আমার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়ালও সব সময় তা বলেন। তাঁরা যথার্থই বলে থাকেন। দুই দেশের পারস্পরিক অংশীদারির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আরো দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আমি এখান থেকে বিদায় নেব।
আমি নিশ্চিত নই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে এত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে টহল দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ব্যবহার করবে, এক দশক আগেও কেউ এ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারত কি না। এখন সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা থেকে শুরু করে মহাসাগরের পরিবেশ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিন্ন স্বার্থ যুক্ত। সব কিছু নিয়েই আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।
একই সঙ্গে এটা বিস্ময়কর নয় যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র শুধু অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে অংশীদার নয়, বন্ধুও বটে। ১৯৭১ সালে যখন আমি যুদ্ধের প্রতিবাদ করছিলাম, যখন সুন্দর এই দেশের অধিবাসীরা ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল তখন বিশ্বের অন্য প্রান্তে কেউ কেউ চোখ সরিয়ে রেখেছিল। আমি আগেই আপনাদের বলেছি, সে সময় আমরা তরুণতর প্রজন্মের একদল মানুষ নাগরিক অধিকার, নারী অধিকার, পরিবেশ বা শান্তিবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম। সময়টা ছিল অসাধারণ। আমরা নতুন নতুন ধারণা ও সম্ভাবনা দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরছিলাম। আর যে বিষয়টি আমাকে গর্বিত করেছিল তার অন্যতম হচ্ছে টেড কেনেডির বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করা এবং এখানে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কাজটি।
চরম গোলযোগপূর্ণ ওই সময়ে সিনেটর কেনেডি এ অঞ্চলে ছুটে এসেছিলেন। তিনি শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে সিনেটে তিনি এখানকার সহিংসতাকে ‘পরিকল্পিত (সিস্টেমেটিক) ত্রাসের রাজত্ব’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরের বছরের শুরুতে তিনি আবার এখানে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধের সময় সেনাদের হামলায় মরে যাওয়া একটি গাছের স্থানে একটি বটের চারা রোপণ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেদিন তিনি সীমিত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত বিষয়ের ওপর আলোচনা করেননি, বরং তিনি কথা বলেন এমন এক সম্পর্ক নিয়ে, যা হবে আরো দৃঢ়, গভীরতর ও বিশ্বজনীন। সেদিন কেনেডি বলেছিলেন, সরকারের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত পররাষ্ট্রনীতি নয়, বরং জনগণের সঙ্গে জনগণের, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা। কারণ এক অর্থে আমরা সবাই বাংলাদেশি, আমরা সবাই আমেরিকান। আমরা সবাই একই বিশাল মানবসমাজের অংশীদার।
যে গাছটি সেদিন আমার সাবেক সিনেট সহযোগী রোপণ করেছিলেন, তা এই দেশ জন্মলাভে দেওয়া রক্ত, আত্মত্যাগ ও সাহসের এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে আছে। বৃক্ষটি এখনো বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বন্ধুত্বের প্রতীক। আজ এই যে আমি এখানে এসেছি তা এই বন্ধুত্বকে দৃঢ় করতে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সম্পর্ক ও সংকল্পকে জোরদার করার লক্ষ্য থেকেই। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের কল্যাণে সেই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণে আপনাদের সবার সঙ্গে কাজ করতে আমি অধীর হয়ে আছি। আমরা যদি একসঙ্গে সঠিকভাবে কাজটি করতে পারি, তা সমগ্র বিশ্বের জন্যই কল্যাণকর হবে।
আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জন কেরি : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সোমবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে এডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টারে রাখা ভাষণের ভাষান্তর
জন কেরি
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মার্শা (বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট)। আসুন, আমরা সবাই মিলে রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি বাংলাদেশে দারুণভাবে কাজ করছেন। তিনি সত্যি দুর্দান্ত কাজ করছেন।আমি সেই সঙ্গে তাঁর সব সহকর্মীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ আমরা জানি এখানে যে কাজ হচ্ছে, সবাই মিলেমিশে করছেন। আর তাঁদের সবার সঙ্গে আমি একটু পরে সাক্ষাৎ করব। তাঁরা সবাই কঠোর পরিশ্রম করছেন। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টার কাজে আমরা সবাই কঠোর পরিশ্রম করছি। আর আজ এই বিকেলে আপনারা যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।
বাংলাদেশে এসে এডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টার পরিদর্শন করতে পারা ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য একটা দারুণ সুযোগ। আমি জানি, টেড কেনেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং এ দেশের মানুষের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। এর কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজের দূরদৃষ্টি এবং সমর্থনের বিষয়ে তিনি ছিলেন দ্ব্যর্থ, দ্বিধাহীন।
তাঁকে আমি অনেক অনেক বছর ধরে দেখেছি। আমার যখন ১৮ বছর বয়স, তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ১৯৬২ সালের কথা। তখন সবে আমি হাই স্কুল পাস করে বেরিয়েছি। পুরো একটি গ্রীষ্ম আমি টেড কেনেডিকে মার্কিন সিনেটের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করার কাজে বিনা পয়সায় দায়িত্ব পালন করি। এটা ছিল তাঁর প্রথম নির্বাচন। টেড কেনেডি প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির শূন্য আসনে নির্বাচন করেছিলেন। টেডের ভাই জন কেনেডি দুই বছর আগেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনের সেই প্রচারণা ছিল দুর্দান্ত। আমি তাতে অংশ নিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম তা অনেক বছর পর সিনেট সদস্য হতে আমাকে সহায়তা করে। ছাত্রজীবনে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সময় আমার কখনো মনে হয়নি বড় হয়ে আমিও একজন জুনিয়র সিনেটর হব, সিনেটর টেড কেনেডির সহযোগী হয়ে সিনেটে কাজ করব। আমরা ২৯ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। কয়েক বছর হলো তিনি নেই। মারা গেছেন। তবে আমি সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি। আর আজ তাঁর নামাঙ্কিত একটি প্রতিষ্ঠানে আসতে পেরে নিজে সম্মানিত বোধ করছি।
এখানে একটি বিষয় যোগ করতে চাই। আমার মনে হয় তাঁর ও আমার এই যে জুনিয়র-সিনিয়র সিনেটরের জুটি তা মার্কিন সিনেটের মধ্যে দীর্ঘতম। আমি তো ভাবতাম, সারাটি জীবন যদি ওভাবেই কেটে যেত! সিনেটর স্ট্রম থার্মন্ড ছিলেন ফ্রিত্জ হলিংয়ের সঙ্গে সবচেয়ে বয়সী ব্যক্তি। তিনি শতায়ু পেয়েছিলেন। তাই আমিও বলতাম, শত বছর! খুব ভালো তো। আমারও এমন সুযোগ হবে।
আমি যে ঢাকায় আসতে চেয়েছি এর অনেক কারণ রয়েছে। এখানে আমি যে সংবর্ধনা পেয়েছি তার জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই ভালো আলোচনা হয়েছে। এখানে আমি একটি কথা জোর দিয়ে বলতে চাই।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সুন্দর সংস্কৃতিগুলোর একটি। এ দেশ সত্যিকার অর্থেই আ ‘গোল্ডেন বাংলা’, ‘সোনার বাংলা’।
প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) এবং আমার মধ্যে অত্যন্ত গভীর ও বিশদ আলোচনা হয়েছে; পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলীসহ (এ এইচ মাহমুদ আলী) অন্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও হয়েছে। আজকের এসব আলোচনার মধ্য দিয়ে সুযোগ হয়েছে স্বাধীনতার পর গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশ কত দূর এগিয়েছে এবং আমাদের দুটি দেশ স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা থেকে বৈশ্বিক নিরাপত্তার মতো বিষয়ে কিভাবে একযোগে কাজ করতে পারে তার ওপর আলোকপাত করার।
আমি আপনাদের জানাতে চাই, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে শরিক হতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র অনেক গর্বিত। বাংলাদেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তিনটি প্রধান উন্নয়ন উদ্যোগের বিষয় স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন ইস্যুর অংশীদার। এই অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই।
এখন আমি জানি যে সব সময়ই কেউ না কেউ আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কিছু টানাপড়েন অনুভব করেছে এবং এটা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭১ সালে আমি বয়সে তরুণ। সবে কলেজ থেকে ফিরেছি এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফিরেছি। আমরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক ছিলাম। তবে আমি এই ভেবে গর্বিত যে একা সিনেটর টেড কেনেডিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন করেননি, আমরা সবাই সমর্থন করেছি। ম্যাসাচুসেটস বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ছিল। এ জন্যও আমি গর্ব বোধ করছি।
আমরা সবাই জানি, এখন আমরা খুবই অন্য রকম এবং খুবই কঠিন এক সময় পার করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলো খুবই জনবহুল। তাদের অবস্থান উপকূলের কাছে। সাইক্লোন ও হারিকেনের মতো দুর্যোগের ঝুঁকিও তাদের বেশি। এ কারণেই বাংলাদেশ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষের একদম কাছাকাছি রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ তাদের আবাস হারাতে পারে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি আমাদের স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। কারণ উপকূলীয় এলাকার সম্পদের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ বাংলাদেশি মানুষের সহযোগিতায় জলবায়ু সহিষ্ণুতা সৃষ্টি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির নানা প্রকল্পে সহায়তা, জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।
আপনারা সবাই জানেন, জলবায়ু পরিবর্তন যে সংকট নিয়ে এসেছে তার সমাধান গোপন কিছু নয়। তা হচ্ছে জ্বালানিনীতি, যা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আপনারা যদি সঠিক জ্বালানিনীতি গ্রহণ করতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। আজই আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (এ এইচ মাহমুদ আলী) সঙ্গে বৈঠকে মন্ট্রিল প্রটোকলের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছি। আমরা কথা বলেছি হাইড্রোকার্বন থেকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়েও। শুধু এ কৌশল গ্রহণ করেই আমরা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি আধাডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে ফেলতে পারি। কাজেই এ বিষয়ে আমাদের করার অনেক কিছুই আছে। এই পরিবর্তন আনার জন্য যেসব দেশ লড়াই করছে তাদের শীর্ষে বাংলাদেশের থাকা প্রয়োজন আছে এবং যু্ক্তরাষ্ট্রও এটা প্রত্যাশা করছে।
আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করবে; অতীতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা যেমনটা বাংলাদেশের পাশে থেকেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ, যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি, শ্রমিক ও নারী অধিকার এগিয়ে নেওয়া এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে শত শত কোটি ডলার দিয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ, আমরা বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগেরও (এফডিআই) প্রধান উৎস।
আমাদের এ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক শিল্প। আপনাদের দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশে রাখার কাজেও এটি ভূমিকা রেখেছে। তবে শুধু প্রবৃদ্ধির জন্যই প্রবৃদ্ধি আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। আপনারা উন্নতি করতেই থাকলেন, করতেই থাকলেন, করতেই থাকলেন। কিন্তু এই উন্নতি হতে পারে ভুল মূল্যবোধ ঘিরে। আপনাদের উন্নতির মন্দ ফলও হতে পারে। এমনও হতে পারে, প্রবৃদ্ধি হলো; কিন্তু মানুষ অধিকার পাচ্ছে না, ন্যায্য উপার্জন পাচ্ছে না বা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই একমাত্র প্রবৃদ্ধিই কাঙ্ক্ষিত সূচক হতে পারে না। রানা প্লাজার ধস এবং এর আগে তাজরীন ফ্যাক্টরিতে আগুন—এ দুই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা একটি মৌলিক সত্য আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। আর তা হচ্ছে, যতক্ষণ না বাংলাদেশে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে ততক্ষণ এ দেশ তার মানুষের আশা পূরণ করতে পারবে না এবং উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছবে না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আর এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার, বেসরকারি খাত, ট্রেড ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাতে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানায়। উদ্যোগগুলো হচ্ছে কারখানার নিরাপত্তায় পরিদর্শন বাড়ানো, নিম্নমানের কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, শ্রমিক নিগ্রহের কোনো বিষয়ে নির্ভয়ে অভিযোগ করার ব্যবস্থা থাকা।
তবে এসব উদ্যোগ একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার অংশ। শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের অধিকারও বাড়াতে হবে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানায় শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, তাদের ইউনিয়ন করার অধিকার, দরকষাকষির অধিকারের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক খাত সত্যিকার অর্থে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। কাজটি কঠিনও নয়, সহজ। আর তা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, শোষিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে এমন স্থানে কাউকে কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না।
বেশ কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা আপনাদের বলতে চাই। আমি তখন উত্তর ম্যাসাচুসেটসের লাওয়েল নামের একটি এলাকায় থাকি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রথম পরিকল্পিত জনপদ। শিল্প বিপ্লব এবং ইংল্যান্ডের প্রথম দিকের উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করেই এলাকাটি বিকশিত হয়। এ এলাকার নদীর তীরে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে উঠেছিল। কারণ এ নদীর পানি কারখানার জন্য দরকার ছিল। কাপড়সহ নানা দ্রব্য উৎপন্ন হতো কারখানায়। আমেরিকার জন্য এ উৎপাদন দরকারও ছিল। তবে বিশাল এসব কারখানায় অনেক সময় শিশু শ্রমিক কাজ করত। তারা দুপুরের খাবারের বিরতি পেত না। টয়লেটের বিরতিও তাদের দেওয়া হতো না। ১৬ ঘণ্টা ধরে কাজ করতে হতো। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের অধিকার দান এবং উন্নত কাজের পরিবেশের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। পরিবর্তনও আসে।
আজকের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকান। আমরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে বিকশিত হয়েছি। আমরা এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। চীনও দ্রুত উন্নতি করছে। চীনের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। একদিন চীন আরো বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখনো উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতার অর্থনীতি ধরে রেখেছে। আমাদের অর্থনীতি মানুষকে অধিকতর অধিকার দেয়। কিশোরদের কলেজে যাওয়ার সুযোগ দেয়। তাদের অভিভাবকদের ভালো কাজের সুযোগ করে দেয় এবং উত্তর প্রজন্মও ভালো জীবনযাপনের পরিবেশ পায়। আর তা সম্ভব হয়েছে মূলত এ জন্য যে আমরা শ্রমিকদের অধিকার দিয়েছি এবং তাদের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন সাধন করেছি। আমরা সবার উপকারের কথা বিবেচনা করার মাধ্যমেই জাতি হিসেবে উন্নত হয়েছি। আসলে যখন একটি দেশের সবাই সুবিধা পায় তখন পুরো জাতিই উন্নতি করে। এটাই আসল তত্ত্ব। এ তত্ত্ব আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছি। এখন আমরা যা করার চেষ্টা করছি তা হচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যে এই অর্জনের জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। কাজটা সহজ ছিল না। এসব পরিবর্তনের কিছু কিছু হয়েছে মাত্র গত ১৫ বছরে। সিনেটর টেড কেনেডি এবং অন্যদের ধন্যবাদ, আমাদের দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়ার জন্য তাঁরা কাজ করেছেন এবং তখন আমিও ভোট দিয়েছিলাম, আমাদের দেশ আজ যে অধিকতর শক্তিশালী, এর পেছনে ওই সিদ্ধান্তের অবদান আছে।
কিন্তু আমরা এখনো নানা ক্ষেত্রে লড়াই করছি। সুতরাং আপনাদের প্রতি আমার বার্তা হলো, কখনো ক্ষুব্ধ হবেন না। কারণ রাতারাতি কিছু হয় না। সব কিছুর জন্যই সময় ও শ্রম লাগে। আপনাদের নিজেদের স্বার্থে, জাতির অগ্রগতির প্রয়োজনে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি সমাজের মানুষ নিরাপত্তা বোধ করে কি না তার সঙ্গে সমৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। আর উগ্রবাদীরা এমন স্থানকেই নিজেদের কর্মকাণ্ডের স্থল হিসেবে বেছে নেয়, যেখানে মানুষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের প্রান্তিক, অবহেলিত বোধ করে। সহিংসতার মধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং তা ধরে রাখা অনেক কঠিন। বিনিয়োগের সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক আছে। আপনারা যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশা করেন, তাদের জন্য অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সুধীসমাজ, সেই সঙ্গে গণমানুষের মত প্রকাশের ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করতে হবে। কোনো বিষয়ে দৃষ্টি কাড়ার জন্য উগ্রপন্থা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই, যেন কেউ এমন ভাবার পরিবেশ না পায়।
এসব কারণেই সন্ত্রাসীদের, বিশেষ করে আল-কায়েদা ও দায়েশকে (আইএস) পরাজিত করতে বাংলাদেশ এবং প্রতিটি মহাদেশের অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত রাখবে। ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা ছিল চরম নিষ্ঠুরতা। ওই হামলার স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে বিভক্ত করা এবং সুন্দর এই সমাজকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এর আগে কয়েক বছর ধরে ছোট মাত্রার আরো অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিদেশি নাগরিক, ব্লগার কিংবা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। হামলাগুলোর উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা আপনাদের বিভক্ত করতে চায়। তারা মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তারা চায় অভ্যন্তরীণ বিবাদ।
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে এ ধরনের ঘৃণ্য সহিংসতা আমাদের খুব রূঢ়ভাবে মনে করিয়ে দেয় যে যারা এ ধরনের হামলা চালায় বা মদদ দেয়, তাদের ভৌগোলিক সীমানার প্রতি সম্মান, অন্যের অধিকারের বিষয়ে বিবেচনা এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। তারা বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বও করে না। তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইরাকে মানুষ ইয়াজিদি, শিয়া ও খ্রিস্টান শুধু এ-জাতীয় পরিচয়ের কারণে আইএস জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। আইএস সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে হামলার লক্ষ্য করছে। এ কারণেই আমি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। এ সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে আমাদের এক প্রজন্ম বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। তবে আমি বলতে চাই, আইএসকে আমরা হারাতে যাচ্ছি, তারা হারবেই। আমরা বোকো হারাম ও আল-শাবাবকেও পরাজিত করব। আমরা সেই লক্ষ্যে সঠিক পথে রয়েছি।
তবে আমাদের লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হবে। আর তা শুধু মাঠের লড়াইয়ে নয়, মানসিকতার ক্ষেত্রে। যদি এমন হয়, অনেক তরুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, বেকারত্ব কিংবা হতাশা তাদের পেয়ে বসেছে—উগ্রবাদীরা তাদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। তখন এ সহিংসতা বন্ধ করা যাবে না।
মনে রাখবেন, কোনো দেশই সন্ত্রাসবাদ থেকে নিরাপদ নয়। আর আতঙ্ক ছড়ানো সহজ। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিনে ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাত দিন এবং বছরে ৩৬৫ দিন সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু কেউ যদি মনে করে, যেকোনো দিন সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে পারে। নিজেকে এবং আরো কিছু মানুষকে হত্যাও করতে পারে। এ নিয়ে চমক সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সন্ত্রাসবাদের এ-জাতীয় ঘটনাগুলো খুব ফলাও করে প্রচার যদি না করে, আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক হয়। ঘটনা হচ্ছে, আমাদের সবাইকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সন্ত্রাসীদের পরাজিত করতে হলে আমাদের গণতন্ত্রের মূলনীতি থেকে সরে না এসে, গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতারণা না করে একে বরং আরো সুদৃঢ় করতে হবে। একজন মানুষ কেন সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে? এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর হয়তো নেই। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম। কারণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। যখন মানুষ স্বাধীনভাবে বিতর্ক করতে পারে তখন মিথ্যার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, শান্তির ধর্ম ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা এবং নাশকতায় জড়িয়ে পড়ার সুযোগটি কমে আসে।
অতএব, আজ মানুষের জন্য এই দায়িত্ববোধ বর্তায় যে তারা সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে, সহিংসতার মাধ্যমে ধ্বংস করার দিকে যাবে না। এখন কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, যখন বিভিন্ন দেশ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে, এমন মুহূর্তে গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলো মেনে চলা খুবই কঠিন। আমিও বিষয়টি বুঝি। তবে এখন আমার-আপনার সামনে দুটি পথ খোলা। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখাটাই এ সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি তা না করেন, বিরোধিতা, আতঙ্ক ও উন্মাদনা থেকে সমস্যা আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বন্ধুরা, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ভবিষ্যতের ব্যাপারে বিশ্বাসের এক নতুন বোধ নিয়ে আজ আমি এখান থেকে বিদায় নেব। আর এ নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। আরো বেশি সময় এখানে অবস্থান করার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু সমসাময়িক সংঘাতময় অবস্থা এবং দায়িত্বের বোঝা আমাকে কোথাও বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ দেয় না। এ ব্যাপারে আমার স্ত্রী-সন্তানদেরও জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে আমি আপনাদের প্রাণবন্ত, গতিশীল সমাজের শক্তিটা অনুভব করতে পারছি। আমি তা অনুধাবন করতে পারছি। এখানে দারুণভাবে দায়িত্বশীল মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাকে এ বিষয়ে অবগত করেছেন। আমার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়ালও সব সময় তা বলেন। তাঁরা যথার্থই বলে থাকেন। দুই দেশের পারস্পরিক অংশীদারির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আরো দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আমি এখান থেকে বিদায় নেব।
আমি নিশ্চিত নই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে এত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে টহল দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ব্যবহার করবে, এক দশক আগেও কেউ এ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারত কি না। এখন সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা থেকে শুরু করে মহাসাগরের পরিবেশ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিন্ন স্বার্থ যুক্ত। সব কিছু নিয়েই আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।
একই সঙ্গে এটা বিস্ময়কর নয় যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র শুধু অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে অংশীদার নয়, বন্ধুও বটে। ১৯৭১ সালে যখন আমি যুদ্ধের প্রতিবাদ করছিলাম, যখন সুন্দর এই দেশের অধিবাসীরা ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল তখন বিশ্বের অন্য প্রান্তে কেউ কেউ চোখ সরিয়ে রেখেছিল। আমি আগেই আপনাদের বলেছি, সে সময় আমরা তরুণতর প্রজন্মের একদল মানুষ নাগরিক অধিকার, নারী অধিকার, পরিবেশ বা শান্তিবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম। সময়টা ছিল অসাধারণ। আমরা নতুন নতুন ধারণা ও সম্ভাবনা দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরছিলাম। আর যে বিষয়টি আমাকে গর্বিত করেছিল তার অন্যতম হচ্ছে টেড কেনেডির বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করা এবং এখানে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কাজটি।
চরম গোলযোগপূর্ণ ওই সময়ে সিনেটর কেনেডি এ অঞ্চলে ছুটে এসেছিলেন। তিনি শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে সিনেটে তিনি এখানকার সহিংসতাকে ‘পরিকল্পিত (সিস্টেমেটিক) ত্রাসের রাজত্ব’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরের বছরের শুরুতে তিনি আবার এখানে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধের সময় সেনাদের হামলায় মরে যাওয়া একটি গাছের স্থানে একটি বটের চারা রোপণ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেদিন তিনি সীমিত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত বিষয়ের ওপর আলোচনা করেননি, বরং তিনি কথা বলেন এমন এক সম্পর্ক নিয়ে, যা হবে আরো দৃঢ়, গভীরতর ও বিশ্বজনীন। সেদিন কেনেডি বলেছিলেন, সরকারের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত পররাষ্ট্রনীতি নয়, বরং জনগণের সঙ্গে জনগণের, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা। কারণ এক অর্থে আমরা সবাই বাংলাদেশি, আমরা সবাই আমেরিকান। আমরা সবাই একই বিশাল মানবসমাজের অংশীদার।
যে গাছটি সেদিন আমার সাবেক সিনেট সহযোগী রোপণ করেছিলেন, তা এই দেশ জন্মলাভে দেওয়া রক্ত, আত্মত্যাগ ও সাহসের এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে আছে। বৃক্ষটি এখনো বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বন্ধুত্বের প্রতীক। আজ এই যে আমি এখানে এসেছি তা এই বন্ধুত্বকে দৃঢ় করতে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সম্পর্ক ও সংকল্পকে জোরদার করার লক্ষ্য থেকেই। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের কল্যাণে সেই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণে আপনাদের সবার সঙ্গে কাজ করতে আমি অধীর হয়ে আছি। আমরা যদি একসঙ্গে সঠিকভাবে কাজটি করতে পারি, তা সমগ্র বিশ্বের জন্যই কল্যাণকর হবে।
আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জন কেরি : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সোমবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে এডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টারে রাখা ভাষণের ভাষান্তর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন