বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মোদী-ওবামাকে চিনের তাচ্ছিল্য! বিশ্ব কূটনীতি কি চিরাচরিত সৌজন্যবোধ হারাতে বসেছে? 


চিদানন্দ রাজঘট্ট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের একটা কথা অনেকেরই জানা৷ তা হল, ‘‘নরম সুরে কথা বলো, কিন্তু হাতে সব সময় একটা লম্বা লাঠি রেখে দিও৷’’ বিশ্ব আধিপত্যের রাজনীতিতে এটাই ‘রুজভেল্ট ডকট্রিন’ নামে সুবিদিত৷ ‘টেডি’ রুজভেল্ট আরও একটা কথা বলতেন৷ সেটা হয়তো অনেকেই জানে না৷ তা হল, ‘‘ওদের (অর্থাৎ যারা আমেরিকার বিরোধী করছে) balls টিপে ধরো৷ তাহলেই দেখবে ওদের হৃদয় এবং মন তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছে৷’’ মোটামুটিভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ রুজভেল্টের এই উভয় নীতি নিয়েই বিশ্বে রাজ করেছে মার্কিন প্রশাসন৷ এখন সেই তাদেরই অন্তত কূটনৈতিক সৌজন্যের খাতিরে নানাভাবে ঢিলের বদলে পাটকেল খেতে হচ্ছে৷

সম্প্রতি, চিনের মাটিতে অনুষ্ঠিত G-20-তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তুরস্কের মাটিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বিডেন প্রায় একই রকম কূটনৈতিক অসৌজন্যের মুখোমুখি হয়েছেন৷ এক দেশের প্রতি আর এক দেশের মনোভাব বোঝাতে এভাবে কূটনীতিক শিষ্টাচারকেই বলি চড়ানোর রাস্তা নিচ্ছেন অনেক রাষ্ট্রনেতা৷ আর মিডিয়ার শ্যেনচক্ষুতে তা ধরাও পড়ে যাচ্ছে৷ যেমন, ওবামা যখন সৌদি আরবের রাজার মুখোমুখি হচ্ছেন তখন তিনি ঘাড় ঝোঁকাতে ঝোঁকাতে ঠিক কতখানি মেরুদণ্ড বাঁকিয়েছেন এবং তার পর উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট তুলে কীভাবে সোজা করছেন তাও যেমন মিডিয়া ধরে ফেলছে, ঠিক তেমনই ভিন দেশের এয়ারপোর্টে কোন দেশের হয়ে কে কাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে সেটাও তারা দেখছে এবং বাদবাকি দুনিয়াকে দেখাচ্ছে৷


দীর্ঘদিন ধরেই চিনে কূটনৈতিক সৌজন্যের একটা সুন্দর রেওয়াজ ছিল৷ চৌ এন লাই থেকে দেং জিয়াও পিং, কারও সময়েই তাতে খামতি ঘটেনি৷ তার কারণ হাজার হাজার বছর ধরে কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে সান জু-র শিক্ষা৷ চিন সভ্যতার কূটনৈতিক সৌজন্যে তাই ছিল সনাতন ভারতীয় দর্শনেরই ছায়া৷ অতিথি দেব ভবঃ৷ কিন্তু ক্রমে সেই চিনও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে৷ হয়তো অর্থনৈতিক অস্থিরতা তার একটা বড় কারণ৷ চিদানন্দ রাজঘট্ট লিখছেন, কূটনৈতিকভাবেও চিনের সর্বত্রই এখন একটা ‘আমিই প্রধান, আমিই প্রধান’ ভাব৷ ‘ভুলে যেও না, এটা আমাদের দেশ, এটা আমাদের এয়ারপোর্ট’, এই রকম আর কি৷ আর সে কারণেই তারা হ্যাংকাওয়ে (অধুনা হ্যাংঝাউ) G-20-র গ্রুপ ফটোয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পাঠিয়ে দিয়েছে একেবারে মার্জিনের ধারে, ডানদিকের সাইডলাইনে৷ G-20-র সামনের সারির সেন্টার সার্কেলে চিনা সভ্যতার বরাবরের প্রতিবেশী সভ্যতার রাষ্ট্রনেতার ঠাঁই হয়নি৷ ছবিতে সামনের সারিতে মধ্যমণি চিনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং৷ আর তাঁর দুদিকে রয়েছেন তুরস্ক আর জার্মানির দুই রাষ্ট্রপ্রধান৷ যদিও এখনও পরমাণু শক্তির নিরিখে আজও বিশ্বের দুই মহাশক্তিধর বলতে বারাক ওবামা কিংবা ভ্লাদিমির পুতিনকেই বোঝায়৷ তবু জি জিংপিনের দুপাশে তাঁরাও নেই৷

চিদানন্দ রাজঘট্টর মতে, একটা দেশ যখন নিজে অস্তিত্বের বিপন্নতায় ভোগে তখনই তার মধ্যে এ ধরনের একটা মানসিকতা দেখা যায়৷ তাঁর বক্তব্য, ভারতের উদীয়মান শক্তি লালচিনও রীতিমতো টের পাচ্ছে৷ আর সে কারণেই তারা কূটনৈতিক সৌজন্যের ক্ষেত্রে ভারতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে৷ আমেরিকা ভারতের এই শক্তিবৃদ্ধিতে খুশি৷ অতএব আমেরিকাকেও তারা পাত্তা দিতে চায় না৷ ঠিক যেমন এক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির প্রতি এহেন কূটনৈতিক অসৌজন্য ও অশিষ্টাচার দেখিয়েছিলেন পাক একনায়ক জেনারেল পারভেজ মোশারফ৷ পক্ষান্তরে, আমেরিকায় পা দেওয়ার পর বাজপেয়ি এবং মনমোহন সিং উভয়কেই নিজেরা এগিয়ে গিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট বুশ এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা৷ তুরস্ক, ন্যাটোয় যারা কিনা এখনও টিঁকে রয়েছে মার্কিন প্রশাসনেরই বদান্যতায়, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট এরদোগান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বিডেনকে আঙ্কারায় অভ্যর্থনা জানালেন সাধারণ স্তরের কয়েকজন আমলাকে পাঠিয়ে৷ তুরস্কের চোখে আমেরিকার প্রশাসনের ‘অপরাধ’, চিরাচরিত মার্কিন ঐতিহ্য মেনে তারা বিদ্রোহী তুর্কি নেতা ফেতুল্লা গুলেনকে আশ্রয় দিয়েছে৷ একইভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করে মিডিয়ার সামনে ছাপার অযোগ্য ভাষায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন এশীয় ভূ-রাজনীতির নগণ্য দুকড়ি, ফিলিপিনো প্রেসিডেন্ট দুতার্তে৷ বলেছেন, লাওসে দেখা হলে ওবামাকে তিনি দেখে নেবেন৷ একে তো হাস্যকর ব্যাপার, তার উপর যে দেশের বন্দর থেকে মার্কিন নৌবাহিনী সরে গেলে সে দেশকে চিনের গিলে খেতে চব্বিশ ঘণ্টাও লাগবে না, তারা সার্বভৌমত্বের দোহাই পাড়ছে! এক্ষেত্রে ওবামা-র ‘অপরাধ’, ড্রাগ মাফিয়াদের শেষ করার অভিযানে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন তিনি৷

ভারতের প্রতি কূটনৈতিক অসৌজন্য আমেরিকা একবারই দেখিয়েছিল৷ সেটা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার আগে তাঁকে একবার ২০ মিনিট হোয়াইট হাউসের ভিজিটর্স রুমে বসিয়ে রেখেছিলেন কিসিঞ্জারের হাতের পুতুল নিক্সন৷ তখন নিক্সন-কিসিঞ্জারদের হোয়াইট হাউসে অন্তরঙ্গ কথাবার্তায় ইন্দিরা গান্ধীকে ‘কুত্তি’ বলে সম্বোধন করা হত৷ ইন্দিরা গান্ধীও সাক্ষাতের পর নিক্সনকে হাবেভাবে বুঝিয়ে দেন যে, আপনার মতো বোরিং পাবলিক খুব কমই আছে৷ নিক্সনই হলেন আমেরিকার সেই প্রেসিডেন্ট, উডওয়ার্ড ও বার্নস্টাইন এই দুই সাংবাদিকের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁসের সূত্রে যাঁকে ইমপিচ করা হয়েছিল৷ এক এই নিক্সন ছাড়া আমেরিকার আর কোনও প্রেসিডেন্টই ভারতের কোনও শীর্ষনেতাকে কখনও অসম্মান করেননি, অসৌজন্য তো দূরস্থান৷ একটা সময় ছিল যখন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার স্বয়ং চিঠি লিখে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর পরামর্শ চাইতেন৷

ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সেই কূটনৈতিক সৌজন্যের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে৷ ২০১৪ সালে আমেরিকায় গিয়ে মার্টিন লুথার কিংয়ের সৌধে যখন পদার্পণ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তখন ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে সঙ্গ দেন বারাক ওবামা৷ সেই সৌজন্যের যোগ্য প্রত্যুত্তর দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও৷ ২০১৫ সালে ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবসে তাই প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ পান মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷

চিদানন্দ রাজঘট্: টাইমস অব ইন্ডিয়ার বিখ্যাত সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন