বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ফারাক্কা ব্যারেজের জন্য বিহারে বন্যা হয়নি, হলে প্রথমেই প্লাবিত হত মালদহ জেলা


যদি ফরাক্কা ব্যারেজের জন্যই বিহারে বন্যা হত তবে প্রথমেই প্লাবিত হত মালদহ জেলা৷ কিন্তু এ বছর এখনও সেখানে বন্যা হয়নি৷ ‘বাঁধ-ভেঙে-দাও ডাক বনাম নদীপথের বাস্তব’তা নিয়ে লিখছেন ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ

 কল্যাণ রুদ্র 

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার গত ২৩ অগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার দাবি করেছেন৷ তাঁর অভিযোগ ব্যারেজের জন্যই গঙ্গার খাতে পলি জমছে, বর্ষার বিপুল জলস্রোত বয়ে যাওয়ার পথ সঙ্কীর্ণ হয়েছে৷ আর এই জন্যই বিহারে বন্যা হচ্ছে৷ এ বছর বিহারে অাগস্ট মাসে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ কম বৃষ্টি হলেও ৩০ লক্ষ মানুষ বন্যায় বিপন্ন৷ বিহারের আগেই প্লাবিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ ও বারাণসী শহর৷ উজানের সেই জলের সাথে নেপাল থেকে নেমে আসা সারদা, ঘর্ঘরা ও কোশির জল যুক্ত হয়েই যে বিহারে এই বন্যা এ কথা নীতীশ কুমার বিলক্ষণ জানেন৷ তবু তিনি হঠাৎ কেন এমন দাবি করলেন এবং প্রধানমন্ত্রীই বা কেন এ বিষয়ে অনুসন্ধানের আশ্বাস দিলেন তা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের বিষয়; তবে ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার দাবি আমরা আগেও শুনেছি৷

১৯৭৬ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের কয়েক হাজার মানুষ মৌলানা ভাসানির নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত মিছিল করে এসেছিলেন৷ তাদের দাবি ছিল ‘ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেল’৷ এর পর ভাগলপুরের মৎস্যজীবীরাও সোচ্চার দাবি তুলেছিলেন ‘ফরাক্কা ব্যারেজ তোড়ো’৷ ওদের যুক্তি ছিল আগে ইলিশ মাছ বেনারস ও এলাহাবাদের গঙ্গায় এমনকী আগ্রার গা-ঘেঁষে বহমান যমুনাতেও পাওয়া যেত৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালে ব্যারেজ নির্মাণের পর ইলিশের সেই অবাধ গতিপথ বন্ধ হয়েছে৷ এ কথা অনস্বীকার্য যে  মৎস্যজীবীদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়৷ শুধু ফরাক্কা কেন কানপুরেও তো আরও একটি ব্যারেজ তৈরি হয়েছে৷ গত ৪ অগস্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতী সংসদে জানিয়েছন ফরাক্কা ব্যারেজের পাশ দিয়ে ইলিশ মাছের যাতায়াতের পথ বা ফিস ল্যাডার তৈরি করা হবে৷ সেই পথ করে দিলেও দূষিত গঙ্গা -যমুনার উজান বেয়ে ইলিশ মাছ আগের মতোই যাতায়াত করবে এমন ভাবনার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা এই নিবন্ধের বিষয় নয় ; তাই ফিরে আসি নীতীশ কুমারের কথায় ; ফরাক্কা নিয়ে তিনি যা বলেছেন তার যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে৷ উল্লেখ্য ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের আগেও বিহারে বন্যা হত , এখন বন্যার ব্যান্তি বেড়েছে কিনা তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়৷

নীতীশ কুমারের দাবিতে বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক যারপরনাই উল্লসিত কারণ ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার ওদের অনেক দিনের দাবিতে এ দেশেও সিলমোহর পড়ল৷ কিন্তু ওঁরা যে কথা ভাবেননি তা হল চার দশক ধরে ব্যারেজের উজানে যত পলি আর পাড়-ভাঙা বোল্ডার জমেছে তা বর্ষার প্রবল স্রোতের টানে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হলে গঙ্গা-পদ্মা ও তার শাখানদীগুলির খাতের কী হাল হবে? তাই প্রতিবেশী বন্ধুদের কাছে বিনীত অনুরোধ, একটু ভাবুন, ভাবা অভ্যেস করুন৷ 

ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়েছিল কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য৷ আশা করা হয়েছিল গঙ্গা থেকে ৪০০০০ কিউসেক জল ভাগীরথীতে আনতে পারলে মোহানার সব পলি ধুয়ে সাগরে চলে যাবে; নৌ-পরিবহণের পথ সুগম হবে৷ সেই উদ্দেশ্যে ফরাক্কায় ব্যারেজের উজানে ৮.৭০ কোটি ঘনমিটার জল আটকে গঙ্গার জলস্তর প্রায় ৭ মিটার উঁচুতে তোলা হয়েছে৷ ৩৮ কিমি দীর্ঘ ফিডার খাল দিয়ে গঙ্গা ও ভাগীরথীকে যুক্ত করা হয়েছিল৷ ভরা বর্ষায় ফরাক্কা ব্যারেজে অতিরিক্ত জল জমতে থাকলে উজানেও তার প্রভাব পরে৷ রাজমহল থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার গতিপথে এই প্রভাব স্পষ্ট বোঝা যায়৷ এ কথাও সত্যি যে স্বাভাবিক নিকাশি ব্যাহত হয় বলেই ব্যারেজের উজানে পলি জমে এবং গঙ্গার জলের সাথে প্রতি বছরে ভেসে আসা প্রায় ৫০ কোটি টন পলির কিছুটা নদী খাতে জমে থাকে৷ নীতীশ কুমার যা বলেননি তা হ’ল ব্যারেজ নির্মাণের পর মালদহে গঙ্গার গতিপথ বদলে গেছে৷ এখন রাজমহল ও ফরাক্কার মাঝে গঙ্গা ধনুকের মতো বাঁকা পথে বইছে৷ নদীর স্রোত ব্যারেজের মাঝামাঝি আঘাত করলে ১০৯টি গেট দিয়ে সমান ভাবে জল প্রবাহিত হতে পারত, কিন্তু এখন বাঁকা পথে বয়ে আসা স্রোত ব্যারেজের দক্ষিণ-পশ্চিম বা মুর্শিদাবাদের দিকে জমে যাচ্ছে৷ ডিজাইন অনুযায়ী ব্যারেজের প্রতিটি গেট দিয়ে এক সেকেন্ডে ৩০০০০ ঘনফুট (কিউসেক) জল প্রবাহিত হতে পারে৷ এ কথা সত্যি যে ব্যারেজের সব গেট খুলে দিলেও জল বেরিয়ে যেতে সময় লাগে; কিন্তু এটাই বিহারের বন্যার কারণ এমন কথা ভাবা অর্থহীন৷ এই বছর উত্তর ভারতে অতিবৃষ্টির জন্য গঙ্গা অাগস্ট মাসে স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা উপর দিয়ে বইছিল ; এই নিবন্ধটি যখন লিখছি তখন গঙ্গার জলস্তর কানপুর, এলাহাবাদ ও বারাণসীতে বিপদ সীমার উপরে উঠে আবার নামতে শুরু করেছে৷ ওই জল যে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে সে কথা নীতীশ কুমারের অজানা নয়৷ গঙ্গা বিহারে প্রবেশ করার পর তার সাথে যুক্ত হয় নেপাল থেকে নেমে আসা কোশি, গন্ডক, ঘর্ঘরা এবং দাক্ষিণাত্যের নদী শোন৷ এত জল গঙ্গা ধারণ করতে পারে না বলেই দু’কূল ছাপিয়ে ওঠে৷ প্লাবনভূমিতে নতুন পলি ছড়িয়ে কয়েক দিন পর জল নেমে যায়৷ নদীখাত গভীর হয় আর বহু ব্যবহারে ক্লিষ্ট প্লাবনভূমি আবার উর্বর হয়ে ওঠে৷ এ সব কথা বিহারের মানুষরা বিলক্ষণ জানেন৷ যদি ফরাক্কা ব্যারেজের জন্যই বিহারে বন্যা হত তবে প্রথমে প্লাবিত হত মালদহ জেলা৷ কিন্তু মালদহের গঙ্গা বিপদসীমার সামান্য উপর দিয়ে বইলেও এ বছর এখনও বন্যা হয়নি৷ উল্লেখ্য ফুলহার নদী মানিকচকের কাছে গঙ্গায় মেশার আগে দু’কূল ভাসিয়েছে; কারণ ওই নদীটিও কোশির মতোই হিমালয়ের জল বয়ে আনে৷

যদি নীতীশ কুমারের দাবি মেনে ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলা হয় তা হলে পশ্চিমবঙ্গে কী প্রভাব পড়বে সেই আলোচনা জরুরি৷ প্রথমেই বলা দরকার ১৯৭৫ সাল থেকে ভাগীরথী -হুগলি নদী ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে জল পাচ্ছে৷ ৫০০ কিমি দীর্ঘ ভাগীরথী নদীতে দক্ষিণে সাগর থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত জোয়ার -ভাঁটা খেলা করে৷ আর উজান থেকে যে জল বয়ে আসে তা মূলত আসে ফিডার খাল দিয়ে৷ বর্ষায় অজয়, ময়ূরাক্ষী, বাঁশলই, পাগলা --- এই সব নদী প্রচুর জল ভাগীরথীতে নিয়ে এলেও গ্রীষ্মে শুকিয়ে যায়৷ তখন ফিডার খাল দিয়ে বয়ে আসা ফরাক্কার জলই একমাত্র ভরসা৷ ওই জল না পেলে জঙ্গিপুর থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত ভাগীরথীর ২২০কিমি গতিপথে অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত জল থাকবে না, নদী আগের মতো হেঁটেই পার হওয়া যাবে৷ গত চার দশক ধরে ভাগীরথীর বাস্ত্ততন্ত্র ব্যারেজের জলের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে৷ নদীর ওই অংশের জল আপেক্ষিক ভাবে কম দূষিত বলে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন আর বাঙালির অতিপ্রিয় ইলিশ মাছ৷ সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিসারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর গবেষণা থেকে জানা গেছে এই নদীতে এখনও ২২৫ প্রজাতির মাছ বেঁচে আছে এবং মৎস্যজীবীদের সংখ্যা প্রায় ২৬০০০৷ নদীপাড়ের ৩৮টি পুরসভা ও তিনটি কর্পোরেশন এই নদী থেকেই পানীয় ও গৃহস্থালির জন্য জল সরবরাহ করে৷ ফরাক্কা ব্যারেজের জল আসা বন্ধ হলে মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার জল সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, অন্য দিকে হুগলি নদীর জল লবণাক্ত হয়ে যাবে৷ এই দুই জেলার ভূগর্ভের জল আর্সেনিকে দূষিত বলে নদী থেকে জল সরবরাহ করাই একমাত্র নিরাপদ উপায়৷ জঙ্গিপুর থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত ভাগীরথী নদীর খাত যদি কোনও দিন শুকিয়ে যায় তবে তা হবে এক জাতীয় বিপর্যয় কারণ হলদিয়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত গঙ্গা এক নম্বর জাতীয় জলপথ হিসেবে স্বীকৃত৷ নদীর এই অংশের সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ‘নমামি গঙ্গা ’ প্রকল্পের অধীনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে৷ গঙ্গা-ভাগীরথী ফিডার খাল সহ প্রায় ২৬০ কিমি নদীপথ শুকিয়ে গেলে প্রকল্পটি বাতিল করতে হবে৷

নীতীশ কুমারের দাবিতে বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক যারপরনাই উল্লসিত কারণ ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার ওদের অনেক দিনের দাবিতে এ দেশেও সিলমোহর পড়ল৷ কিন্তু ওঁরা যে কথা ভাবেননি তা হল চার দশক ধরে ব্যারেজের উজানে যত পলি আর পাড়-ভাঙা বোল্ডার জমেছে তা বর্ষার প্রবল স্রোতের টানে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হলে গঙ্গা-পদ্মা ও তার শাখানদীগুলির খাতের কী হাল হবে? তাই প্রতিবেশী বন্ধুদের কাছে বিনীত অনুরোধ, একটু ভাবুন, ভাবা অভ্যেস করুন৷ পৃথিবীর এই বৃহত্তম গণতন্ত্রে আঞ্চলিক রাজনীতি নানা জটিল পথে আবর্তিত হয়৷ ফরাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার এই অবাস্তব দাবি জাতীয় রাজনীতিতে কতটা গুরুত্ব পাবে তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে৷ তত দিনে গঙ্গা প্লাবনভূমিতে পলি ছড়িয়ে আবার তার খাতে ফিরে যাবে৷ এই ভাবেই গঙ্গা ভারতের কৃষি-অর্থনীতিকে লালন করেছে সেই অনাদি কাল থেকে৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন