ডেমোক্রেসি টোয়েন্টি থার্টি (২০৩০ সালের গণতন্ত্র) ও গণতন্ত্র দিবস
গত ১৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ছিল বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস। সাংসদদের বৈশ্বিক সংগঠন—আন্তসংসদীয় ইউনিয়ন, আইপিইউ এক বিবৃতিতে আইপিইউ বলেছে, একটি ন্যায্যতর বিশ্ব প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য জাতিসংঘের ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন সূচিতে তুলে ধরা হয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী কেবলমাত্র অধিকতর গণতন্ত্রের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বিশ্বনেতারা যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস-এসডিজি) নির্ধারণ করেছেন বিশ্বনেতারা তার সঙ্গে অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণের দাবিকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত এসডিজি অনুমোদনের সময়ই নিয়েছিলেন। তখনই সিদ্ধান্ত হয়, এ বছরের বিশ্ব গণতন্ত্র দিবসের প্রতিপাদ্য বা মূল ভাবনায় থাকবে ২০৩০ সালের গণতন্ত্র (ডেমোক্রেসি টোয়েন্টি থার্টি)।গত বছরে আইপিইউ ওই বিবৃতিতে রাজনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আইপিইউ বলছে, ২০৩০ সালের এখনো অনেক বাকি মনে হলেও বহু দেশেই মাত্র তিনটি নির্বাচনী পালাতেই সময় শেষ হয়ে যাবে। আইপিইউ তাই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে রাজনীতিতে বহুমতের জায়গা করে দেওয়া এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে পার্লামেন্টগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এসডিজির লক্ষ্য, অগ্রাধিকার এবং সূচকসমূহ ঠিক করায় জনগণের মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করার জন্যও পার্লামেন্টগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবসে গণতন্ত্র থেকে অধিকতর বা উচ্চতর গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্রের ধারণায় ঘাটতি প্রকট, সেখানে অধিকতর গণতন্ত্রের বাণী কি একটু পরিহাসের মতো শোনায় না? গণতন্ত্র কার্যকর থাকলে তবেই না অধিকতর গণতন্ত্রের প্রশ্ন আসে!
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আইপিইউর বিবৃতিতে সাবের হোসেন চৌধুরীর উদ্ধৃতিও রয়েছে। আইপিইউ নামের এই বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি বাংলাদেশের এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী। দেশের নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন আইপিইউর নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
সাবের চৌধুরী বলেছেন, ‘২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নসূচি বাস্তবায়নের নিরিখে আমরা সব পার্লামেন্টের প্রতি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সৃজনশীল চিন্তার আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি বলেছেন যে পার্লামেন্টগুলোর জন্য এটি একটি বড় সুযোগ। সাবের চৌধুরীর ভাষায়, ‘অধিকতর গণতন্ত্র ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি এনে দিতে পারে, যার ফলে আরও গণতন্ত্রায়ণ সম্ভব হবে...।’
ঘটা করে বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস পালনের চল শুরু হয়েছে বেশি দিন নয়। মাত্র ২০০৮ সাল থেকে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবই হচ্ছে এই দিবস পালনের ভিত্তি। এবারে বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উদ্যাপনে আইপিইউ অধিকতর গণতন্ত্রের প্রসারে বিশ্বের বিভিন্ন পার্লামেন্টে কতগুলো ধারণা নিয়ে নাগরিকদের সঙ্গে বিতর্কের কথা বলেছে। যেমন: ২০৩০ সাল নাগাদ মানুষ কি অনলাইনে ভোট দেবে? নাকি আইনের খসড়া আসবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে (ক্রাউডসোর্সিং)? তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কি যথেষ্ট? নাকি নতুন কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে? ভবিষ্যতের পার্লামেন্ট কি আজকের মতো থাকবে?
দিবসটি পালনে নানা দেশের পার্লামেন্ট নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকে। পার্লামেন্টারিয়ানদের দুটি বৈশ্বিক সংগঠন—আইপিইউ এবং সিপিএর (কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন) দুই সভাপতি যে পার্লামেন্টের সদস্য সেই পার্লামেন্ট দিবসটি উদ্যাপনে কোনো কর্মসূচি পালন করেছে, এমন কোনো খবর আমার চোখে পড়েনি। এ ধরনের দিবস পালনে কোনো দেশে গণতন্ত্রের যে খুব একটা উপকার হয়েছে তেমন দাবি কেউ কখনো করেননি; বরং এ প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ তথ্য জানিয়ে রাখি। প্রথমবার এই দিবসটি পালনে থাইল্যান্ড জনসাধারণের জন্য এক সপ্তাহ পার্লামেন্ট ভবন খুলে দিয়েছিল। সেই থাইল্যান্ডে কয়েক বছর ধরেই চেপে আছে সামরিক শাসন। রাজনীতিকেরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে অধিকতর গণতন্ত্রের কথা বললেই যে নাগরিকেরা সব স্বাধীনতা পেয়ে যাবেন, এমন প্রত্যাশা না করাই ভালো। দিবস উদ্যাপনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নাগরিকদের ক্ষমতায়নের প্রশ্ন। রাজনীতিকেরা যে তাতে আগ্রহী হবেন না সেটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশে যেমন সাংসদদের কাজকর্মের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় ট্রান্সপারেন্সির মতো নাগরিক অধিকার গোষ্ঠীর ওপর খড়্গ ওঠাতেই সাংসদদের কেউ কেউ ব্যতিব্যস্ত। ভারত, ভিয়েতনাম, চীন এসব দেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ভারতে গ্রিনপিসের পর অ্যামনেস্টির ওপর নেমে এসেছে খড়্গ। অথচ অ্যামনেস্টি তার এশীয় কার্যক্রমের কেন্দ্র লন্ডন থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল।
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবসে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন যে নাগরিক সমাজের স্বাধীনতাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রে প্রয়োজন অংশগ্রহণমূলক নাগরিকত্ব, স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ এবং অন্তর্ভুক্তি।
ইইউর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নাগরিকদের সঙ্গে তাঁদের প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ এবং আস্থার সম্পর্ক প্রায়ই টানাপোড়েনের মুখে পড়ে, যাতে সামাজিক উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়। ইইউ তাই বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র সংহত করার প্রক্রিয়ায় সহায়তার কথা বলেছে।
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবসে সবাই গণতন্ত্রের গুণগান করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি গণতন্ত্র থেকে অধিকতর বা উচ্চতর গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্রের ধারণায় ঘাটতি প্রকট, সেখানে অধিকতর গণতন্ত্রের বাণী কি একটু পরিহাসের মতো শোনায় না? গণতন্ত্র কার্যকর থাকলে তবেই না অধিকতর গণতন্ত্রের প্রশ্ন আসে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন