পাকিস্তানের মতো অসৎ ও চতুর দেশের বিরুদ্ধে সাত-পাঁচ না ভেবেই বোকার মতো যুদ্ধে নেমে পড়া উচিত নয়
অভিজিৎ ভট্টাচার্য
দৈনিক এই সময়, কলকাতা
১৯৪৭ সালে জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের বিবিধ মানসিক সমস্যা৷ হীনম্মন্যতাও বিপুল৷ এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই৷ এই যে গত ৬৮ বছর ধরে পাকিস্তানের প্রকৃত শাসক জুটি সেনা এবং আইএসআই সে দেশের নাগরিকদেরই কার্যত ধোঁকা দিয়ে চলেছে আর ১৯৮৯ থেকে ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ছায়াযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, তার কারণও আর কিছুই নয়, ওই মানসিক সঙ্কট৷ এর মধ্যে চার দফায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছে, যথাক্রমে ১৯৪৭, ১৯৬৫ , ১৯৭১ ও ১৯৯৯ -এ, তবে কাজের কাজ কিছু করে উঠতে পারেনি৷ যে হেতু ইসলামাবাদ এখন জানে যে, পুরোদস্ত্তর যুদ্ধে ভারতকে হারানো অসম্ভব , মূলত ভারতের উন্নততর অর্থনৈতিক ভিত্তির কারণেই অসম্ভব, সুতরাং বোঝাই যায় যে, ভোরবেলা উরিতে হামলা চালিয়ে ঠান্ডা মাথায় ১৮ ফৌজিকে হত্যা করার এই মতলব কেন৷ পাকিস্তানের দুরভিসন্ধিই হোক, বা ইসলামাবাদের সন্ত্রাসী যুদ্ধ, উরি-র এই ঘটনা তারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ৷এ কথা বলাই চলে যে, ইসলামিক মৌলবাদের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর পাকিস্তান৷ এবং সেই যে ১৯৭৭-এ পাক ফৌজি শাসক জিয়াউল হক সেনাবাহিনীর তদানীন্তন ‘মটো’ অর্থাত্ ‘একতা, বিশ্বাস, শৃঙ্খলা’ বদলে ‘মটো’ হিসাবে নয়া ফরমান জারি করলেন ‘ইমান, তকওয়া, জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহ’, অর্থাত্ ‘বিশ্বাস, ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও আল্লার পথে সংগ্রাম’--- সেই সময় থেকে ‘জিহাদ’-ই পাক সেনাবাহিনীর চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াল৷ এ রকম একটা প্রেক্ষিত মাথায় রেখে যখন দেখি বিভিন্ন মিডিয়ায়, তা সে প্রিন্টই হোক বা ইলেকট্রনিক, পণ্ডিতেরা কাণ্ডজ্ঞানহীন হুঙ্কার দিচ্ছেন, ‘যুদ্ধে চলো’ কিংবা ‘পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দাও’, তখন অবাক হই৷
‘কোনও রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ সাক্ষাৎ মরণ-বাঁচনের বিষয়’৷ অর্থাৎ, তাড়াহুড়ো করে বা নেহাত্ ঝোঁকের বশে যুদ্ধ ঘোষণা নৈব নৈব চ: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের চিনা দার্শনিক জেনারেল সুন জু'র ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ গ্রন্থ থেকে
হ্যাঁ, ভারত যুদ্ধে যেতেই পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু করা উচিত? কাজটা সঠিক হবে? সেই ১৯৮৯ থেকে তো পাক-সাহায্যপুষ্ট জঙ্গিরা সে দেশের অঙ্গুলিহেলনে আমাদের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছে৷ তা হলে এখন আর নতুন করে কী-ই বা যুদ্ধ ঘোষণা দরকার? যাঁরা দু’দেশের প্রকাশ্য যুদ্ধ দেখার আগ্রহে অস্থির, তাঁদের উদ্দেশে একটি বিনীত পরামর্শ৷ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে জনৈক চিনা দার্শনিকের লেখা একটি বই পড়ে দেখুন৷ জেনারেল সুন জু-র ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’৷ ৬৫ পাতার বইতে ১৩টি পরিচ্ছেদ৷ যে সব বিশেষজ্ঞ, প্রতিরক্ষাবিদ এবং নীতি নির্ধারকেরা এখনও পড়ে উঠতে পারেননি, দ্রুত চোখ বোলালে বইটি তাঁদের ভালো লাগবে৷ সুন জু লিখছেন ‘কোনও রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ সাক্ষাৎ মরণ-বাঁচনের বিষয়’৷ অর্থাত্, তাড়াহুড়ো করে বা নেহাত্ ঝোঁকের বশে যুদ্ধ ঘোষণা নৈব নৈব চ৷
যুদ্ধ ঘোষণা যদি করতেই হয়, তার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সব দিক খতিয়ে দেখতে হবে৷ কারণ, এক বার যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন বুক ঠুকে বলা অসম্ভব যে, ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে, লড়াইয়ের মেয়াদের দিক থেকে বা অর্থনৈতিক ফলাফলের দিক থেকে ঠিক কী দাঁড়াবে তার পরিণাম৷ যদি সত্যিই ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পথে হাঁটতে চায়, তা হলে ১৯৭১-এর মতো একেবারে ঠান্ডা মাথায় হিসেব কষে এগোতে হবে৷ ১৯৬২-তে চিনের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়োয় যুদ্ধে নেমে যে ভাবে মুখ পুড়েছিল, ১৯৬২ -র ২০ অক্টোবর, শনিবার, নামকা চু-র যুদ্ধে মাত্র দু’ঘণ্টায় ভারতীয় সেনাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল চিনা ফৌজ, সেই দশা নিশ্চয়ই বাঞ্ছনীয় নয়৷ অসম এবং বেলাগাম সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনার চারটি ‘ক্র্যাক ইউনিট’ ধূলিসাত্ হয়ে যায় --- ওয়ান শিখ, নাইন পাঞ্জাব, টু রাজপুত এবং ওয়ান বাই নাইন গোর্খা ইউনিট৷ যুদ্ধবন্দি হন ভারতীয় সেনার ব্রিগেডিয়ার৷
আসল কথাটা আজ এই যে, জঙ্গিদের তো বটেই, পাশাপাশি ‘টেরর -স্টেট’ পাকিস্তানকেও মুখের মতো জবাব দেওয়া জরুরি৷ কিন্তু, তার জন্য কোনও ভাবেই পাকিস্তানের প্ররোচনায় পা দেওয়া যাবে না৷ যুদ্ধের ঠিকঠাক প্রস্ত্ততি না থাকলে আরও বিপাকে পড়ার শঙ্কা প্রবল৷ বরং, সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য গোড়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করতে পারে ভারত৷ তার পরের ধাপে আসতে পারে পাকিস্তানের গোপন ছায়াযুদ্ধের জবাব৷ কবে, কখন, কোথায়, কী পদ্ধতিতে তা চালানো হবে, তা নয়াদিল্লি স্থির করে নিতে পারে৷ শত্রু-সেনাকে নিকেশ করা বা তাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য কেউ আর প্রকাশ্য যুদ্ধে যায় না৷ এমনকী, প্রকাশ্য যুদ্ধে যারা যথেষ্ট দড় ছিল, সেই পশ্চিমি দেশগুলিও এখন এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক৷ এই জাতীয় যুদ্ধ কত দূর ফলপ্রসূ, সে ব্যাপারেও তারা যথেষ্ট সন্দিহান৷ এখন তারা আর একা লড়াইতে নামতে আগ্রহী নয়৷ দৃষ্টান্ত অজস্র৷ আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, কসোভো, সুদান …একই ভাবে জেহাদি রাষ্ট্র পাকিস্তানের কার্যকলাপের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং হতাশ, তেমন কিছু সমমনস্ক দেশকে জড়ো করে কি গোপনে একটি গোষ্ঠী বানিয়ে ফেলতে পারে ভারত? এ সব কথার মধ্যে সারসত্যটি সরল--- লড়তে ভারতকে হবেই৷ কিন্তু, পাকিস্তানের মতো অসৎ ও চতুর একটি দেশের বিরুদ্ধে, জন্ম থেকেই ধর্মভিত্তিক মানসিক সঙ্কট এবং অন্য বিবিধ সীমাবদ্ধতার শিকার একটি দেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে, সাত-পাঁচ না ভেবেই বোকার মতো যুদ্ধে নেমে পড়া কদাপি উচিত নয়৷ ভারত যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, তা হওয়া উচিত নিয়ন্ত্রিত৷ একেবারে নিখুঁত হিসেব কষে, তবেই৷ সিদ্ধান্তও নিতে হবে গোপনে৷ কখনওই সংবাদমাধ্যমে ফলাও প্রচার করে বা মাইক ফুঁকে নয়৷
অভিজিৎ ভট্টাচার্য: ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তনী৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন