বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভিয়েতনাম যুদ্ধে লাওসের-ক্ষতে ওবামার প্রলেপ 


ভিয়েনতিয়ানে: ছোট্ট দেশ লাওসের বুকে আজও তাজা যুদ্ধের স্মৃতি! আজও চোখ বুজলেই কানে আসে বোমারু বিমানের ঝালাপালা গর্জন ! আজও মাঠে -ঘাটে লুকোনো মরণ ফাঁদ! যুদ্ধ শেষের দুই দশক পরও এভাবেই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চলেছে একটি দেশ৷ যার নাম লাওস৷ ভিয়েতনাম-যুদ্ধের ৫০ বছর পর, প্রথম যে দেশের মাটিতে পা রাখলেন কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ চেষ্টা করলেন ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার৷

উত্তর ভিয়েতনামকে কোনঠাসা করতে, এই লাওসের উপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করেছিল মার্কিন সেনা৷ ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ --- এই ৯ বছরে যে পরিমাণ বোমা এই খুদে দেশটির উপর ফেলা হয়েছিল, অত সংখ্যক বোমা নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ব্যবহার হয়নি! মোটামুটি গড় করলে দাঁড়ায়, মিনিটে ৮টি বোমা! যা গোটা একটা সভ্যতাকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট৷ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় হোক কিংবা পরবর্তীকালে, নানা সময়ে নানা মহলে এই হামলার জন্য সমালোচিত হতে হয়েছে আমেরিকাকে৷ তবে, দুঃখপ্রকাশ করা তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত কখনও অনুশোচনার সুরও শোনা যায়নি কোনও মার্কিন রাষ্ট্রনেতার গলায়৷ সেই ইতিহাসে বদল আনলেন বারাক ওবামা৷ লাওসের মাটিতে নেমে স্বীকার করে নিলেন, ‘এখানকার মানুষ বলছেন, সে সময় আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা পড়েছিল৷’

সে দিনের সেই হামলার জন্য সরাসরি দুঃখপ্রকাশ না করলেও, অনুশোচনার সুরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উক্তি, ‘ইতিহাস বলছে, লাওস-কে সুস্থ করে তোলার নৈতিক দায়িত্ব আমেরিকাকে নিতেই হবে৷’ তবে, ওই ৯ বছরের বোমা বর্ষণ লাওসের যা না ক্ষতি করেছিল, তার থেকেও কয়েক গুণ বেশি ক্ষতি করেছে সেই বিস্ফোরক, যা ওই বোমার ভিতরে লুকিয়ে লাওসের মাটিতে আছড়ে পড়েছিল! ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়, লাওসের উপর প্রায় ২৬ কোটি বোমা ফেলেছিল মার্কিন বোমারু বিমানগুলি! মাঠ-ঘাট-বাড়ি-স্কুল, কিছুকেই বাদ দেওয়া হয়নি৷ বোমার ঘায়ে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সব কিছু৷

তবে, এই ক্ষয়ক্ষতি চালিয়ে ছিল ৭০ শতাংশ বোমা৷ কারণ, বিমান থেকে পড়া বাকি ৩০ শতাংশ বোমা ফাটেনি৷ আর এগুলোই পরবর্তীকালে লাওসবাসীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়! কারণ, যুদ্ধ থামার পর আকাশ থেকে বোমা পড়া বন্ধ হয়ে গেলেও , ঘরের মাটিতে লুকিয়ে থাকা বিস্ফোরক মারণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায় ! কখনও চাষ করতে গিয়ে , কখনও বাড়ির ভিত খুঁড়তে গিয়ে , কখনও আবার নেহাতই খেলতে গিয়ে এই লুকোনো বোমাগুলির সংস্পর্শে চলে আসেন মানুষ৷ পরিণতি মৃত্যু৷ এই বোমার কারণেই লাওসের ১৮টি প্রদেশকে ‘বিপজ্জনক ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে৷ আর না ফাটা এই বোমার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আনএক্সপ্লোডেড অর্ডন্যান্স ’ বা ইউএক্সও৷ আজও প্রতিনিয়ত যার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন লাওসবাসী৷

লাওসকে ইউএক্সও -মুক্ত করতে, দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে সাফাইয়ের কাজ৷ গত ২০ বছর ধরে, যে কাজে অর্থ এবং লোকবলের জোগান দিয়ে সাহায্য করছে ওয়াশিংটনও৷ তবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি বারবারই অভিযোগ করে আসছে , ‘যে টাকা মার্কিন প্রশাসন দেয়, তা নেহাতই যত্সামান্য৷ গত ২০ বছরে এই কাজে মাত্র ১০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে তারা! এতে তো লাওসের মাটি থেকে সব লুকোনো বোমা খুঁজে বের করতে একশো বছর লেগে যাবে !’ এতদিন এই অভিযোগ নিয়ে কোনও কথা না বললেও, লাওস সফরে গিয়ে, কাজে তার জবাব দিলেন বারাক ওবামা৷ বললেন, ‘বোমা খুঁজতে আগামী তিন বছরে ৯ কোটি মার্কিন ডলার দেবে আমেরিকা৷’ এমনকি, না ফাটা বোমা খুঁজে বের করতে প্রযুক্তিগত সাহায্যও দিচ্ছে ওয়াশিংটন৷

আর্কাইভ ঘেঁটে বলে দেওয়া হচ্ছে, কোন কোন জায়গায় সবথেকে বেশি বোমা ফেলেছিল মার্কিন বিমান৷ ওবামার ঘোষণায় খুশি লাওসের প্রেসিডেন্টও৷ তাঁর বক্তব্য , ‘এতে দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বাড়বে৷’ পাল্টা তাঁরও ঘোষণা, ‘যুদ্ধের সময় যে সমস্ত মার্কিন জওয়ান লাওসে নিখে াঁজ হয়ে গিয়েছিলেন, কিংবা এখানের জেলে বন্দি তাঁদের আমেরিকা ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে৷’

এর আগে জাপানের হিরোশিমায় গিয়েও, বিষন্নতার সুর শোনা গিয়েছিল বারাক ওবামার গলায়৷ সেবারও সরাসরি দুঃখপ্রকাশ না করলেও , তিনি বলেছিলেন, ‘হিরোশিমার কথা ভুলে গেলে চলবে না৷’ যাকে ঘুরিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দুঃখপ্রকাশ বলেই ধরে নিয়েছিলেন অনেকে৷ তারপর এবার লাওসের পালা৷ তবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে , প্রতিদ্বন্দ্বী চিনকে ঠেকাতে সম্প্রতি এশিয়ায় যে কৌশল নিয়েছে আমেরিকা, এটা তারই অংশ ! প্রসঙ্গত, লাওসের অর্থনীতির বড় ভিত্তি হল চিনা লগ্নি৷ সেই সম্পর্কের গোড়াতে আঘাত করতেই ওবামার এই দরাজ-ঘোষণা বলে মনে করছেন অনেকে৷


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন