মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মোদীর পরীক্ষা

সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে কাশ্মীরে নিহত সেনা  বিশ্বজিৎ ঘোড়ইয়ের কফিনবন্দি মরদেহ 







সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা


উ রির সামরিক ঘাঁটিতে হানাদার সন্ত্রাসীদের নরেন্দ্র মোদী ‘কাপুরুষ’ বলিয়া তিরস্কার করিয়াছেন। শুনিয়া তাহাদের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষকরা লজ্জায় অধোমুখ হইয়াছে, এমন কোনও সংবাদ সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর গোয়েন্দাদের কানে আসে নাই। এই সন্ত্রাস-হানার পিছনে যাহারা আছে তাহারা পার পাইবে না— প্রধানমন্ত্রীর এই হুঙ্কার সীমান্ত পার হইয়া শত্রুশিবিরে ত্রাসের সঞ্চার ঘটাইয়াছে বলিয়াও এ অবধি শোনা যায় নাই। সন্ত্রাসবাদীরা সফল আক্রমণ করিলে রাষ্ট্রনায়কদের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাইতে হয়, সমুচিত জবাব দিবার অঙ্গীকার করিতে হয়, মোদী সেই ব্যাকরণ মানিয়াছেন। তাঁহার আসনে মনমোহন সিংহ থাকিলেও তাহাই করিতেন। বক্তার ছাতির মাপ যাহাই হউক, কথার নিজস্ব কোনও দাম নাই। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সরকার এই আক্রমণের পরে কী করিবেন, কী করিতে পারেন, তাহাই একমাত্র বিবেচনার বিষয়। তাঁহার সতীর্থ রাম মাধব একটি দাঁতের বদলে গোটা চোয়াল লইবার পরামর্শ দিয়াছেন। রূপক হিসাবে অভিনব বটে, শ্রীমাধব স্লোগান-ভক্ত প্রধানমন্ত্রীর বাহবা পাইবেন। কিন্তু তাঁহার পরামর্শ মাফিক চোয়াল লইতে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হইবে কি?

প্রশ্ন সেখানেই। উরির ঘটনায় পাকিস্তানের স্বরূপ নূতন করিয়া উন্মোচিত। ইসলামাবাদ এই ঘটনার দায়িত্ব বেমালুম অস্বীকার করিয়াছে, তাহাও পরিচিত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ভারত এই বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করিয়া আন্তর্জাতিক দরবারে পেশ করিবে, সন্ত্রাসে মদত দিবার অভিযোগ তুলিয়া পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করিবে, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তাহাতে যে কাজের কাজ হইবে, এমন আশা করিবার সংগত কারণ নাই। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা সরকার ভারতে সন্ত্রাস রফতানিতে যত সক্রিয়ই হউক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তাহার বিরুদ্ধে যথার্থ কঠোর পদক্ষেপ করার সম্ভাবনা প্রবল নহে, কারণ ইসলামাবাদ বাঁকিয়া বসিলে আফগানিস্তানে সংকট বাড়িবে। অর্থাৎ, পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা ভারতের পক্ষে জরুরি, কিন্তু আদৌ যথেষ্ট নহে।

এবং এই কারণেই, রাম মাধবের নীতি নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ পছন্দ হইতে পারে। সন্ত্রাসের সূতিকাগারে প্রতি-আক্রমণের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করিয়া সেনা পাঠাইবার প্রস্তাব দিল্লির দরবারে বার বার শোনা গিয়াছে, কারগিল পর্বে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী এই নীতির প্রবক্তা হইয়া বিস্তর শোরগোল তুলিয়াছিলেন। সমস্যা একটিই। এক বার এই পথে পা বাড়াইলে ফিরিবার রাস্তা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল, ‘নির্দিষ্ট ও সীমিত’ আক্রমণ সহজেই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ ধারণ করিতে পারে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কার দুইটি বাড়তি মাত্রা আছে। এক, তাহার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। দুই, সে দেশের প্রশাসনে সেনাবাহিনীর প্রতিপত্তি বিপুল। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে কেহ কেহ যে ‘পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষ রাহিল শরিফের বিদেশমন্ত্রী’ বলিয়া অভিহিত করিতেছেন, তাহা পুরোপুরি রঙ্গ নহে। যুদ্ধ বাধিলে রাওয়ালপিন্ডির উর্দিধারী কর্তাদের পৌষ মাস। ভারতের পক্ষে সেই সম্ভাবনা দুঃস্বপ্নের নামান্তর। সুতরাং দাঁতের বদলে চোয়াল লইতে দৌড়াইবার আগে নরেন্দ্র মোদীকে ঈষৎ ভাবিতে হইবে। উদ্বেগের কথা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও তাঁহাকে জঙ্গি পদক্ষেপের প্ররোচনা দিতে পারে। ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের নায়করা ভাবিতেই পারেন যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লির নায়কদের কণ্ঠ যত উচ্চগ্রামে উঠিবে, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফসল কুড়াইবার সম্ভাবনাও তত উজ্জ্বল হইবে। এখানেই নরেন্দ্র মোদীর বিবেচনাবোধের কঠিন পরীক্ষা। তিনি বিজেপির নেতা, না ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তাহার পরীক্ষা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন