ভারতের সমস্যা আমাদের মতই, পার্থক্য তাদের আইনের শাসন আমাদের চেয়ে উন্নত
২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় একই অভ্যাসে টেলিভিশনের চলমান স্ক্রলে চোখ রাখলাম। দুঃসংবাদ নিয়ে আসা খবরের মিছিল তৈরি হল যেন। যেমন- বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে লঞ্চডুবি। শিশুসহ ১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার। নিখোঁজ ২০ জন। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত তিনজন- তদন্ত কমিটি গঠন। ফরিদপুরে পুত্রের দেয়া আগুনে দগ্ধ পিতা রফিকুল হুদার মৃত্যু। জয়পুরহাটে ছোট ভাইয়ের লাঠির আঘাতে বড় ভাইয়ের মৃত্যু। এবার ঈদযাত্রায় সড়ক ও রেলপথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৯৩। মৃত্যু ২৬৫। রাজধানীর শ্যামপুরে ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ৭ বছরের শিশুকে পিটিয়ে হত্যা। রাজশাহীতে যাত্রীবাহী বাস রাস্তা ছেড়ে ঢুকে গেছে পথের পাশে মানুষের বাড়িতে। ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু, অনেকে আহত। মহাখালীতে ট্রেনে কাটা পড়ে একজনের মৃত্যু। ফেনীতে কাঞ্চন নদীর তীরে যুবকের মৃতদেহ। টঙ্গীর ফয়েল কারখানা বিস্ফোরণে আহত আরও একজনের মৃত্যু। সুন্দরবনে বনদস্যুরা ১০ জন জেলেকে অপহরণ করেছে ইত্যাদি। পরদিন সকালে দৈনিক যুগান্তর থেকে মিছিল আরেকটু বড় করা গেল। সেখানে অতিরিক্ত হিসেবে আছে বিচার ছাড়াই ৪৪ মামলা থেকে মুক্ত রানা। শেরপুরে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত এক। বাস উল্টে খাদে হেলপারসহ নিহত ২। ফতুল্লায় ঘরে ঢুকে সাংবাদিকের স্ত্রীকে কুপিয়ে জখম। এসব একদিনের পরিসংখ্যান। প্রতিদিন কম-বেশি প্রায় একই ধারার দুঃসংবাদ বয়ে আনছে সংবাদমাধ্যম।
আমি জানি না এমন চিত্র পৃথিবীতে আর কোনো দেশ আছে কিনা! গত ঈদের আগে আমি ৯ দিন কলকাতায় ছিলাম। প্রতিদিনই ওদেশের সংবাদপত্র পড়েছি। টেলিভিশন দেখেছি। ওখানেও খুনোখুনি, দুর্ঘটনা যে হচ্ছে না তেমন নয়। তবে সংবাদমাধ্যমের খবর মেলালে আমাদের এক সিকিভাগও নয়। ভারত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হয়ে যায়নি। জনসংখ্যারও আধিক্য আছে। মন্দ রাজনীতিও আছে। তবে পার্থক্য একটি রয়েছে। তা হচ্ছে, আইনের শাসন আমাদের চেয়ে উন্নত।
কোনো দলের সরকারে থাকার একটি অসুবিধা আছে। সবকিছুর দায় সরকারকেই নিতে হয়। এ কারণে সরকারকেও সতর্ক থাকতে হয়। ঈদের আগে থেকে এই যে দুর্ঘটনা ঘটছে, খুনোখুনি হচ্ছে, বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল, সরকার কি তাতে বিব্রত না মর্মাহত? না হলে এসব প্রতিবিধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরের পরিচালকদের ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখছি না কেন? এর বদলে একই সন্ধ্যার টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম সরকারপক্ষ প্রায় অপ্রয়োজনে উৎসব করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল জানালেন, প্রধানমন্ত্রী কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরলে বিশাল সংবর্ধনা দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রেও আমি জানি না এমন বাড়াবাড়ি পৃথিবীর আর ক’টা দেশে করে।
বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরাই তো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে যান। এগুলো একটি রুটিন দায়িত্ব। যদি এ সফরের মধ্য দিয়ে বিশাল কোনো অর্জন যুক্ত হতো- যদি আন্তর্জাতিক বড় কোনো পুরস্কারে ভূষিত হতেন প্রধানমন্ত্রী- যা দৈবাৎই কেউ অর্জন করতে পারেন, তাহলে সংবর্ধনা দেয়ার যুক্তি থাকতে পারত। আমার দুর্বাভনা, এতে প্রধানমন্ত্রীকে কিছুটা খেলো করে দেয়া হবে না তো!
দেশের এমন আচমকা সংকটের মুখে অমন সংবর্ধনা আয়োজনের কারণ কী হতে পারে? ১. মানুষের দৃষ্টির সামনে থেকে সংকট ঢাকার চেষ্টা, ২. মানুষের মৃত্যু ও সম্পদহানি নেতা-নেত্রীদের অন্তর ছুঁয়ে না যাওয়া, ৩. মানুষের প্রতি দায়বোধ না থাকা। স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে, সম্ভবত অল্প সময়েই বোধোদয় হয়েছে। তাই ২২ সেপ্টেম্বর কয়েকটি পত্রিকা খুঁজেও রিপোর্টটি পেলাম না। হয়তো বাস্তবতা বুঝে পিছিয়ে গেছেন।
টেলিভিশনে দেখলাম প্রতিপক্ষের আঘাতে খুন, পুত্রের হাতে বাবা-মা খুন, ভাইয়ের আঘাতে অপর ভাইয়ের মৃত্যু। এসব পর্যবেক্ষণ করে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা ছড়িয়ে পড়া, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না থাকা, সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সুশাসন না থাকা, রাজনীতি কলুষিত হওয়া ইত্যাদি। বাস্তব পর্যবেক্ষণ এসব অভিমতকে সমর্থন দেবে।
এমপি রানাকে ৪৪ মামলার বিচার ছাড়াই মুক্ত করে দেয়ার বিষয়টি দু’দিন ধরেই মানুষের মুখে মুখে ছিল। এমন ছবি এদেশে খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। আসলে ‘আইন সবার জন্য সমান’ এই আপ্তবাক্যটি এ দেশের ‘রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের’ রাজনীতিতে কার্যকর নয়। এতে বিস্মিত বা আহত হওয়ার কারণ নেই। বিশ্বসভ্যতায় আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার সূচনায় এমনটিই ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সুমেরের শেষ রাজা ডুঙির আইন এবং এর পর প্রাচীন ব্যবিলনে এই আইনের সংস্কারকৃত ও পরিবর্ধিত আইন প্রথম লিখিত রূপ দিয়েছিলেন রাজা হাম্মুরাবি। সেখানে স্পষ্টতই ছিল আইনের বিধান শ্রেণীভেদে ভিন্ন হবে। একই অপরাধে রাজা, মন্ত্রী বা অভিজাতদের তুলনায় অনেক বেশি শাস্তি পাবে সাধারণ মানুষ। এসব উদাহরণ থেকে আমরা স্বস্তি খুঁজতে পারি।
সচেতন মানুষ এসব বাস্তবতায় খুব স্বস্তিতে নেই। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর জঙ্গি দমনে সরকারের অনেকটা সাফল্য দেখে যতটা আনন্দ পেতে চাচ্ছে মানুষ, এসব নিত্যদিনের অঘটন মানুষকে ততটাই নিরানন্দ এনে দিচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভোগবাদী চিন্তা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব পরিবারের সদস্য অনেককে সহিংস করে তুলছে। হয়তো তাদের ব্যাখ্যাটাই সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ এমন ধস নামল কেন? চারদিকে যখন কেউ দেখছে, প্রশাসনিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি, ব্যবসায়িক দুর্নীতিতে কাছের মানুষগুলো আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, অথচ এরা কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে মাথা উঁচু করে সমাজ দাবড়ে বেড়াচ্ছে তখন একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে তা সংক্রমিত হতেই পারে। পাশাপাশি যখন দেখা যায়, আইনের শাসন ক্ষমতা আর প্রভাবের দাপটে পরাস্ত তখন এরা অভীষ্টে পৌঁছার জন্য দুর্দমনীয় হতেই পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাইরাস থেকে মুক্ত করতে কাদের এগিয়ে আসা উচিত? এসব পক্ষ কি এগিয়ে আসছে? অনেকে বলছেন, উদভ্রান্ত প্রজন্মকে সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত করা এবং ব্যস্ত রাখা উচিত। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? এর জন্য তো প্রণোদনা দরকার, ভেঙে যাওয়া পরিবেশ ফিরিয়ে আনা দরকার। রাজনৈতিক লাভালাভ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের শাখা-প্রশাখা থাকলেও হারিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসব সংগঠন কোনো পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে বটে, তবে এসব পরোক্ষভাবে হলেও রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিতে সংক্রমিত। তাই নগরকেন্দ্রিক মানববন্ধন জাতীয় কর্মপ্রয়াস ছাড়া দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ছড়িয়ে দেয়ার কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে প্রতাপশালী সরকারি ছাত্র সংগঠন। কিন্তু এরা সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে। স্বপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলে। কিন্তু এদের সামান্য পৃষ্ঠপোষকতাও দেয়া হয় না। রাষ্ট্র তো খোঁজ রাখেই না। আগে তবু বড় কোনো আয়োজন করতে গেলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সহজে স্পন্সর পাওয়া যেত। এগুলো এখন খুব সংকুচিত হয়ে গেছে। এসব বাস্তবতার মোকাবেলা করে প্রতিবিধানের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বের কথা বলে বক্তৃতা করা ছাড়া এর উন্নয়নে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার যথাযথ পদক্ষেপের কথা আমরা শুনি না।
আজকাল লক্ষ করছি, সুশাসনের কথা বললে সরকারি বিধায়করা তির্যক মন্তব্য করেন। কিন্তু দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বুঝতে চান না সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রকাশ্য ও গোপন কোনো লক্ষ্যই শেষ পর্যন্ত অর্জন করা যায় না। ব্রিটিশ শাসকরা দুনিয়াজুড়ে যখন উপনিবেশ বানাচ্ছিল, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উপনিবেশগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ মানুষ সুখে থাকবে, আনন্দে থাকবে। আর এই আবেশ ছড়িয়ে দিয়ে পরিবেশ তৈরি করবে সম্পদ পাচারের। কেউ টের পাবে না। তাই ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর টনক নড়েছিল রানী ভিক্টোরিয়ার প্রশাসনের। বুঝেছিল এমন জনঅসন্তোষ তো হওয়ার কথা ছিল না। আসলে রাজক্ষমতা রাজার হাতে নেই। আছে বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। বণিকস্বার্থ আদায় করতে গিয়ে সুশাসন ব্যাহত করেছে। ক্ষেপিয়ে দিয়েছে ভারতবাসীকে। তাই চটজলদি কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসন চালু করতে হয়েছিল। এসব থেকে কি কোনো শিক্ষা নেয়ার সুযোগ নেই আমাদের সরকার পরিচালনাকারীদের!
সাধারণ মানুষ দুঃসময়ে পা রাখলে সেই উত্তাপে সরকার ও রাজনীতির পাও বাঁচে না। এই সত্য আড়াল করে স্বপ্নবিলাস বাঁচিয়ে রাখা যায় না।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ কে এম শাহনাওয়াজ
আমার এক নিকটাত্মীয় দিনকয়েক আগে বলছিলেন তিনি আর সংবাদপত্র পড়বেন না, টেলিভিশনের খবর শুনবেন না। টিভি চ্যানেলের স্ক্রলে চোখ রাখবেন না। এসব জায়গায় এখন বেশিরভাগ খবরই দুঃসংবাদ-হৃদয়বিদারক। সবক’টি একসঙ্গে একটি অন্ধকার সময়ের কথা বলছে। বললেন, ‘ক্রমাগত এসব খবর দেখে-শুনে হৃদযন্ত্রে চাপ অনুভব করছি। সংবাদভীতি আমাকে পেয়ে বসেছে।’ আমি তার কষ্ট বুঝি, আর এটিও বুঝি যে মানুষ উটপাখি নয়। বালুতে মুখ গুঁজে ঝড়ের বিপদ এড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে পারে না। তাই আমি আমার হৃদযন্ত্রকে যত্নে শক্ত রেখে অভ্যাসবশত প্রতিদিনের সংবাদে চোখ রাখি। টিভি স্ক্রলের চলমান লেখা থেকে গুনে বের করার চেষ্টা করি দুর্ঘটনা, খুনোখুনি জাতীয় খবরের বাইরে ভালো এবং আশাবাদী খবর কটা পাই। এ ধরনের খবর দৈবাৎ শতকরা হিসেবে ১০টি পেলেই আনন্দিত হওয়ার ভান করি।২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় একই অভ্যাসে টেলিভিশনের চলমান স্ক্রলে চোখ রাখলাম। দুঃসংবাদ নিয়ে আসা খবরের মিছিল তৈরি হল যেন। যেমন- বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে লঞ্চডুবি। শিশুসহ ১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার। নিখোঁজ ২০ জন। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত তিনজন- তদন্ত কমিটি গঠন। ফরিদপুরে পুত্রের দেয়া আগুনে দগ্ধ পিতা রফিকুল হুদার মৃত্যু। জয়পুরহাটে ছোট ভাইয়ের লাঠির আঘাতে বড় ভাইয়ের মৃত্যু। এবার ঈদযাত্রায় সড়ক ও রেলপথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৯৩। মৃত্যু ২৬৫। রাজধানীর শ্যামপুরে ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ৭ বছরের শিশুকে পিটিয়ে হত্যা। রাজশাহীতে যাত্রীবাহী বাস রাস্তা ছেড়ে ঢুকে গেছে পথের পাশে মানুষের বাড়িতে। ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু, অনেকে আহত। মহাখালীতে ট্রেনে কাটা পড়ে একজনের মৃত্যু। ফেনীতে কাঞ্চন নদীর তীরে যুবকের মৃতদেহ। টঙ্গীর ফয়েল কারখানা বিস্ফোরণে আহত আরও একজনের মৃত্যু। সুন্দরবনে বনদস্যুরা ১০ জন জেলেকে অপহরণ করেছে ইত্যাদি। পরদিন সকালে দৈনিক যুগান্তর থেকে মিছিল আরেকটু বড় করা গেল। সেখানে অতিরিক্ত হিসেবে আছে বিচার ছাড়াই ৪৪ মামলা থেকে মুক্ত রানা। শেরপুরে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত এক। বাস উল্টে খাদে হেলপারসহ নিহত ২। ফতুল্লায় ঘরে ঢুকে সাংবাদিকের স্ত্রীকে কুপিয়ে জখম। এসব একদিনের পরিসংখ্যান। প্রতিদিন কম-বেশি প্রায় একই ধারার দুঃসংবাদ বয়ে আনছে সংবাদমাধ্যম।
আমি জানি না এমন চিত্র পৃথিবীতে আর কোনো দেশ আছে কিনা! গত ঈদের আগে আমি ৯ দিন কলকাতায় ছিলাম। প্রতিদিনই ওদেশের সংবাদপত্র পড়েছি। টেলিভিশন দেখেছি। ওখানেও খুনোখুনি, দুর্ঘটনা যে হচ্ছে না তেমন নয়। তবে সংবাদমাধ্যমের খবর মেলালে আমাদের এক সিকিভাগও নয়। ভারত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হয়ে যায়নি। জনসংখ্যারও আধিক্য আছে। মন্দ রাজনীতিও আছে। তবে পার্থক্য একটি রয়েছে। তা হচ্ছে, আইনের শাসন আমাদের চেয়ে উন্নত।
কোনো দলের সরকারে থাকার একটি অসুবিধা আছে। সবকিছুর দায় সরকারকেই নিতে হয়। এ কারণে সরকারকেও সতর্ক থাকতে হয়। ঈদের আগে থেকে এই যে দুর্ঘটনা ঘটছে, খুনোখুনি হচ্ছে, বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল, সরকার কি তাতে বিব্রত না মর্মাহত? না হলে এসব প্রতিবিধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরের পরিচালকদের ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখছি না কেন? এর বদলে একই সন্ধ্যার টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম সরকারপক্ষ প্রায় অপ্রয়োজনে উৎসব করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল জানালেন, প্রধানমন্ত্রী কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরলে বিশাল সংবর্ধনা দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রেও আমি জানি না এমন বাড়াবাড়ি পৃথিবীর আর ক’টা দেশে করে।
বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরাই তো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে যান। এগুলো একটি রুটিন দায়িত্ব। যদি এ সফরের মধ্য দিয়ে বিশাল কোনো অর্জন যুক্ত হতো- যদি আন্তর্জাতিক বড় কোনো পুরস্কারে ভূষিত হতেন প্রধানমন্ত্রী- যা দৈবাৎই কেউ অর্জন করতে পারেন, তাহলে সংবর্ধনা দেয়ার যুক্তি থাকতে পারত। আমার দুর্বাভনা, এতে প্রধানমন্ত্রীকে কিছুটা খেলো করে দেয়া হবে না তো!
দেশের এমন আচমকা সংকটের মুখে অমন সংবর্ধনা আয়োজনের কারণ কী হতে পারে? ১. মানুষের দৃষ্টির সামনে থেকে সংকট ঢাকার চেষ্টা, ২. মানুষের মৃত্যু ও সম্পদহানি নেতা-নেত্রীদের অন্তর ছুঁয়ে না যাওয়া, ৩. মানুষের প্রতি দায়বোধ না থাকা। স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে, সম্ভবত অল্প সময়েই বোধোদয় হয়েছে। তাই ২২ সেপ্টেম্বর কয়েকটি পত্রিকা খুঁজেও রিপোর্টটি পেলাম না। হয়তো বাস্তবতা বুঝে পিছিয়ে গেছেন।
টেলিভিশনে দেখলাম প্রতিপক্ষের আঘাতে খুন, পুত্রের হাতে বাবা-মা খুন, ভাইয়ের আঘাতে অপর ভাইয়ের মৃত্যু। এসব পর্যবেক্ষণ করে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে সমাজে ভোগবাদী মানসিকতা ছড়িয়ে পড়া, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না থাকা, সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সুশাসন না থাকা, রাজনীতি কলুষিত হওয়া ইত্যাদি। বাস্তব পর্যবেক্ষণ এসব অভিমতকে সমর্থন দেবে।
এমপি রানাকে ৪৪ মামলার বিচার ছাড়াই মুক্ত করে দেয়ার বিষয়টি দু’দিন ধরেই মানুষের মুখে মুখে ছিল। এমন ছবি এদেশে খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। আসলে ‘আইন সবার জন্য সমান’ এই আপ্তবাক্যটি এ দেশের ‘রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের’ রাজনীতিতে কার্যকর নয়। এতে বিস্মিত বা আহত হওয়ার কারণ নেই। বিশ্বসভ্যতায় আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার সূচনায় এমনটিই ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সুমেরের শেষ রাজা ডুঙির আইন এবং এর পর প্রাচীন ব্যবিলনে এই আইনের সংস্কারকৃত ও পরিবর্ধিত আইন প্রথম লিখিত রূপ দিয়েছিলেন রাজা হাম্মুরাবি। সেখানে স্পষ্টতই ছিল আইনের বিধান শ্রেণীভেদে ভিন্ন হবে। একই অপরাধে রাজা, মন্ত্রী বা অভিজাতদের তুলনায় অনেক বেশি শাস্তি পাবে সাধারণ মানুষ। এসব উদাহরণ থেকে আমরা স্বস্তি খুঁজতে পারি।
সচেতন মানুষ এসব বাস্তবতায় খুব স্বস্তিতে নেই। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর জঙ্গি দমনে সরকারের অনেকটা সাফল্য দেখে যতটা আনন্দ পেতে চাচ্ছে মানুষ, এসব নিত্যদিনের অঘটন মানুষকে ততটাই নিরানন্দ এনে দিচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভোগবাদী চিন্তা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব পরিবারের সদস্য অনেককে সহিংস করে তুলছে। হয়তো তাদের ব্যাখ্যাটাই সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ এমন ধস নামল কেন? চারদিকে যখন কেউ দেখছে, প্রশাসনিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি, ব্যবসায়িক দুর্নীতিতে কাছের মানুষগুলো আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, অথচ এরা কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে মাথা উঁচু করে সমাজ দাবড়ে বেড়াচ্ছে তখন একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে তা সংক্রমিত হতেই পারে। পাশাপাশি যখন দেখা যায়, আইনের শাসন ক্ষমতা আর প্রভাবের দাপটে পরাস্ত তখন এরা অভীষ্টে পৌঁছার জন্য দুর্দমনীয় হতেই পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাইরাস থেকে মুক্ত করতে কাদের এগিয়ে আসা উচিত? এসব পক্ষ কি এগিয়ে আসছে? অনেকে বলছেন, উদভ্রান্ত প্রজন্মকে সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত করা এবং ব্যস্ত রাখা উচিত। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? এর জন্য তো প্রণোদনা দরকার, ভেঙে যাওয়া পরিবেশ ফিরিয়ে আনা দরকার। রাজনৈতিক লাভালাভ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের শাখা-প্রশাখা থাকলেও হারিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসব সংগঠন কোনো পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে বটে, তবে এসব পরোক্ষভাবে হলেও রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিতে সংক্রমিত। তাই নগরকেন্দ্রিক মানববন্ধন জাতীয় কর্মপ্রয়াস ছাড়া দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ছড়িয়ে দেয়ার কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে প্রতাপশালী সরকারি ছাত্র সংগঠন। কিন্তু এরা সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে। স্বপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলে। কিন্তু এদের সামান্য পৃষ্ঠপোষকতাও দেয়া হয় না। রাষ্ট্র তো খোঁজ রাখেই না। আগে তবু বড় কোনো আয়োজন করতে গেলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সহজে স্পন্সর পাওয়া যেত। এগুলো এখন খুব সংকুচিত হয়ে গেছে। এসব বাস্তবতার মোকাবেলা করে প্রতিবিধানের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বের কথা বলে বক্তৃতা করা ছাড়া এর উন্নয়নে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার যথাযথ পদক্ষেপের কথা আমরা শুনি না।
আজকাল লক্ষ করছি, সুশাসনের কথা বললে সরকারি বিধায়করা তির্যক মন্তব্য করেন। কিন্তু দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বুঝতে চান না সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রকাশ্য ও গোপন কোনো লক্ষ্যই শেষ পর্যন্ত অর্জন করা যায় না। ব্রিটিশ শাসকরা দুনিয়াজুড়ে যখন উপনিবেশ বানাচ্ছিল, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উপনিবেশগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ মানুষ সুখে থাকবে, আনন্দে থাকবে। আর এই আবেশ ছড়িয়ে দিয়ে পরিবেশ তৈরি করবে সম্পদ পাচারের। কেউ টের পাবে না। তাই ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর টনক নড়েছিল রানী ভিক্টোরিয়ার প্রশাসনের। বুঝেছিল এমন জনঅসন্তোষ তো হওয়ার কথা ছিল না। আসলে রাজক্ষমতা রাজার হাতে নেই। আছে বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। বণিকস্বার্থ আদায় করতে গিয়ে সুশাসন ব্যাহত করেছে। ক্ষেপিয়ে দিয়েছে ভারতবাসীকে। তাই চটজলদি কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসন চালু করতে হয়েছিল। এসব থেকে কি কোনো শিক্ষা নেয়ার সুযোগ নেই আমাদের সরকার পরিচালনাকারীদের!
সাধারণ মানুষ দুঃসময়ে পা রাখলে সেই উত্তাপে সরকার ও রাজনীতির পাও বাঁচে না। এই সত্য আড়াল করে স্বপ্নবিলাস বাঁচিয়ে রাখা যায় না।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন