মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে সুইডিশমন্ত্রীর পদত্যাগ আইনের শাসন ও গণতন্ত্র এরই নাম
আইদা হাদজিয়ালিক |
গত ১৩ আগস্ট শনিবার ছুটির দিন হলেও কিছু সাংবাদিক সকাল সকাল হাজির হয়েছেন সুইডিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রোসেনবদে। আগে থেকেই খবর ছিল যে সুইডিশ উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, বয়স্ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করবেন। সেই অনুসারে সবাইকে জানানোও হয়েছিল। প্রেস সেক্রেটারি রাসমুস লেনেফোর্স প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোপারগেটে সবাইকে স্বাগত জানান। সংবাদ সম্মেলন সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা তাই সাড়ে ৯টা থেকেই সবাই জড় হতে থাকেন। এসেছেনও পরিচিত সকল সাংবাদিক।
আইদা হাদজিয়ালিক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন |
তিনি যে অপরাধ করেছেন আইনের চোখে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও একজন মন্ত্রী হিসেবে তাঁর নৈতিক দায়দায়িত্ব নিতেই হবে। আর সে কারণেই পদত্যাগ করছেন।
সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলনের জন্য যিনি মাইক্রোফোনের সামনে এলেন তার নাম আইদা হাদজিয়ালিক। সাদা কালো পোশাকের মন্ত্রী আইদাকে দেখেই বোঝা যায় চিন্তায় তিনি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেননি। সুইডেনের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে কম বয়স্ক মন্ত্রী, যিনি পেশায় একজন অ্যাডভোকেট। ২৯ বছর বয়স্কা একজন মুসলিম নারী মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা থেকে শরণার্থী হয়ে সুইডেনে এসেছিলেন।
বক্তব্যের শুরুতে সবাইকে শুভ সকাল জানালেন এবং সবাইকে সংবাদ সম্মেলনে আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি যা বললেন তার অর্থ এ রকম:
‘গত পরশুদিন আমি বন্ধুদের সঙ্গে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ছিলাম। সেখান থেকে নিজ শহর মালমোতে আসার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেদিন বিকেলে একটা কনসার্টের আগে দুই গ্লাস ওয়াইন পান করেছিলাম। এক গ্লাস লাল ও এক গ্লাস সাদা স্পার্কলিং মৌসেরান্দে ওয়াইন। প্রায় চার ঘণ্টা পর আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করেছি। আমি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরব বলে ঠিক করছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে আমি অ্যালকোহল ইনফ্লুয়েন্সের বাইরে রয়েছি। কিন্তু সেতু পার হওয়া মাত্রই আমাকে পুলিশের একটি স্বাভাবিক রুটিন চেকের সম্মুখীন হতে হয়। যেখানে পরীক্ষায় আমার ০.২ প্রোমিল অ্যালকোহল ধরা পড়ে। পুলিশ আমার নামে একটি মামলা করেছে। আমি আশা করছি এর জন্য আমাকে জরিমানা দিতে হবে এবং আমি এই শাস্তি মেনে নিতে রাজি আছি। একই সঙ্গে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি যত দ্রুত সম্ভব এটা আপনাদের জানাই এবং আমার ভুলের মাশুল হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রী, আমার পার্টির সেক্রেটারি, আমার সহকর্মী আর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলি। গতকাল সকাল ৮টায় আমি প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লুফভেনকে টেলিফোন করি এবং বিকেলে আমাদের দেখা হয়। আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছি এবং যা ঘটেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করেছি। আমি বুঝতে পারছি অনেকেই আমার ওপর ক্ষুব্ধ এমনকি আমি নিজেও গভীরভাবে মর্মাহত ও অনুতপ্ত।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি মদ্যপান ও গাড়ি চালনা একসঙ্গে করা ঠিক নয় এবং আমি এটা আগে কখনোই করিনি। এই বিষয়ে আইন করে দেওয়া হয়েছে ও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে মদ্যপান করে গাড়ি চালানো কতখানি বিপজ্জনক। আইনগতভাবে আমার এই অপরাধ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন; তারপরও আমার মনে হয় আমি যা করেছি তা খুবই মারাত্মক ও ক্ষতিকর। আমি বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব নিতে শিখেছি এবং এ ক্ষেত্রেও নিতে চাই। সেই জন্যই আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি যে আমার এই অপরাধের দায় নিয়ে আমি মন্ত্রিত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চাই। আসছে সোমবার আমি আমার পদত্যাগপত্র জমা দেব এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তিনি তা গ্রহণ করবেন।
আমি স্টেফান লুফভেন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পেরে এবং এর অর্জনের জন্য গর্বিত। এ জন্যে আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই, ধন্যবাদ জানাই আমার সহকর্মীদের ও সুইডিশ জনগণকে, যারা আমার ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলেন।’
ঠিক এখানেই শেষ হয় সুইডিশ সরকারের সবচেয়ে কম বয়স্ক একজন মন্ত্রী আইদা হাদজিয়ালিকের বক্তব্য। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পদত্যাগ করে তাঁর বক্তব্যে তিনি বুঝিয়ে দেন তিনি যে অপরাধ করেছেন যা আইনের চোখে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ হলেও একজন মন্ত্রী হিসেবে তাঁর নৈতিক দায়দায়িত্ব তাঁকে নিতেই হবে। আর সে কারণেই তিনি পদত্যাগ করছেন।
মোট ছয় মিনিট ৫০ সেকেন্ডের এই সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী আইদার এই বক্তব্য ছিল মাত্র দুই মিনিট ৫০ সেকেন্ডের। এরপর এই সংবাদ সম্মেলনের স্থায়িত্ব ছিল আরও চার মিনিট যেখানে সাংবাদিকেরা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করেন। সেখান থেকে যে সারাংশ পাওয়া যায় তা হলো, একজন মন্ত্রী মদ্যপান করে গাড়ি চালিয়েছেন, পুলিশের স্বাভাবিক রুটিন চেকে ধরা পড়ার পর পুলিশ তাঁর নামে মামলা করেছে। ফলাফল স্বরূপ নৈতিক দায়দায়িত্ব নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছেন।
এর নাম আইনের শাসন, এর নাম গণতন্ত্র।
আলী হোসেন, স্টকহোম (সুইডেন) থেকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন