মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্প উল্টে দেবেন হিলারির হিসাব!



হাসান ফেরদৌস      


সারা পৃথিবীর মানুষ কিঞ্চিৎ বিস্ময় আর কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস নিয়ে আমেরিকার চলতি নির্বাচনী লড়াই দেখছে।

এই লড়াইয়ে বক্সিং রিংয়ের একদিকে রয়েছেন ৭০ বছরের একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ও রিয়েলিটি টিভির হোস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি শুধু বাগাড়ম্বর সম্বল করে এই নির্বাচনে নেমেছেন। প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর প্রধান যোগ্যতা তিনি সফল ব্যবসায়ী, অথচ চার চারটে ব্যবসায় তিনি দেউলিয়া হয়েছেন। ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ঘায়েল করার ব্যাপক পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে, কিন্তু সে বিষয়ে কোনো তথ্য কাউকে জানাবেন না। তিনি দাবি করেছেন, জেনারেলদের চেয়েও সমরবিদ্যা বিষয়ে তিনি নাকি বেশি জানেন। রাজনীতি বা সমরনীতি নিয়ে তিনি কার সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন—এ প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, কেন, নিজের সঙ্গে। আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে জোর করে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, কিন্তু কীভাবে এমন অসম্ভব সাধন করবেন তা খোলাসা করে বলেননি। তাঁর দাবি, তিনি ১০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠানের মালিক, অথচ নিজের আয়কর হিসাব দাখিল করতে রাজি নন। সব ব্যাপারেই তাঁর এক উত্তর, ‘আমাকে বিশ্বাস করুন, সব হয়ে যাবে।’
রিংয়ের অন্য কোনায় ৬৯ বছর বয়সের হিলারি ক্লিনটন, ৩০ বছর ধরে তিনি সারা বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত নারী রাজনীতিক। তিনি ফার্স্টলেডি, সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক একবাক্যে স্বীকার করেন, তাঁর মতো এত অভিজ্ঞ রাজনীতিক কখনো এই দেশের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হননি। ওবামা নিজেও সে কথা বলেছেন। তারপরও দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ তাঁর প্রতি আস্থাহীন। নির্বাচিত হলে তিনি হবেন এ দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, অথচ দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ নারী তাঁর প্রার্থিতা সমর্থন করেন। উদারনৈতিক বলে পরিচিত এমন মানুষদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তবুও তাঁদের মাত্র ৬৩ শতাংশ তাঁকে ভোট দিতে প্রস্তুত।

এক মাসে আগেও ভাবা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনায়াসে নকআউটে ঘায়েল করবেন হিলারি ক্লিনটন। ট্রাম্প নিজেও সেই সম্ভাবনা মেনে নিয়ে বলা শুরু করেছিলেন, হেরে গেলে তিনি লম্বা ছুটিতে যাবেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহের হিসাবে বড় ধরনের গোলমাল ধরা পড়েছে। যেখানে হিলারি ট্রাম্পের তুলনায় জনসমর্থনের হিসাবে ৮ থেকে ১২ শতাংশে এগিয়ে ছিলেন, সেখানে এখন তাঁদের অবস্থান প্রায় সমানে সমান। সব পণ্ডিত হিসাব করে বলেছিলেন, জনমতের অবস্থা যা-ই হোক, ইলেক্টোরাল ভোটের হিসাবে ট্রাম্পের জয়ের কোনো সুযোগই নেই। মোট প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই ইলেক্টোরাল ভোট। প্রেসিডেন্ট হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হবে। এখন সর্বশেষ যে নির্বাচনী মডেল তৈরি হয়েছে, তার কোনো কোনোটিতে ট্রাম্প ও হিলারি হয় সমান সমান, অথবা ট্রাম্প এগিয়ে। ওহাইও, আইওয়া ও ফ্লোরিডায়, যেখানে হিলারি এগিয়ে আছেন বলে ভাবা হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে এসব অঙ্গরাজ্যে অধিক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন ট্রাম্প।

রাজনীতির ঘুঁটি এভাবে উল্টে গেল কীভাবে?

অবাস্তব হলেও মানতে হবে, দেশের রক্ষণশীল মহলে ট্রাম্পের সমর্থন আরও সংহত হয়েছে। প্রার্থী হিসেবে তিনি এখন অনেক বেশি শৃঙ্খলাপরায়ণ। দেশের শ্বেতকায় ও স্বল্পশিক্ষিত, যাঁরা তাঁর প্রধান সমর্থক, ট্রাম্পের এই পরিবর্তনে আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। এসব ভোটার যেকোনো মূল্যে ওবামার তৃতীয় দফা ঠেকাতে চান। এদের চোখে হিলারি ওবামার তৃতীয় দফা ছাড়া আর কিছু নন। অব্যাহত অভিবাসনের ফলে আমেরিকার জনসংখ্যাগত চরিত্র নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছে। তাঁরা চান এই পরিবর্তন ঠেকাতে। ট্রাম্প তেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদ দমনে ট্রাম্প লৌহহস্ত হবেন, তাঁর এমন প্রতিশ্রুতিতেও এই শ্বেতকায় সম্প্রদায় বিশ্বাস স্থাপন করেছে।

ট্রাম্প গণ্ডমূর্খ, যখন যা খুশি মুখ ফুটে বলে বসেন, তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। এসব কথা তাঁরা জানেন। তবুও ট্রাম্পের প্রতি তাঁদের শক্ত সমর্থন। ট্রাম্প তিনবার পাণিগ্রহণ করেছেন ও বহু নারীঘটিত কেলেঙ্কারির নায়ক। জীবনে কৃতকর্মের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন না। তারপরও দেশের ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান ভোটাররা ট্রাম্পের পক্ষে। এর প্রধান কারণ, এরা সবাই যেকোনো মূল্যে হিলারিকে হারাতে চান। দেশের সুপ্রিম কোর্টে এই মুহূর্তে একটি শূন্য পদ রয়েছে। বয়সের কারণে আরও দু-একটি পদ শূন্য হতে পারে। প্রেসিডেন্ট হিলারির হাতে যাতে কোনো উদারনৈতিক বিচারক মনোনীত না হন, তাঁরা সেটা নিশ্চিত করতে চান।

ডেমোক্রেটিক কৌশলবিদেরা হিসাব করে বসে ছিলেন, নথিভুক্ত ভোটারের হিসাবে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যা বেশি। তার ওপর গত দুই দফার নির্বাচনে ওবামা বড় ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে এনেছেন। যাঁরা ওবামাকে এই দুই দফা ভোট দিয়েছেন, তাঁরা হিলারিকেও এবার ভোট দেবেন, বাস্তবে সে কথা সত্য প্রমাণিত হয়নি। একমাত্র আফ্রিকান-আমেরিকান ছাড়া তথাকথিত ওবামা কোয়ালিশনের কোনো গ্রুপ (নারী, যুবক ও সংখ্যালঘু) এখন পর্যন্ত হিলারির ব্যাপারে উৎসাহী নয়। বিশেষজ্ঞেরা এর নাম দিয়েছেন ‘এন্থুজিয়াজম গ্যাপ’।

হিলারি নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবি করলেও ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবেরদের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম সুবিদিত। এর ফলে ডেমোক্রেটিক পার্টির বাম অংশ হিলারি থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ক্লিনটন পরিবার ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে, এমন একটা ধারণা স্বতন্ত্র ভোটারদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। নিজের শারীরিক অবস্থা বিষয়ে হিলারি কিছু একটা গোপন করছেন, এমন একটা ধারণাও এই স্বতন্ত্র ভোটারদের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়িয়েছে। ৪০-ঊর্ধ্ব নারীরা তাঁকে সমর্থন করলেও, নতুন প্রজন্মের নারীরা বলছেন, শুধু নারী এই কারণে কাউকে ভোট দেওয়ার চিন্তা অতিসাবেকি।

নভেম্বরের ৮ তারিখে ভোট। এই ভোটে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি ভাইস প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হবেন। হাতে আছে আর মাত্র ৪৯ দিন। তাই দুই পক্ষই মাঠে নেমেছে সর্বশক্তি নিয়ে। ট্রাম্পের প্রতি অসন্তুষ্ট এমন অনেক রিপাবলিকান চাঁদাদাতা তাঁর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন। মাঠপর্যায়ে তাঁর তেমন ব্যবস্থাপনা নেই। সেদিক থেকে হিলারি অনেক সুবিধাজনক অবস্থায়। তাঁর অন্য সুবিধা, এই মুহূর্তে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ওবামা যেভাবে হোক হিলারির জয় নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। সঙ্গে আরও রয়েছেন প্রগতিশীলদের দুই বড় নায়ক, সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন। জনসমর্থনের ঢেউ বদলানোর ক্ষমতা তাঁদের রয়েছে।

হিলারির অন্য আশা, তিন তিনটি মুখোমুখি বিতর্ক, যার প্রথমটি হবে ২৬ সেপ্টেম্বর। তিনি ঝানু তার্কিক, অপ্রস্তুত ও অনভিজ্ঞ ট্রাম্পকে ঘায়েল করা তাঁর জন্য কঠিন হবে না। হয়তো সে কথাই ঠিক, কিন্তু এর আগেও ট্রাম্পকে বড় আনাড়ি ভেবে হিলারি ও তাঁর সমর্থকেরা আনন্দিত হয়েছিলেন। সেই একই ভুল তাঁরা করছেন কি না, তা বোঝা যাবে এক সপ্তাহের মধ্যেই।

হাসান ফেরদৌস, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন