সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত রকীব কমিশনের যত বিশেষণ!

রাষ্ট্রপতির সাথে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কাজী রকীব নির্বাচন কমিশন


ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার


কাজী রকীব নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকাল শেষ হয়ে আসছে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ সদস্যবিশিষ্ট ড. এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বর্তমান ৫ সদস্যবিশিষ্ট কাজী রকীব নির্বাচন কমিশনকে নিয়োগ দেন। ২০১৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে এ কমিশনের মেয়াদকাল শেষ হবে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে। দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও পেশাদার নির্বাচন কমিশন এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। কারণ, বাংলাদেশে এখন স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংকট চলছে এবং ওই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে নির্বাচন কমিশন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে অবশ্যই দক্ষ ও যোগ্য নির্বাচন কমিশনের দরকার আছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিরোধী দল এবং সুশীল ও নাগরিক সমাজের দাবি অনুযায়ী যদি স্বচ্ছ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং প্রয়োজনে সাংবিধানিক সংশোধনী করে কোনো নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা তৈরি করা হয় এবং নির্বাচনটি যদি ওই সরকারের অধীনে হয়, তাহলেও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার। আবার, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকরাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করাটা খুবই প্রয়োজন।

‘অথর্ব’, ‘মেরুদণ্ডহীন’ ও ‘সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’: খালেদা জিয়া  
‘আজ্ঞাবহ’: নূরে আলম সিদ্দিকী
‘বেহায়া’, ‘বেশরম’ ‘আজিজ এর চেয়েও খারাপ’: এরশাদ
‘সেবাদাস’: রিজভী আহমেদ
‘তল্পিবাহক’: সালাহউদ্দিন আহমেদ
‘ধামাধরা’: নোমান
‘দুষ্টের শিরোমনি’: রিপন


নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটি বড় রকমের ভুলের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত আইন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ৪৬ বছরে কোনো সরকারই কমিশন গঠনের জন্য আইন তৈরি করেনি। পরিবর্তে, সামরিক বা বেসামরিক, প্রায় প্রতিটি সরকারই কমিশনে নিজস্ব পছন্দের লোক বসিয়ে তাদের কাছ থেকে আনুগত্য ও আনুকূল্য লাভের চেষ্টা করেছে। বর্তমান সরকারও চাইলে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদানের জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করতে পারত; কিন্তু সরকারের তেমন আগ্রহ নেই। ক্ষমতাসীন সরকার সবসময় চায় নির্বাচন কমিশনে মনপছন্দ ধরনের ব্যক্তি বসিয়ে কমিশনের কাছ থেকে আনুকূল্য লাভ করতে। চলমান প্রক্রিয়ায় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। আর রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়ার অর্থ হল ওই নিয়োগে সরকারপ্রধানের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটা। ফলে রাষ্ট্রপতির নিয়োগদানের মধ্য দিয়ে সরকার তাদের পছন্দনীয় ব্যক্তিত্বদেরই কমিশনে নিয়োগ দিতে পারে।

মাঝে-মধ্যে, যেমন গতবার, আইওয়াশ হিসেবে একটি অনুসন্ধান কমিটি করে ওই কমিটির প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর ফলে কোনো লাভ হয়নি। কারণ, যাদের দিয়ে অনুসন্ধান কমিটি করা হয়, তারা ছিলেন সরকারের বেতনভুক কর্মচারী। ফলে ওই রকম অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের পক্ষে সরকারকে অখুশি করে কোনো কাজ করা সম্ভব ছিল কিনা তা ভাবার বিষয়। কমিশনে উপযুক্ত ব্যক্তি নিয়োগ করার জন্য সবচেয়ে ভালো হয় জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত আইন পাস করে নেয়া। আশ্চর্যের বিষয়, এ আইন করার বিষয়টি বিরোধী দলগুলো থেকেও জোর দিয়ে বলা হচ্ছে না। আইন না করে যদি নিতান্তই অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যক্তির তালিকা তৈরি করতে হয়, তাহলে ওই সার্চ কমিটির ৪ থেকে ৫ জনের মধ্যে দু-একজন সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী রেখে বাকিদের দেশপ্রেমিক অরাজনৈতিক নাগরিক বা সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, অথবা অবসরপ্রাপ্ত অবিতর্কিত বিচারপতি বা শিক্ষাবিদের মধ্য থেকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা যায়।

সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে সরকার বেশ আগ্রহী। কারণ, সরকার জানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির কমিশনে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই। সেজন্য সার্চ কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করবে রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই সরকারের মনপছন্দ ব্যক্তিত্বদেরই বেছে নেবেন। কাজেই সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ হলেই যে কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল বর্তমান কাজী রকীব নির্বাচন কমিশন। এ কমিশন ২০১২ সালে সার্চ কমিটি কর্তৃক বাছাইকৃত নামের তালিকা থেকে লোক নিয়েই গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। এ নির্বাচন কমিশনের মতো দুর্বল নির্বাচন কমিশন আগে খুব কমই দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনের মানসম্মান বা ভাবমূর্তি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা কাজী রকীব কমিশনের গত সাড়ে চার বছরের কার্যাবলী পরীক্ষা করলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

সার্চ কমিটি দ্বারা গঠিত রকীব কমিশন দশম সংসদ নির্বাচনের মতো লজ্জাজনক ও ব্যতিক্রমী নির্বাচন করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই একটি দল সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে- এমন একটি সংসদ নির্বাচন করা তো বিরল ব্যাপার। এমন নির্বাচন এবং যে কমিশনের অধীনে এ নির্বাচন হল, যুগপৎভাবে কলংকিত সংসদ নির্বাচনের তালিকার প্রথমদিকে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ কমিশনের অধীনে যে চার রকমের স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে সে নির্বাচনগুলোতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায়ও এ কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। পাঁচ পর্বের উপজেলা, ছয় পর্বের ইউপি, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করতে গিয়ে এ কমিশন সামান্যতম পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে পারেনি। এসব নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা বা সন্ত্রাস-সহিংসতা কমাতে কমিশনের প্রচেষ্টাও দৃশ্যমান ছিল না।

প্রহসনের দশম সংসদ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্বচ্ছ ও সহিংসতামুক্ত করতে কমিশন আগ্রহী ছিল না। এ কারণে দুই পর্বের নির্বাচন হওয়ার পর সিইসি সস্ত্রীক আমেরিকা চলে যান এবং ব্যাপক নৈরাজ্য ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেশে এসে বলেন, ‘আমি থাকলেও নির্বাচন এমনই হতো।’ তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করতে গিয়ে এ কমিশন বাতিল ভোটের রেকর্ড (৫.৪৪%) করে। দুপুরের আগেই বিরোধীদলীয় মেয়রপ্রার্থীরা নির্বাচন বয়কট করায় ভোট কেন্দ্র ফাঁকা হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রামে ১২টি কেন্দ্রে ৯৫ থেকে ৯৯ ভাগ ভোট পড়ে। এ নির্বাচনের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে সুজনের ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গণতন্ত্রকে কবরস্থ ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার জন্য নির্বাচন কমিশনের বিচার হওয়া উচিত।’ পৌর নির্বাচনেও রকীব ইসি রেফারির ভূমিকা পালন করতে পারেনি। খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রচারে কোনো টিভি চ্যানেল রাজি না হলেও ইসি এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করে। ইউপি নির্বাচনে নিবাচনী সহিংসতায় ১৪৫ জন খুন এবং ১১ হাজার আহত হলেও ইসি এসব খুনের বিচার করেনি। এ নির্বাচন দেখে সরকারের বিশেষ দূত এরশাদ বলেন, ‘এটাকে কি নির্বাচন বলে?’ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ নির্বাচনটিকে ‘ভৌতিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, এ নির্বাচনে ‘জীবিতরা ভয়ে ভোট কেন্দ্রে না গেলেও মৃতরা ভোট দিয়েছে।’

এ হল সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত রকীব কমিশনের পারফরম্যান্স। আয়ু শেষ হওয়ার আগে এ কমিশন নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করার সুযোগ পাবে। ওই দুই নির্বাচনেও যে আগের নির্বাচনগুলোর দুর্নীতি-কারচুপি ও সহিংসতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে সে বিষয়টি অনুমান করা যায়। রকীব কমিশনের কর্মকাণ্ডের কারণে নানাজনের কাছ থেকে যেসব বিশেষণ উপহার পাওয়া গেছে, তার বিশ্লেষণেও সার্চ কমিটি গঠিত এ কমিশনের হুকুমবরদারি চরিত্র ধরা পড়ে। খালেদা জিয়া এ কমিশনকে ‘অথর্ব’, ‘মেরুদণ্ডহীন’, ও ‘সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ বিশেষণে বিশেষিত করেন। নূরে আলম সিদ্দিকী এ কমিশনকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ’। সরকারপ্রধানের বিশেষ দূত এরশাদ যখন কমিশনকে ‘বেহায়া’, ‘বেশরম’ এবং ‘আজিজ মার্কা কমিশনের চেয়েও বেশি খারাপ’ অভিহিত করেন, তখন বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ এ কমিশনকে বিশেষিত করেন যথাক্রমে ‘সেবাদাস’ এবং ‘সরকারের তল্পিবাহক’ হিসেবে। আরও দুই বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান এবং আসাদুজ্জামান রিপন রকীব কমিশনকে যথাক্রমে ‘ধামাধরা’ এবং ‘দুষ্টের শিরোমনি’ বিশেষণে আখ্যায়িত করেন। কাজেই সার্চ কমিটি গঠন করে কমিশনে নিয়োগ দিলেই যে কমিশন ভালো হবে এমনটি মেনে নেয়া যায় না। বরং বাস্তবে দেখা যায়, সার্চ কমিটি গঠিত কমিশনের ওপর সরকার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এ কারণেই হয়তো সরকার গতবারের মতো একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে একই রকম আরেকটি নির্বাচন কমিশন চাইছে। কিন্তু এমনটি হলে কমিশন স্বাধীন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও শক্তিশালী হতে পারবে না।

সরকার যদি সত্যিই নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে চায় তাহলে একবার সার্চ কমিটি দ্বারা গঠিত রকীব কমিশনের পারফরম্যান্স দেখার পর দ্বিতীয়বার আবার সার্চ কমিটির দিকে যাওয়ার চিন্তা করা উচিত নয়। ন্যাড়া মাথায় একবার বেল তলায় গিয়ে আঘাত পাওয়ার পর একই অবস্থায় দ্বিতীয়বার বেল তলায় যাওয়ার চিন্তা না করাই ভালো। পরিবর্তে যেহেতু এখনও সরকারের হাতে মাসপাঁচেক সময় আছে, সরকার চাইলে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসুবিধাগুলো মনে রেখে যে কোনো নাম দিয়ে নির্বাচন করার জন্য একটি নির্দলীয় সরকার গঠনসংক্রান্ত বিল পাস করে সে সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচন করতে পারে। সরকার দলীয় বা নির্দলীয়, যে কোনো রকম সরকারের অধীনেই সংসদ নির্বাচন করুক না কেন, নির্বাচন স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুুক্ত করতে স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং পরামর্শ করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংসদে একটি আইন পাস করে সে আইন অনুযায়ী সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করলে ভালো হবে। নির্দলীয় সরকার আইন বা নির্বাচন কমিশন গঠন আইন পাস করতে পারলে এ কাজগুলো সরকারের জন্য কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হবে অবশ্যই।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন