সিন্ধুর পানি নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পানি-যুদ্ধ
চুক্তি বাস্তবায়ন ও সমস্যা সমাধানে স্থায়ী সিন্ধু কমিশন গঠন
➠ ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাক প্রেসিডেন্ট আইউব খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত
➠ সিন্ধু ও তার যে শাখানদীগুলি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, সেগুলির পানিবণ্টন নির্দিষ্ট করতে চুক্তি
সোমবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ৭ লোক কল্যাণ মার্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়৷ বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল, সিন্ধু পানি চুক্তি অনুসারে সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও ঝিলম নদীর পানির যে সিংহভাগ অংশ পাকিস্তান ব্যবহার করে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না৷ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কতটা এবং কী ভাবে করা যায়৷
➠ চুক্তি অনুযায়ী, বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর পানি নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে৷
➠ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত চন্দ্রভাগা ও ঝিলমের উৎস ভারতে। সিন্ধুর উৎস তিব্বতে হলেও ভারতের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ অংশ প্রবাহিত হওয়ায় ২০% পানি সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নৌ চলাচলে ব্যবহার করতে পারে ভারত
১৯৬০ সালে করাচিতে এই চুক্তি সই করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইউব খান৷ চুক্তি অনুযায়ী, কাশ্মীর-পাঞ্জাব অঞ্চলে শতদ্রু, বিপাশা এবং ইরাবতী, এই তিনটি নদীর পানি ভারত ব্যবহার করবে৷ আর সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও ঝিলমের পানি মূলত যাবে পাকিস্তানে৷ তবে সেচ, পরিবহণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ভারতও ব্যবহার করতে পারবে৷ কিন্তু, চুক্তি অনুযায়ী, এই তিনটি নদীর ওপর নয়াদিল্লি কোনও নির্মাণকাজ করতে পারবে না৷ অর্থাৎ বাঁধ দিতে পারবে না৷ কারণ, এই তিন নদীর পানি কোনওভাবে রুখে দিতে পারলে, পাকিস্তানে খরার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে! সেই কারণেই বিশ্ব ব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে এই পানিচুক্তি হয়েছিল৷ গত ছাপান্ন বছরে দু-দেশের সম্পর্কে ভয়ঙ্কর চড়াই -উতরাই এলেও, টিকে গিয়েছে পানিচুক্তিটি৷ কিন্তু, এবার সেই চুক্তির ভবিষ্যতই প্রশ্নের মুখে৷
ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত সিন্ধুর এপার-ওপার ব্রহ্মপুত্র এই চুক্তি বাতিল পাকিস্তানের পক্ষে ভয়ের কেন? কৃষিকাজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও ঝিলমের উপর পাক-কৃষির ৯০ % নির্ভরশীল৷ পাকিস্তানের জিডিপি-র ১৯.৮ % আসে কৃষি থেকে৷ কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪২.৩ % কৃষিতে নিযুক্ত বিদ্যুতের অভাবে গত দু’বছরে ১০০ টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, ৫ লক্ষ মানুষ কর্মহীন৷ সিন্ধু নদীর পানি নিয়ন্ত্রিত হলে বিদ্যুৎ উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে পানীয় পানির আকাল দেখা দেবে সিন্ধুর পানি নিয়ন্ত্রিত হলে ভাসবে জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাবের একাংশ ভারতের উপর প্রভাব ব্রহ্মপুত্রের অংশে বাঁধ দেওয়া ও পানিবণ্টন নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের ঝামেলা চলছে
ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ভারত ও বাংলাদেশের কৃষি, পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকাংশে নির্ভরশীল। সিন্ধুর উৎস তিব্বতে হলেও চীনকে এই চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে৷ চীন সিন্ধুর প্রবাহ রোখার সিদ্ধান্ত নিলে ভারত ও পাকিস্তান --- দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিন্ধু নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে চীন যদি ব্রহ্মপুত্রের পানি বন্ধ করে দেয়, চাপে পড়বে ভারত।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালতের রায় উপেক্ষা করেছে চীন৷ কিন্তু, তারপরও কেউ তাদের টিকিটুকুও ছুঁতে পারেনি৷ দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে বেজিং যদি এই মনোভাব দেখাতে পারে, তা হলে নয়াদিল্লি কেন পারবে না? এখানেই লুকিয়ে অন্য শঙ্কা৷ পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, ভারত যদি তিন নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তা হলে পাকিস্তান নয়, বিপদটা আসতে পারে চীনের দিক থেকে৷ কারণ, ব্রহ্মপুত্রের পানি আটকে দেওয়ার ক্ষমতা চীনের আছে৷ তারা সেটা করলে, বিপাকে পড়বে ভারত৷ সমস্ত দিক বিবেচনা করেই, সোমবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পানি নিয়ে যাই করা হোক না কেন, আইনের পরিধির মধ্যে থেকেই হবে৷
এই প্রসঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মণু সিংভি’র বক্তব্য, ‘চুক্তির মধ্যে থেকেই বাঁধ বানানো যেতে পারে৷ তাও একটা নয়, একাধিক৷’ যদিও, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসুর সাবধানী প্রতিক্রিয়া, ‘এই ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি ভাঙার ফল ভাল হয় না৷ কেন্দ্র বরং আগে কশ্মীরের পরিস্থিতি শান্ত করুক৷’ তবে, ভারত চাইলেও তিন নদীর পানি এখনই রোখা সম্ভব নয়৷ কারণ, চন্দ্রভাগার ওপর বাঁধ তৈরি করতে পাঁচ থেকে আট বছর সময় লেগে যাবে৷ এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের দাবি, পাকিস্তানকে বানিজ্যের ক্ষেত্রে যে মোস্ট ফেভারড্ নেশনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করুক মোদী সরকার৷ পাশাপাশি সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে, পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করা নিয়ে আলোচনা করা হোক৷
উরির ঘটনার পর ঘরে-বাইরে বেশ চাপে নরেন্দ্র মোদী৷ ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের প্রতি মোদীর প্রতিক্রিয়াকে ‘অত্যন্ত দুর্বল এবং ছন্নছাড়া’ বলে আক্রমণ করতে শুরু করেছে কংগ্রেস৷ এমনকি, তাদের দাবি, ‘কোঝিকোড় থেকে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে তাঁর দুর্বলতাই বেশি করে প্রকাশ পেয়েছে৷’
মোদীকে কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জ, কেন্দ্র এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিক, যাতে বোঝা যায়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে চলেছে তারা৷ ইসলামাবাদকে কড়া জবাবের দাবি উঠছে মোদীর ঘরেও৷ প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী তথা প্রবীণ বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহার বক্তব্য, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিক ভারত৷ না হলে মনে হবে, আমরা শুধু গর্জাই, বর্ষাই না৷’ তবে, প্রধানমন্ত্রী আপাতত যুদ্ধের পরিবর্তে বিকল্প পথে হাঁটতেই বেশি আগ্রহী৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন