বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ঈদের দিনেও নিষ্প্রাণ কাশ্মীর, কার্ফু অগ্রাহ্য কাশ্মীরিদের প্রতিবাদ অব্যাহত

এবারই  প্রথম শ্রীনগরের জামা মসজিদে ঈদের জামাত হয়নি। কার্ফু অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদ৷ নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে  ২ জনের মৃত্যু৷ 



ভারতের স্বাধীনতার পর প্রথমবার কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের জামা মসজিদে ঈদের জমায়েত হল না৷ প্রায় একই ছবি ছিল শ্রীনগরের ঈদগাহ এবং হজরতবালেও৷ স্বাধীনতাকামীরা প্রতিবাদ-মিছিলের ডাক দেওয়ায় কাশ্মীর উপত্যকার ১০টি জেলাতেই কার্ফু ও ১৪৪ ধারা জারি করে সোমবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, স্থানীয় মসজিদেই যেন মানুষ ঈদের নামাজ সেরে নেন৷ সকাল থেকেই রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়েছে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী৷ আকাশপথে নজরদারিতে ছিল ড্রোন ও হেলিকপ্টার৷

ঈদের উৎসবের দিনেও নিষ্প্রাণ ছিল কাশ্মীর। কার্ফু অগ্রাহ্য করে ঈদের দিনেও অব্যাহত ছিল কাশ্মীরিদের প্রতিবাদ৷ নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হল দু’জনের৷ আহত বহু৷

আর ভূস্বর্গে শান্তি ফেরাতে চুপিসাড়েই শুরু হয়ে গেল সামরিক অভিযান৷ দক্ষিণ কাশ্মীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামানো হয়েছে গোটা একটা ব্রিগেডকে৷ যদিও ভারতের সরকারি সূত্রে দাবি, তাদের উপর ন্যূনতম শক্তিপ্রয়োগ করার নির্দেশ রয়েছে৷

কার্ফু অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় নামলেন মানুষ৷ বিক্ষোভকারী-নিরাপত্তারক্ষী সংঘর্ষে উত্তপ্ত হল পরিস্থিতি৷ সারা দিনে অন্তত ৫৫টি সংঘর্ষের খবর পাওযা গেছে৷ বান্দিপোরায় ঈদের নামাজ শেষ হতেই বিক্ষোভ শুরু করেন একদল মানুষ৷ পাথরের জবাব আসে যথারীতি কাঁদানে গ্যাস ও পেলেট গানে৷ আহত হন দাচিগামের বাসিন্দা মুর্তাজা আহমেদ৷ পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়৷ দু’দিন আগে শোপিয়ানে সংঘর্ষের পর থেকে নিখোঁজ শাহিদ আহমেদ সেহ -এর মৃতদের এ দিন আবিষ্কার হয় লারগামে৷

মেয়েটাকে জামাও দিতে পারলাম না

ট্যুরিস্ট গাইড আলম বাট বললেন, আমার মেয়েটা কাল থেকে বায়না করছে নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তো উপায় নেই৷ কার্ফু চলছে৷ বাজার-হাট বন্ধ৷ এমনকি কুরবানির জন্য যে বিশেষ কেনাবেচা হয়, হয়নি তা-ও৷ কিন্তু আমার ৪ বছরের নূর তো আর এ সব বোঝে না৷ আমার মতো এমন বাবা অনেক আছেন৷ এখন রাস্তাঘাটে বেরোতেও ভয় করে৷ টানা কার্ফু৷ আমাদের তো আর কিছু বেঁচে নেই৷ এমনিতে ট্যুরিস্ট সিজনে আমি গাইডের কাজ করি৷ রোজগার ভালোই হয়৷ তার পর শীতের মুখে শাল বিক্রি করতে কলকাতায় আসি৷ কিন্ত্ত এ বার আর তা হবে না৷ শাল , সালোয়ার কামিজের পিস --- এ সব তো তুলতেই পারিনি৷ কী নিয়ে যাব? আর জিনিস আনতে অনেক দূরে যেতে হয়৷ কোন সাহসে রাস্তায় বেরোব? রাজনীতিকরা তো নিজেদের ধান্দা নিয়ে থাকে, আমাদের দেখার কেউ নেই৷ আমরা ছোট্ট থেকে জানি কাশ্মীরিয়ত (যার অর্থ, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ) --- সেখানে হিন্দু-মুসলিমে কোনও বিভেদ থাকে না৷ সেটাকেই হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে এখন৷ এ ব্যথা ভোলার নয়৷ যেমন, ভোলার নয় ছোট্ট নুরের মুখে না-পাওয়ার অন্ধকার৷ আমি ব্যর্থ৷ ব্যর্থ আমার কাশ্মীরিয়ত৷                        

অন্য চোখে লেগে থাকবে রক্তের দাগ

শাজিয়া ইউসুফ , ফ্রিল্যান্স লেখক

‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার ’৷ ঈদের ভোরে চোখ চেয়ে আমার এ কথাটাই মনে হল৷ কারণ ঘুম ভাঙতেই ভেসে উঠল আমিরের মুখ৷ আমার পাশের বাড়ির সেই কিশোর ছেলেটি , যে গত ২১ দিন ধরে হাসপাতালে৷ পেলেটে বিদ্ধ ১৪ বছরের ছেলেটির ডান চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা৷ পিঠেও অসংখ্য ছররার দাগ৷ প্রত্যেক বছর ঈদে ওদের বাড়ির সঙ্গেই আমরা উত্সবে মাততাম৷ ওর নানা ছেলেমানুষিতে ঈদের আনন্দ আমাদের কাছে দ্বিগুণ হয়ে উঠত৷ তাই এ বারে আমার ঈদ ঢেকে রইল অন্ধকারে৷ কোনও বেকারি খোলেনি৷ খোলেনি বাজার -দোকান৷ রাস্তাঘাটে মানুষ নেই৷ হাসি নেই৷ আলো নেই৷ কান পাতলেই শোনা যায় ভারী বুটের শব্দ৷ আব্বা -নানার কাছে শুনেছি , ১৯৯১ সালে ঈদের সময় এমনই থমথমে ছিল এই উপত্যকা৷ এ বার নিজের চোখে দেখছি৷ এ ভাবে মানুষ বাঁচতে পারে ! কিন্ত্ত তাও আমরা বেঁচে আছি৷ স্কুল বন্ধ৷ কলেজ খোলে না৷ খেলা বন্ধ৷ অফিস -কাছারি খ াঁ খ াঁ৷ বাড়ি থেকে বেরোলে জানি না কী ভাবে ফিরব৷ জীবন্ত , না কফিনবন্দি৷ তাই এ বছর ঈদে কুরবানিরই অর্থই আমার কাছে বদলে গেছে৷ বাবা এ বার ৮২ জন নিহতের কথা মনে রেখে নমাজই পড়েননি৷ বলেছে , ‘ওরাই তো কুরবানি দিয়েছে৷ আমার আর কিছু ভালো লাগছে না৷ ’ আর নমাজ শেষে আমার সামনে ফের ভেসে উঠল আমিরের দুষ্টুমি -ভরা চোখ দু’টিই৷ যার একটা দিয়ে সে আর দেখতে পাবে না৷ অন্য চোখটায় হয়তো শুধুই দেখবে রক্ত , লাশ আর জানাজা৷ আদৌ আর কোনও দিন বলতে পারব তো ‘ঈদ মুবারক ?’ ৷
  
অপারেশন কাম ডাউন

এক সপ্তাহের মধ্যে ভূস্বর্গে শান্তি ফেরাতে রবিবার নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং৷ আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিঃশব্দেই ‘অপারেশন কাম ডাউন’ শুরু করে দিয়েছে সামরিক বাহিনী৷ দক্ষিণ কাশ্মীরের সবচেয়ে অশান্ত চারটি জেলা পুলওয়ামা, সোপিয়ান, অনন্তনাগ ও কুলগামে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত চার হাজার সেনা৷ সরকারি একটি সূত্রে খবর, সিআরপিএফ এবং স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় ওই জওয়ানরা চার জেলায় জঙ্গি বা তাদের সাহায্যকারীদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছেন, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, বোল্ডার বা পুড়ে যাওয়া গাড়ি দিয়ে রাস্তা অবরোধ হঠিয়ে দিচ্ছেন এবং উপত্যকা জুড়ে মানুষের যাতায়াত সহজ করার দিকে নজর রাখছেন৷ ঈদের জন্য মঙ্গলবার অভিযান বন্ধ থাকলেও বুধবার থেকে ফের তা পুরো দমে শুরু হয়েছে৷

এদিকে কাশ্মীর নিয়ে ফের ভারতকে খোঁচা দিলেন নওয়াজ শরিফ৷ ঈদ-উল-আজ্হা উপলক্ষে একটি বার্তায় পাক প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘কাশ্মীরিদের আত্মত্যাগ আমরা অস্বীকার করতে পারি না৷ এই ত্যাগের মধ্যে দিয়েই তাঁরা সফল হবেন৷ কাশ্মীরের মানুষের চরম আত্মত্যাগকেই এই ঈদ উত্সর্গ করলাম আমরা এবং যতদিন মা ওঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হচ্ছে , ততদিন আমরা (সমর্থন ) করে যাব৷’  

জাতিসংঘ নি:শর্ত প্রবেশাধিকার চায়

কাশ্মীর পরিস্থিতির নিরপেক্ষ বিচারের জন্য নিয়ন্ত্রণ রেখার দু’দিকেই নিঃশর্তে প্রবেশাধিকার চাইল জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন৷ মানবাধিকার বিষয় ইউএন হাইকমিশনার জাইদ রা’দ অল হুসেন জানিয়েছেন, দু’মাস আগে ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশের সরকারের কাছেই তিনি আর্জি জানিয়েছিলেন, তাঁদের একটি নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদলকে নিয়ন্ত্রণ রেখার দু’দিকেই কাশ্মীরে যেতে দেওয়া হোক৷ তাঁর কথায়, ‘আমরা রিপোর্ট পেয়েছি এবং পাচ্ছি, ভারত সরকার (কাশ্মীরে ) নাগরিকদের উপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছে৷ তা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ রেখার দু’দিক থেকে পরস্পরবিরোধী কথা আমাদের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে৷’ সে জন্যই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ জরুরি বলে তাঁর মত৷ পাক সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পেয়ে গিয়েছেন তাঁরা৷ কিন্তু ভারত এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি৷

ইউএন হাইকমিশনারের এই মন্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ভারত৷ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, কাশ্মীরের সঙ্গে পাক আধিকৃত কাশ্মীরের কোনও তুলনাই হতে পারে না৷ কারণ, কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার রয়েছে৷ যা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নেই৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন