বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কাশ্মীরে ইতিমধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করেছি, তাকে পাকিস্তানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না


এ এস দুলাত  


রোববার সকালে জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে সেনাশিবিরে যে হামলা হলো, তা খুব বড় ধরনের উসকানি। বিবরণ অনুসারে, জইশ-ই-মোহাম্মেদ এ হামলা চালিয়েছে। আমরা জানি, পাকিস্তান কিছুদিন পরপর এ ধরনের হামলা করে থাকে, ২০০২ সালের মে মাসের কালুচক হামলা বা ২০০৮ সালের নভেম্বরের মুম্বাই হামলা হোক। বস্তুত, কালুচক হামলাও অনেকটা এ রকম ছিল। ওই হামলায় ৩০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন, সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানদের পরিবারের সদস্যরাও প্রাণ হারিয়েছিলেন। আসলে সেই হামলার পর থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে এসব হামলায় পাকিস্তানের হাত আছে।

বোরহান ওয়ানি হত্যার পর কাশ্মীরে দুই মাস স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত
এবারের হামলার আগে আমরা পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামোর কাছ থেকে অনেক বাগাড়ম্বর শুনেছি। এটাও উল্লেখ করার মতো, পানামা পেপারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নাম আসায় তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর এ হামলা হলো। তার আগ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফের রসায়ন ভালোই ছিল। পানামা পেপারস নওয়াজ শরিফকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান কমজোর হয়ে গেছে। এরপর দেখা গেল, নওয়াজ শরিফ কাশ্মীর ও বুরহান ওয়ানির প্রসঙ্গে স্বভাববিরুদ্ধভাবে আক্রমণাত্মক কথা বলছেন। মনে হচ্ছে, তিনি চাপের মুখে ছিলেন। এই বাগাড়ম্বর বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বেলুচিস্তানের প্রসঙ্গ টেনে আনে।

কী কারণে এটা হয়েছে, জানি না। তবে পাকিস্তান উরি হামলার মধ্য দিয়ে বিপদ আরও বাড়িয়ে ফেলেছে। কালুচক হামলার পর এটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর সবচেয়ে বড় হামলা। ফলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ কথা না বলে উপায় ছিল না যে, এর বিচার হবে।
কাশ্মীরের উরি সেনাশিবিরে হামলায় নিহত সেনার কফিন 

কথা হচ্ছে, কারগিল, সংসদ ও মুম্বাই হামলার মতো উসকানির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত কূটনৈতিক চাপ দিয়েছে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা কাজে এসেছে। উরি হামলার পর নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারত আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলবে। এ কথা বলার কিছুটা যৌক্তিকতাও আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংসদ ভবনে হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আলগা করেছিলেন। এই সুযোগ এখনো আছে।

সুনির্দিষ্ট হামলার প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে না। এসব ব্যাপার নিয়ে অতীতেও চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। নিশ্চিতভাবে সরকারকে এই আহ্বান গ্রহণ করতে হবে সবকিছুর বিবেচনায়। এবার দুটি জিনিস ভারতের পক্ষে নেই। প্রথমত, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা ইতিমধ্যে ভালো নয়। ব্যাপারটা হয়তো অদ্ভুত লাগবে, কিন্তু কথা হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো থাকলেই এসব সুনির্দিষ্ট হামলা সফল হয়। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরে আমরা ইতিমধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করেছি। দুই মাস ধরে সেখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আর সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী সেখানকার বিদ্রোহের স্রোত রুখতে পারছে না। এই দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনার ফলাফল হিসেবে দক্ষিণ কাশ্মীরের তরুণ বা জঙ্গিরা উৎসাহিত হতে পারে। কথা হচ্ছে, কাশ্মীরকে আলাদাভাবে দেখতে হবে, তাকে পাকিস্তানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। নব্বইয়ের দশকেও আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীকে নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সমাধান নয়। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এসব কথা কেউ শোনে না, যার সঙ্গে উরি-বিষয়ক আমাদের প্রতিক্রিয়ার সরাসরি সম্পর্ক নেই। কিন্তু এটা আমাদের পরিপ্রেক্ষিতের অংশ।

উরি হামলার পরিণতি ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না। আশা করি, পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামোর হুঁশ হবে। ডিজিএমও (ডিরেক্টরস জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস) পর্যায়ের আলোচনার কথা হচ্ছে। কিন্তু এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা। কথা হচ্ছে, তথ্য আদান-প্রদান করা যেতে পারে, পাঠানকোট হামলার পর যেটা দেখা গেছে। আর মুম্বাই হামলার পর এসব আলোচনা থেকে তেমন কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও গুরুতর আলোচনার প্রয়োজন আছে।

আমি আশাবাদী, দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা বৈঠক করবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বৈঠক যে পাদপ্রদীপের আলোয় হতে হবে, তেমন কথা নেই। ভারতের কঠোরভাবে কিছু জিজ্ঞাসা ও বক্তৃতা করার আছে। আর পাকিস্তানকে ব্যাখ্যা করতে হবে। আমাদের এই অবস্থা থেকে বের করে আনার দায়িত্বটা ইসলামাবাদের ওপর। দুটি দেশই পেছনের দরজার কারবার বন্ধ করে দিয়েছে। আছে শুধু এনএসএ, যাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে। দুই দেশের এই সংস্থাই এখন পেছনের দরজা দিয়ে যোগাযোগ রাখে। তাদের অবশ্যই আলোচনায় বসতে হবে। এরপর নয়া দিল্লির যা করণীয়, তাকে সেটা করতে হবে।

মুম্বাই হামলার পর জানা গিয়েছিল, পাকিস্তানের আন্তবাহিনী গোয়েন্দা সংস্থার ডিজিকে ভারতে পাঠানো হবে। এমনকি তখনো এই ধারণা অনেকটা অবাস্তব মনে হয়েছে। শেষমেশ তিনি আসেননি। কিন্তু তিনি যদি আসতেন, তাহলে মানুষের উত্তেজনা কিছুটা কমত। এখন সেটা করতে হলে প্রচলিত ধারার বাইরে এসে অসাধারণ কিছু একটা করতে হবে।

অন্যদিকে যাঁরা বলছেন পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদির যাওয়া ঠিক হবে না, তাঁরা অপরিপক্বের মতো কথা বলছেন। এ বিষয়ে বিবেচনাপ্রসূত অবস্থান নেওয়ার সময় এসেছে। এটা সঠিক সময় নয়।

উরির ঘটনা থেকে বোঝা গেল, পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। আর এই ঘটনার পর এখন সরকারের যা করা উচিত, তাকে সেটা করতে হবে বেশি কথা না বলে। তা না হলে দেখা যাবে, কিছু না করেও কোনো ঘটনার দায়ভার ভারতকে নিতে হবে।

এ এস দুলাত: ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা-রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) এর সাবেক প্রধান।

ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ থেকে ভাষান্তর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন