সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

দুটো চোখের দেখা হোক, এমন কারও দিকে তাকান, যাকে আপনি চেনেন না

স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি মানেই একটা বিশেষ কিছু। আশির দশক থেকে সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া দ্য বিএফজি —প্রতিটি ছবিতেই তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন-বক্তা ছিলেন তিনবার অস্কারজয়ী এই পরিচালক।



স্টিভেন স্পিলবার্গ


আমার সমাবর্তন অনুষ্ঠানের দিনটি আমি এখনো স্মরণ করতে পারি। সহজেই, কারণ আমি মাত্র ১৪ বছর আগের কথা বলছি। তোমাদের মধ্যে আর কেউ আছ, যার স্নাতক শেষ করতে ৩৭ বছর সময় লেগেছে? আমার লেগেছিল। কারণ, আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখনই আমার স্বপ্নের জায়গা—ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে কাজের প্রস্তাব পাই। আমি কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলাম। মা-বাবাকে বলেছিলাম, যদি চলচ্চিত্রের জগতে ভালো করতে না পারি, তাহলে আবার ভর্তি হবো।
আমি ভালো করেছিলাম।

কিন্তু একটা বিশেষ কারণে আমাকে আবার কলেজে ফিরতে হলো। কলেজে কেউ যায় শিক্ষার জন্য, কেউ মা-বাবার মন রক্ষার জন্য...আমি গিয়েছিলাম আমার সন্তানদের জন্য। আমি সাত সন্তানের জনক। সন্তানদের সব সময় কলেজে যাওয়ার গুরুত্বের কথা বলি, অথচ আমি নিজেই সে পথে হাঁটিনি! অতএব বয়স ৫০ পেরোনোর পর আমাকে আবার কলেজে ভর্তি হতে হলো। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আমি ডিগ্রি অর্জন করলাম।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। জুরাসিক পার্ক ছবির জন্য কলেজে আমাকে জীবাশ্মবিজ্ঞান কোর্সের তিন ক্রেডিট দেওয়া হয়েছিল। ধন্যবাদ জুরাসিক পার্ক!

নিজের লক্ষ্যটা আমি খুব ভালো করে জানতাম। হয়তো তোমাদের মধ্যেও অনেকে জানো...অনেকে জানো না। হয়তো তোমার ধারণা ছিল তুমি জানো, কিন্তু এখন দ্বিধায় ভুগছো।

তোমার এখনকার সময়টাকে চলচ্চিত্রের ভাষায় আমরা বলি ‘চরিত্রনির্ধারণী মুহূর্ত’। এ ধরনের মুহূর্তের সঙ্গে তোমরা পরিচিত। যেমন স্টার ওয়ারস: দ্য ফোর্স অ্যাওয়েকেনস ছবিতে রে যখন বুঝতে পারে, শক্তিটা তার সঙ্গে আছে। অথবা ইন্ডিয়ানা জোনস যখন সাপের স্তূপের ওপর দিয়ে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

দুই ঘণ্টার একটা ছবিতে সামান্য কিছু চরিত্রনির্ধারণী মুহূর্ত থাকে। কিন্তু বাস্তবে? তোমাকে প্রতিদিন নিজের চরিত্র নির্ধারণ করতে হয়। আমি সৌভাগ্যবান, ১৮ বছর বয়সেই জানতাম আমি কী করতে চাই। কারণ জীবনের প্রথম ২৫ বছরে আমাদের সাধারণত অন্যের কথা শুনতে অভ্যস্ত করা হয়। মা-বাবা, শিক্ষকেরা জ্ঞান আর তথ্য দিয়ে আমাদের মাথা ভারী করে তোলেন। এরপর চাকরিদাতা কিংবা অফিসের বস মা-বাবা-শিক্ষকের স্থান দখল করেন। আমাদের শেখান, পৃথিবীতে আসলে কেমন করে চলতে হয়।

সাধারণত এসব কণ্ঠস্বরই পথ দেখায়। মুশকিল হয় তখন, যখন সন্তর্পণে কিছু দ্বিধা আমাদের মাথায়, আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে। যখন মন বলে, ‘পৃথিবীটাকে তো আমি এভাবে দেখতে চাইনি!’ তুমি ভাবতে পারো নিজের ইচ্ছেগুলো দমন করে চলাই তোমার ‘চরিত্র’। অনেকটা নিলসনের গানের মতো, ‘এভরিবডি ওয়াজ টকিং অ্যাট মি, সো আই কুড নট হিয়ার দি ইকোস অব মাই মাইন্ড।’

আমি তোমাদের পরিষ্কার করে বলতে চাই—হৃদয় আর বিবেক দুটো আলাদা। যদিও তারা সাইকেলের দুই চাকার মতো একই সঙ্গে চলে, কিন্তু দুটোর মধ্যে দূরত্ব আছে। বিবেক চিৎকার করে বলবে, ‘এটাই তোমার করা উচিত’। আর হৃদয় ফিসফিস করে বলবে, ‘এটাও তুমি করতে পারতে।’ যে কণ্ঠস্বরটি বলে তুমি কী করতে পারতে, সেটাই শোনো। চরিত্র নির্ধারণের এর চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না।
যখন আমি আমার হৃদয়ের ডাকে সাড়া দিলাম, মনে হচ্ছিল ফেলে আসা পথটা আমাকে পেছন দিকে টানছে। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত আমার ছবিগুলোর মধ্যে একধরনের ‘পলায়নপর প্রবণতা’ ছিল। আমি ওই ছবিগুলোকে অস্বীকার করি না, এমনকি নাইনটিন ফোরটি ওয়ান ছবিটাকেও না। এই ছবিগুলোও আমার ভাবনার প্রতিফলন। কিন্তু আমি আসলে একটা সেলুলয়েড বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়ে ছিলাম। পড়াশোনা ছিল সীমিত। কল্পনায় যতখানি আঁটে, আমার পৃথিবী ছিল ততটুকুই। ভাবিনি, পৃথিবী আমাকে আরও কী শেখাচ্ছে।

সে সময় একটা সিনেমা আমাকে বদলে দিল। দ্য কালার পার্পল। এ ছবিটা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। এমন সব অভিজ্ঞতা দিয়েছিল, যা আমি কল্পনাও করিনি। অথচ এর সবটাই বাস্তব। এই ছবিতে ছিল গভীর দুঃখ এবং গভীরতর সত্য। এটা নির্মাণ করতে গিয়েই আমি শিখেছি, চলচ্চিত্র নির্মাণেরও একটা লক্ষ্য আছে।

আমার কাজ হলো দুই ঘণ্টার একটা পৃথিবী সাজানো। আর তোমরা সাজাবে এমন এক পৃথিবী, যা অনন্তকাল টিকে থাকবে। তোমরাই ভবিষ্যতের আবিষ্কারক। তোমরাই নেতৃত্ব দেবে, প্রেরণা দেবে, দেখভাল করবে।

তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, চোখে চোখ রাখা ভুলে যেয়ো না। মিডিয়ায় কাজ করছে এমন এক লোকের কাছ থেকে কেউ নিশ্চয়ই এই কথা আশা করে না, তবু বলি। যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আমরা এত বেশি সময় ব্যয় করছি, যে আমরা একে অপরের চোখে তাকাতে ভুলে যাচ্ছি। অতএব ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, চলো, আমরা এখন থেকেই শুরু করি। এখানে যারা আছ, আশপাশে কারও না কারও চোখে চোখ রাখো। শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী....প্রেসিডেন্ট ফস্ট, আপনিও। আপনারা সবাই। এমন কারও দিকে তাকান, যাকে আপনি চেনেন না। সে হয়তো আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, কিংবা কয়েক সারি পরে বসেছে। শুধু তাকিয়ে থাকুন। দুটো চোখের দেখা হোক, এইটুকুই চাওয়া। এই যে অনুভূতিটা আপনি টের পাচ্ছেন, একেই বলে মানবিকতা ভাগাভাগি করে নেওয়া, যার সঙ্গে খানিকটা সামাজিক অস্বস্তি লুকিয়ে আছে।

আজকের দিনের কোনো কিছুই যদি আপনার মনে না থাকে, আমি নিশ্চিত এই মুহূর্তটাই আপনার মনে থাকবে—এই মানবিক যোগাযোগের মুহূর্ত। হার্ভার্ডের স্নাতক, আজ থেকে তোমরা আগামী প্রজন্মের জন্য পথ তৈরি করে দেবে, যে পথে ওরা হাঁটবে। আমার সিনেমায় আমি নানা রকম ভবিষ্যতের কল্পনা করেছি, কিন্তু সত্যিকার ভবিষ্যৎটা কেমন হবে, সেটা তো তোমরাই ঠিক করবে। আমার বিশ্বাস, তোমাদের তৈরি ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার আর শান্তি থাকবে। (সংক্ষেপিত)


সূত্র: এন্ট্রাপ্রেনার ডট কম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন