স্বপ্ন এক: শুধু একটি দিন ধর্ষণের আশঙ্কার বাইরে কাটাবো
আফসানা বেগম
একের পরে এক নাম জমা হয়, ইয়াসমিন, সীমা, রিমা, নূরজাহান, হেনা, তনু কিংবা আফসানা, আরো কত... এবারে এক গৃহবধু। নামের স্তূপের দিকে তাকিয়ে বুঝি না কাকে ছেড়ে কার জন্য কতদিন শোক করব, অলিম্পিকের মনোগ্রামের মতো একের উপরে আছড়ে পড়ে আরেকটি শোকের বৃত্ত; তারপর একাকার হয়ে যায়, কোনো শোক থেকে কোনো শোককে আলাদা করা যায় না, নিজস্ব দুর্ভাগ্যের মতো বিরামহীন বাজতে থাকে।
একটা সময় থাকে যখন ধর্ষণের ধারণা জন্মায় না। তবে এখন জানি সে সময়টাতেও সুযোগ পেলে রেহাই দেয় না কেউ। কিন্তু তখন তো জানতাম না। তখন আমরা কানে সোনার দুল পরতাম, গলায় চেইন। ছোট্টকালে কান ফুটিয়ে মায়েরা আদর করে পরিয়ে রাখতেন। একদিন জানা গেল ওইটুকু সোনার জন্য খুন হয়ে যাচ্ছে। পাহারায় কতক্ষণ আর, মা খুলে নিলেন সব। অলঙ্কারকেই প্রথম শত্রুজ্ঞান করলাম। অথচ ধারণা বদলে দিল নীহার বানু। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে রাজনৈতিক ছাড়া সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল যার হত্যাকাণ্ড, তিনি নীহার বানু। প্রেমের প্রস্তাব উপেক্ষা করায় মিথ্যে বলে ডেকে এনে ধর্ষণের পরে তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও পুঁতে দেয়া হয়েছিল। অনেক পরে মাটি খুঁড়ে কঙ্কাল উদ্ধার হয়। বাসায় যেদিন প্রচ্ছদে নীহার বানুসহ বিচিত্রা এসেছিল, সেদিন অভিনব আতঙ্ক দেখেছিলাম বাড়ির লোকদের চোখেমুখে। আর সেটা পরিষ্কার করে বোঝার পরে কখনো এমন কোনো দিন কি এসেছিল যে ধর্ষিত হবার আশঙ্কা হয়নি? শরীরের অপরিহার্য অঙ্গের মতো এই ভয় সাথে থাকে, দিনে-রাতে-ব্যস্ততায়-অবহেলায় কখনো ছাড়ে না, কিছুতে ছাড়ে না। এই দেশ হলো সেই দেশ যেখানে একজন একশ’টি ধর্ষণশেষে উৎসব করে। একসময় ভাবতে চেষ্টা করতাম ধর্ষকের মুখ কেমন হতে পারে, তার চলাফেরা দেখেই বুঝি তাকে চেনা যাবে? তাকে সাধারণ ভাবতে কিছুতে মন সায় দিত না। কী করে দেবে, বন্ধু আছে, ভাই আছে, আত্মীয় আছে, তাদেরে উপরে আস্থা আছে... ধর্ষক কি কখনো তাদের মতো হতে পারে! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের সঙ্গে একই ক্লাসরুমে প্রায় এক বছর কাটানোর পরে যখন জানলাম তার একশ’ ধর্ষণপুর্তির উৎসবের কথা, তখন আর সন্দেহ থাকল না যে ধর্ষক মিশে আছে সবখানে। তারপর ‘তাই হেরি তায় সকলখানে’ ভাবটা প্রকট হলো কেবল।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নারী আন্দোলনের কর্মী এবং আইনজ্ঞরা লড়াই করেছেন, প্রতিবাদ হচ্ছে রাস্তায়, সভায়, লেখায়, কিন্তু কোথাও কিছু বন্ধ হচ্ছে কি? একের পর এক ধর্ষণ হচ্ছে, কদিনেই ধর্ষণটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটা কেসস্টাডি। আমাদের প্রত্যাশা কেসস্টাডির কক্ষপথ ধরে ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে কিছুই পাচ্ছে না। কিছুই পাচ্ছে না তা অবশ্য ঠিক নয়, সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশ কেমন দুর্বল রিপোর্ট দেন, তদন্তকারী ডাক্তার অনায়াসে আঘাতের চিহ্ন গোপন করে মিথ্যে রিপোর্ট তৈরি করেন, ‘forceful sexual intercourse’-এর জায়গায় কী করে ‘habituated’ লেখা হয়, আলামত নষ্ট করে কোনোভাবে কী করে অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টায় সফলতা আসে, এইসব তো শেখা হয়েছে!
জানি না কেউ একে মহামারি জ্ঞান করেন কি না, হিসাবটা এরকম, শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিসে সেন্টারে(ওসিসি) দিনে চার থেকে পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে সেবা নিতে আসেন। প্রতিমাসে সংস্থাটি গড়ে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিত নারীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। এখন খানিক চুপ করে ভাবুন, সারা দেশে তবে দিনে বা মাসে কত নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। সঙ্গে এটাও জানুন যে ‘সামাজিক লজ্জা’কে জয় করে যারা চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না, তাদের হিসাব এখানে নেই। তাছাড়া, মাঝখানে বিরাট এক বাধা হলো চিকিৎসা সেবা পেতে হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের আগে যেতে হবে পুলিশের কাছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের সহায়তা বা উপস্থিতি ছাড়াও কর্তব্যরত চিকিৎসকের প্রতি ভিক্টিমকে চিকিৎসা দেবার নির্দেশ আছে, কিন্তু বাস্তবে তা হতে দেখা যায় না। একই বিষয় মামলার ক্ষেত্রেও, মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে থানায় গেলে ধর্ষণের মামলা নেয়া হয় অথচ একা গেলে প্রায়ই নেয়া হয় না, যেমন, ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৬৩ ভাগ ধর্ষণের শিকার নারী একা মামলা করতে গেছেন দেখে পুলিশ তা গ্রহণ করেননি। বিচারের কথা যে বলব, এটুকু কি পরিস্কার না যে বিচার পাওয়া তো দূরের কথা ধর্ষণের শিকার এক নারীর জন্য বিচার চাওয়াটাও কত কঠিন?
এদেশে পুলিশ হেফাজতে, হাসপাতালে, উপাসনালয়ে, রাস্তায়, বিদ্যালয়ে, অফিসে, বাড়িতে, দোকানে, বাজারে, জলপথে, কোথায় ধর্ষণ হয়নি! কিন্তু আইনের চোখে বিচার চাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলে প্রথমে তা প্রমাণ করতে হবে, মানে, অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব ভিক্টিমের এবং সাক্ষীও লাগবে। আচ্ছা, কেউ কি সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করবে? সে কথা থাক, প্রমাণের নামে অবান্তর প্রশ্নবাণে তাকে বারবার মৌখিকভাবে ধর্ষণ করা হবে। ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা থেকে শুরু করে তার অতীত যৌনাচরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে। ধর্ষক নয়, মানসিক নির্যাতন করা হবে ধর্ষিতাকে। কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞগণ কিছুই বলতে পারেন না, ভিক্টিম যৌনকাজে অভ্যস্ত কি না, হাইমেন ভঙ্গুর কি না এসব প্রমাণের জন্য প্রাচীন(১৮৭২ সালের) ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ যথেষ্ট নয়। এরপর আসামীকে বাঁচানোর নানারকম চাপ তো তাদের উপরে আছেই। তবে একমাত্র ইয়াসমিন ধর্ষণ মামলা ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে মিথ্যে রিপোর্টের জন্য শাস্তি হতেও শোনা যায়নি। কারণ তখন ঘটনাটা সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। অন্য সব ধর্ষণের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা, হা-হুতাশ চলছে, কিন্তু এ ব্যাপারে ধারাবাহিক কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। এখন কথা হলো, প্রতিটি ধর্ষণের সুবিচার চাইতে কি মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে, গুলি খেয়ে অন্তত সাতজনকে মরতে হবে দিনাজপুরের দশমাইলের আন্দোলনের মতো?
বিচার চাইলে আমরা অনেকে কথা ঘোরাই, মেয়েটা ওই সময়ে ওখানে কী করছিল? জাহাঙ্গীরনগরে ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনার পরে অনেকে পত্রিকায় এরকম কথা লিখেছিলেন। এখনো বেশিরভাগ মুক্তমতের ব্লগে দেখা যায় ধর্ষণের আলোচনার ক্ষেত্রে নব্বই শতাংশ মতামত ধর্ষিতার বিপক্ষে; তার পোশাক, তার ভঙ্গি, তার জীবনাচরণ, এসব নিয়ে খোলাখুলি নিন্দার উৎসব চলছে; ধর্ষিতাও সমান দায়ী কিংবা ধর্ষিতাই দায়ী। আচ্ছা, ধরেন, আপনি একটা দামি গাড়ি কিনলেন। রাস্তায় বেরোতেই গাড়িটা ছিনতাই হয়ে গেল। পুলিশে রিপোর্ট করতে গেলে পুলিশ বলল, আপনি গাড়ি কিনেছেন ভালো কথা, রাস্তায় বের করতে গেলেন কেন? সুতরাং এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় আপনারও হাত আছে। আবার ধরেন, গাড়ি বাড়ির পোর্চ থেকে চুরি হলো। আমি বললাম, গাড়িটা আপনি কিনলেন কেন? আর খোলা ফেলে না রেখে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বেডরুমে তালা দিয়ে রাখলে তো আর এমন হতো না!
কিন্তু বেডরুমও কি আসলে নিরাপদ? মোল্লারহাটের জনৈক মোল্লা যখন তলোয়ার দেখিয়ে বাড়িভর্তি মানুষকে বন্দী করেছে আর নিজেরই বাড়িতে গৃহবধুকে ধর্ষণ করেছে, তখন আমরা বলি সংখ্যালঘু হবার কথা, এলাকায় মোল্লার মূর্তিমান আতঙ্ক হবার কথা। অবশ্যই সত্য। আবার অভিজাত এলাকায় প্রভাবশালী বাবার কন্যাকেও কি নিজ বেডরুমে ধর্ষিত হতে হয়নি? তাদেরও যখন দেখি বছরের পর বছর বিচারের জন্য হাপিত্যেশ করছেন, তখন বিষয়টা ভয়াবহ, যেন পুরো দেশ ধর্ষকের অভয়ারণ্য। শুধু এদেশ কেন, পাশের দেশে যাই, ধর্ষণ সাধারণ ব্যাপার সেখানে। কয়েক বছর আগে ভারতে একটি গণধর্ষণের সময়ে তিনজন মানুষ পাশের রাস্তা ধরে যেতে গিয়ে নিজেরাও ধর্ষণে অংশগ্রহন করে ফেললেন। বিষয়টা কি এতটাই জৈবিক যার কাছে মনুষত্ব পুরোপুরি হার মেনে যায়? দিল্লীর বাসে ধর্ষণের ঘটনার মাত্র বারোদিন আগে সেখানকার পার্লামেন্টে বিল উঠেছিল, বিবাহিত মহিলাদের যে কোনো সময়ে তাদের স্বামীরা যৌনকাজে বাধ্য করতে পারবে। সেরকম বেডরুমগুলোর কোনো হিসাব কারো কাছে থাকে না। মনুষত্ব কোথায় খুঁজব, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশের কথাও যদি ধরি, সিডনি হেরাল্ড পত্রিকায় সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘঠিত একটি ধর্ষণের রিপোর্ট অনুসরণ করছিলাম মাস চারেক আগে। শাস্তি হওয়ায় তরুণ ধর্ষকের বাবা আদালতে চিৎকার করে বললেন, মাত্র বিশ মিনিটের একটা কাজের জন্য আমার ছেলেকে সাত মাস জেলে থাকতে হবে?
ভালো কথা, ধর্ষকদের উপরে করা ইউনাইটেড নেশন মালটি কান্ট্রি স্টাডি-র এক সমীক্ষায় নানান চমকপ্রদ তথ্যের মধ্যে এ-ও দেখলাম যে ৬১.১ শতাংশ বাংলাদেশি ধর্ষক ধর্ষণের পর এতটুকু মানসিক অনুশোচনায় ভোগে না এবং ৯১.১ শতাংশ ধর্ষক ধর্ষণের পরে আইনের আওতায় আসে না। তবে, ধরেন সব ঠিকমতো চলল, ধর্ষণের মামলাও পুলিশ নিলেন, কিন্তু তারপর কে দেবে ধর্ষিতা এবং সাক্ষীদের প্রাণের নিরাপত্তা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেস সেখানেই একটি অন্ধগলি খুঁজে পায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে ‘ভিক্টিম অ্যান্ড উইটনেস প্রেটেকশন অ্যাক্ট’-এর কথা বলা হয়েছিল তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আর আমরা বলি সামাজিক সচেতনতার কথা। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ধর্ষককে বিচারের আওতায় না এনে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্ষককে নিরাপদ রেখে, ডাক্তারি পরীক্ষায় মিথ্যে রিপোর্ট তৈরির সুযোগ করে দিয়ে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অসদাচরণ করার মদদ দিয়ে শুধু সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই মহামারি থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা কি সফল হবে?
আমরা কেবল শুনি, কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাই, কিন্তু ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী আন্দোলনের মতো আন্দোলন বারবার ঘটাতে চাওয়া স্বপ্নই বটে। এখন সত্যিকার অর্থে যা হয়, তা হলো মিলান কুন্ডেরার ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এর মতো... ‘বোহেমিয়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশে আইয়েন্দেকে বন্দী করার ক্ষোভ দ্রুত চাপা পড়ল, তারপর বাংলাদেশের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবরে বন্দী আইয়েন্দের কথা মানুষ ভুলেই গেল, এরপর সাইনাই মরুর যুদ্ধের ডামাডোলে বাংলাদেশের ভয়ানক আর্তনাদ গেল মিলিয়ে, অথচ ক্যাম্বোডিয়ার ভয়াবহতা ভুলিয়ে দিল সাইনাইয়ের কথা, আর তারপরে এভাবেই চলল, চলতেই থাকল, যতক্ষণ না সবাই সবকিছু পুরোপুরি ভুলে যায়।’ আমাদের সঙ্গেও তাই হবে, একের উপরে আরেক নাম জমা হবে, আমরা আগের নামটা ভুলে যাবো, গা-সহা হয়ে যাবে সব, সইতে সইতে ভুলে যাবো।
‘আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনো স্বপ্ন দেখ, এখনো গল্প লেখ, গান গাও প্রাণভরে...’ আমারও আছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’-র মতো স্বপ্ন এক :
শুধু একটি দিন ধর্ষণের আশঙ্কার বাইরে কাটাবো। মৃত্যুর আগে অন্তত একটি মাত্র দিন; জানবো কোথাও ধর্ষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। ভরা সন্ধ্যায় যে কোনো ঘাসে গা এলিয়ে দেব, মধ্যরাতে একা একা তারা দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরব... জানবো, আমার পৃথিবী আমার রাজ্য।