সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৬

ক্রিকেটের বিস্ময়-বালক মিরাজ ঘুমের মধ্যেও খেলতেন  



ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজকে যশোর বিমানবন্দরে আদরের আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছেন আপ্লুত পিতা মোহাম্মদ জালাল হোসেন 

শেখ আল-এহসান, খুলনা

‘ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। ক্রিকেটটা ছিল ঘুমের মধ্যেও। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘মা মা জানালা আটকাও, ক্যাচ ধরো, ক্যাচ ধরো।’ এভাবেই ছেলে মেহেদী হাসান মিরাজের ক্রিকেট-পাগলামির কথা বলছিলেন মা মিনারা বেগম।

গণমাধ্যম এড়িয়ে চলা মিনারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় মিরাজের ছোট বোন রুমানা আক্তারের সহায়তায়। দুজন মিলেই জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই মিরাজ অনেক শান্ত। কখনো কারও কথার অবাধ্য হতো না। পড়াশোনায়ও ছিল ভালো।’ তবে বাবাকে খুব ভয় পেতেন মিরাজ। এ কারণে বাবা বাড়ি ফেরার আগেই বাড়ি আসতেন। বাবা খেলা পছন্দ করতেন না, তাই বাবার কাছে কখনো ছেলের খেলা নিয়ে নালিশ করেননি মা। বরং সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছেন।

আর বোনের চোখে মিরাজ সারা বিশ্বের মধ্যে সেরা ভাই। ভাইবোনের বয়সের ব্যবধান তিন বছর। মাঝেমধ্যে দুজনের ঝগড়া লাগলেও সেটা সাময়িক। মাঝেমধ্যে একে অপরের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ নয়। মিরাজই আগবাড়িয়ে কথা বলতেন বলে জানান রুমানা।
ছোট বোন রুমানা আক্তারের সঙ্গে ‘বীর’ মিরাজ। বোনের চোখে মিরাজ ‘পৃথিবীর সেরা ভাই।’
 মিরাজের খেলা-সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং বড় ডায়েরির আকারে যত্ন করে বাঁধাই করে রেখেছেন বোন। একপর্যায়ে সেটি বের করে দেখান। রুমানার কাছ থেকেই জানা যায়, মাঝেমধ্যে ভাইবোন মিলে খাটের ওপর পাখা দিয়ে ক্রিকেট বল খেলতেন। প্রায়ই তাঁদের রেসলিং রূপ নিত সত্যিকার মারামারিতে। এ নিয়ে থাকত অভিমানও। মা কখনো ভাইবোনের এসব ব্যাপার নিয়ে বকাবকি এমনকি বাবার কাছেও নালিশ করতেন না।

মিরাজের জন্ম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামে। জন্মের তিন বছর পর ২০০০ সালে চাকরির জন্য পরিবার নিয়ে খুলনায় বসবাস শুরু করেন মিরাজের বাবা মোহাম্মদ জালাল হোসেন। এরপর তাঁদের সবকিছু খুলনাকেন্দ্রিক। বর্তমানে থাকেন খালিশপুরের বিআইডিসি সড়কের দক্ষিণ কাশিপুর এলাকায় ভাড়া বাড়িতে। মিরাজের খেলাধুলার হাতেখড়িও সেখানেই।

গত রোববার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের পর সাংবাদিক আর মানুষের ভালোবাসার ‘অত্যাচারে’ অনেকটা ক্লান্ত মিরাজের পরিবার। তারপরও হাসিমুখেই সবার সঙ্গে কথা বলছেন তাঁরা। সঙ্গে চলছে মিষ্টিমুখ।

মিরাজের বাবা পেশায় ছিলেন একজন গাড়িচালক। বর্তমানে অসুস্থতার কারণে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ক্রিকেট খুব বেশি ভালো বোঝেন না। আর মা গৃহিণী। আর্থিক অনটনের সংসার। তাই বাবা চেয়েছিলেন ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় সরকারি চাকরি করবেন। গানের প্রতি আগ্রহ থাকায় মিরাজকে বানাতে চেয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পীও। তাই ছেলের খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকাটা খুব ভালো চোখে দেখতেন না তিনি। খেলার ‘অপরাধে’ মিরাজকে অনেক মারধরও করেছেন তিনি।

বাবা মিরাজের খেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন যখন মিরাজ অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলার সুযোগ পান। তারিখটা মনে না থাকলেও মিরাজের বাবা বলেন, ‘মিরাজ যখন অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলার সুযোগ পেল, তখন সে যে একাডেমিতে খেলত ওই একাডেমির প্রশিক্ষক আল মাহমুদ আমাকে একটি পত্রিকা নিয়ে এসে মিরাজের সুযোগ পাওয়ার কথা জানান। পত্রিকায় সেটা দেখে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।’

এ কথা বলতে বলতেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মিরাজের বাবা। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নেন। আবার শুরু করেন, ‘পত্রিকায় ওই খবর দেখার পর আর মিরাজকে খেলা নিয়ে কখনো কিছু বলিনি। বরং উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’

মিরাজ তাঁর বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতেন। খেলার সরঞ্জাম রেখে আসতেন কোনো বন্ধুর বাসায়। বাবা বাড়ি আসার আগেই বাড়ি ফিরে বসে যেতেন পড়তে।

দক্ষিণ কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর এসএসসি পাস করেছেন ওই এলাকারই নয়াবাটি হাজী শরীয়তউল্লাহ বিদ্যাপীঠ থেকে। আর চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন দৌলতপুর দিবা-নৈশ কলেজ থেকে।

মিরাজের ক্রিকেট খেলার আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমি থেকে। এখনো ওই একাডেমির অধিনায়ক তিনি। ওই ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষক মোহাম্মদ আল মাহমুদ বলেন, ‘আট বছর বয়সে এলাকার রাসেল নামের একটি ছেলের হাত ধরে একাডেমিতে আসে মিরাজ। ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ আর প্রচণ্ড খেলোয়াড়ি মনোভাব ছিল তার। নির্দেশনাও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের মিরাজকে মাঝেমধ্যে ওর বাবা খেলার মাঠ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করতেন। এত প্রতিবন্ধকতার পরও খেলা থেকে এতটুকু পিছপা হয়নি মিরাজ। আজ তারই ফল পাচ্ছে সারা বাংলাদেশ।’

খালিশপুর বিআইডিসি সড়কের দক্ষিণ কাশিপুর এলাকার যে গলি দিয়ে মিরাজদের বাড়িতে ঢুকতে হয়, সেটি দিয়ে রিকশাও যেতে পারে না। টিনের চালার ওই ভাড়া বাসায় মাত্র দুটি কক্ষ। এরই একটি ঘরের শেলফের ওপর ও মধ্যে সারি সারি সাজানো রয়েছে নানা জায়গা থেকে পুরস্কার পাওয়া তাঁর ট্রফিগুলো। দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো মেডেল। এগুলোই যেন ভাঙা ঘরে চাঁদের আলোর মতো ঠিকরে জানান দিচ্ছে আগামী দিনের ক্রিকেটে আরও কিছু দেওয়ার প্রত্যয়।

প্রথম আলো’র সৌজন্যে

রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

পুরনো ক্ষতগুলো জানান দিয়ে যায় 

পল বিটিরয়টার্স পেলেন এবারের ম্যান বুকার পুরস্কার৷ তাঁর লেখার গভীরে ঢুকতে হলে রপ্ত করতে হবে তির্যক চোখের দৃষ্টিকোণ৷ কালা আদমির দুঃখ দুর্দশা পুনর্নির্মাণ করতে শুধু চাবুক আছড়ানোর আওয়াজ আর পায়ে কবজিতে শেকলের ঘষায় কাঁচা মাংস বেরিয়ে দগদগে ঘায়ের বর্ণনা নয়, প্রাণ খুলে বেপরোয়া অথবা আড়ালে মুচকি হেসে ওঠাও সমান জরুরি সেটা পল বিটি মনে করিয়ে দেন৷

 

অমিতাভ মালাকার


পল বিটির জন্ম আমেরিকায়, ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলিস-এ , ১৯৬২ সালে৷ ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসটির জন্য তাঁকে প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে ম্যান বুকার প্রাইজ দেওয়া হয়েছে এ বছর৷ ওঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বয় শাফল্’ সাহিত্যকীর্তি হিসেবে’ ৯৬-’৯৭ নাগাদ পাঠক মহলে যথেষ্ট আদৃত এবং প্রশংসিত হয়েছিল, এবং রিচার্ড বার্নস্টাইনের বক্তব্য অনুযায়ী সেটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রাত্যহিকতার খঁুটিনাটি কাঁচিয়ে কুড়িয়ে মার্কিন জীবনের দুর্ধর্ষ একটি ব্যাঙ্গাত্মক দলিলও বটে --- যদিও, ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় টিকে থাকার লড়াইটিতে যেহেতু উত্পাদিত পণ্যগুলি অসীম ক্ষুধায় শেষে নিজেই নিজেকে খেতে বাধ্য থাকে , তাই , অন্য সব বিনিময় -যোগ্য পসরার মতোই সে দলিলকেও তামাদি প্রমাণ করে আরও নতুন , আরও ঝকমকে ঝলমলে মোড়কে মলাটে জড়ানো জীবন -বোধের দস্তাবেজে বাজার ভরিয়ে তুলতে হয় প্রতিনিয়ত৷

এহ বাহ্য৷ পল বিটি নিজের লেখার পাশাপাশি আফ্রিকান -আমেরিকান রসসাহিত্যের একটি সঙ্কলন সম্পাদনা মারফত অনেক তামাদির মাঝে কয়েকটি স্বর টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে আমাদের ওয়াকিবহাল করেন, সেটা ২০০৬ --- ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস্’-এ তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধও ছাপা হয়েছিল ওই বিষয়ে৷ ‘ওই বিষয়টি’ আদতে কালো মানুষদের দাসত্ব সংক্রান্ত , ক্রমান্বয়ে যেটিকে খুঁচিয়ে চলতে হয় যাতে বিস্মৃতির অন্তরালে ঘাপটি মেরে থাকতে থাকতে শেষে এক সময় তার অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন না হয়ে পড়ে --- অস্তিত্ব বলতে সমকালীন ইতিহাসে , প্রতি দিনকার বাঁচা মরায় তার ছায়া ছাপ৷ বিটি ঠাট্টা মশকরায় ওই যোগাযোগটিকে টিকিয়ে রাখেন৷ কালা আদমির দুঃখ দুর্দশা পুনর্নির্মাণ করতে শুধু চাবুক আছড়ানোর আওয়াজ আর পায়ে কবজিতে শেকলের ঘষায় কাঁচা মাংস বেরিয়ে দগদগে ঘায়ের বর্ণনা নয়, প্রাণ খুলে বেপরোয়া অথবা আড়ে আড়ালে মুচকি হেসে ওঠাও সমান জরুরি , পল বিটি মনে করিয়ে দেন৷

তাঁর এই উপন্যাসটি মোট আঠেরো জন প্রকাশক ছাপার অযোগ্য বিবেচনাপশ্চাত্ ফিরিয়ে দেন৷ ‘তবে কি তাঁরা ভেবেছিলেন যে বইটা বিক্রি হবে না?’--- এমন সন্দেহ বিটির মনেও দানা বাঁধে৷ সেটা অস্বাভাবিক নয়৷ বিটি যে ধরনের রসসৃষ্টি করেন , তাতে হেসে ওঠার পাশাপাশি তির্যক দৃষ্টিতে সব কিছুকেই দেখার অভ্যাস ওঁর উপন্যাসের দুই মলাটের ভিতর যতক্ষণ বাস , ততক্ষণ স্বাভাবিক একটি পাঠ -কৌশল , অন্তত রসিকতার প্রাথমিক স্তরটি পেরিয়ে পাঠোদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই৷ পাঠককে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বিটির কৌশল খানিকটা রন্ত করতে হয় , অবশ্য অ্যাফ্রো -আমেরিকান লেখকদের পড়ার অভ্যাস যাঁদের আছে, এটা তাঁদের রক্তে মিশেছে অনেককাল৷ বিটি কেবল এই অভ্যাসটাকে কাজে লাগিয়েছেন পাঠের রাজনীতির সঙ্গে পাঠকের রাজনৈতিক বিশ্বাস অবিশ্বাস দ্বন্দ্ব তৈরির কাজে৷ এটাও যে খুব নতুন অভিনব কিছু তাও নয় , ঠিক ওই ঠাট্টা ব্যঙ্গের মতোই --- তাই হয়তো মজা করেই রোমন্থন --- ‘সম্পাদকরা যখন বলেন যে লেখাটা ভালো হওয়া সত্ত্বেও বইটা করা গেল না , তখন আমি বেশ ব্যথিত হই… খানিকটা রোমান্টিসাইজ করতেই ফিরে যাই হার্লেম রেসেসাঁসের কালে যখন শোনা যেত কেউ বলছেন বইটা বিকোবে না ঠিকই , তবে তোমার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে৷’ কোথাও যেন লেখা , ছাপাই , কেতাবের ব্যবসা , লেখক, লেখা ছাপানোর লড়াই , বাজার , কাটতি , লাভ , লোকসান, কালো লেখক , সাদা বাজার সবটা মিলেমিশে গেছে --- মিলেমিশে আছে তাঁর পুরস্কার পাওয়া বইটির সঙ্গে , ‘কম দামি’ প্রকাশকের আস্থা প্রকাশে , সাদা বাজারে কালো মানুষের ব্যঙ্গাত্মক ঠাট্টা ইয়ার্কির পসরা সাজিয়ে ‘আয় ভাই, একবারটি কিনে পড়ে দেখ’ বলার মধ্যেও৷

আলাদা করে অনৈতিহাসিক কোনও প্রেক্ষিতে নিজেকে এবং উপন্যাসগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করে , ইতিহাস -বিচ্ছিন্ন এক লেখক ইতিহাস-বিমুখ পাঠকের কলা কৈবল্যবাদী অভিসন্ধিগুলিকে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য এ লেখা লিখছেন না সেটা পরিষ্কার , বরং তাঁদের টেনে আনছেন লড়াইয়ের এক দুনিয়ায়৷ পাঠক তার পর কী ভাবে সবটার মোকাবিলা করেন নিজের জীবনের সঙ্গে লেখা এবং কালো মানুষদের লেখার ইতিহাসের টুকরোটাকরা জুড়ে বা লেখাগুলিকে কোন কায়দায় আপন আপন মগজে সস্তা চুটকির পর্যায়ে নামিয়ে আনেন সেটা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যাপার৷ অস্বস্তি একটা কাজ করে বিটির লেখা পড়ার সময় , তার খানিকটা রেশও থেকে যায় অনেকটা ওই নিনা সিমোনের গানের মতো , ভালো লাগা আর বেদনার একটা বোধ মিলে মিশে যায়, বাজনার তালে সুরে শরীর দুলে উঠলে পুরনো ক্ষতগুলো ফের একবার জানান দিয়ে যায় --- আছি ভাই৷

দৈনিক এই সময়, কলকাতা, ভারত

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী ড. শফিকুল ইসলামের প্রিন্স সুলতান পুরস্কার লাভ

ড. শফিকুল ইসলাম, টাফটস ইউনিভার্সিটি ড. রিতা কলওয়েল, ইউনিভার্সিটি 
অব  মেরিল্যান্ড


স্টার অনলাইন রিপোর্ট

প্রিন্স সুলতান পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী। কলেরা রোগের পূর্বাভাস সংক্রান্ত গবেষণার জন্য প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ড. রিতা কলওয়েল ও টাফটস ইউনিভার্সিটির ড. শফিকুল ইসলাম।

পানিবাহিত রোগ কলেরা নিয়ে গবেষণার জন্য প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুলআজিজ আন্তর্জাতিক সৃজনশীল পুরস্কার (পিএসআইপিডব্লিউ) পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী ড. শফিকুল ইসলাম ও তার দল।

ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ড. রিতা কলওয়েল ও টাফটস ইউনিভার্সিটির ড. শফিকুল ইসলাম কলেরার রোগের পূর্বাভাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা এমন একটি মডেল তৈরি করেছেন যা স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ক্লোরোফিল তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করে। এর মাধ্যমে তিন থেকে ছয় মাস আগেই কলেরার পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব।

গত ৫ অক্টোবর সপ্তম বারের মতো প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুলআজিজ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পিএসআইপিডব্লিউ’র ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, আগামী ২ নভেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।

বাংলাদেশে কলেরা ছড়ানোর সম্ভাবনা বিচার করতে তারা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ক্লোরোফিল সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে গবেষণা করেন। তারা এখন ভূপৃষ্ঠ থেকে সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখছেন।

একটি ব্যক্তিগত ইমেইলে শফিকুল ইসলাম জানান, পুরস্কার পাওয়ায় সম্মানিত ও আনন্দ বোধ করছেন তিনি।

ডেইলী স্টার

এনআরবিসি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগে অর্থমন্ত্রীর হুমকি 

চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের পক্ষে-বিপক্ষে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু

ভালো নেই ‘এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড’। ২০১৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরুর তিন বছরের মাথায় ব্যাংকটির পরিচালকরা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন; একে অন্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনছেন। চেয়ারম্যানের পক্ষে রয়েছেন কয়েকজন পরিচালক। অন্য পক্ষে রয়েছেন, আরেকদল পরিচালক। এখানে দলবাজি অনেকটা চরমে উঠেছে। তারা একে অন্যকে অপসারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ধরনা দিয়েছেন। আর এতে করে ব্যাংকটির সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ঘোরতর শঙ্কা ব্যক্ত করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে বলা হয়েছে-‘পরিচালকরা এভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে ব্যাংকটির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে এবং আমানতকারী ব্যাংকটির ওপর আস্থা হারাবে।’ স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগ করা যেতে পারে’। ব্যাংকিং বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিাল ব্যাংক সূত্রে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন পক্ষ থেকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে বিভিন্ন অনিয়মের খবর অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এসব বিষয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গোচরীভূত করা হয়। পরে অর্থমন্ত্রী এই ব্যাংক সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংককে গোপন পরিদর্শন কাজ পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এই গোপন পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন করে তা অর্থমন্ত্রী ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিবের কাছে প্রেরণ করে।

জানা গেছে অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকিং বিভাগ থেকে পাঠানো এই ব্যাংকের ওপর পরিচালিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিদর্শনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরাসত আলী কর্তৃক পাঁচজন পরিচালকের বিরুদ্ধে আনীত ঋণ ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগগুলো পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে, বিকল্প পরিচালক এ এম সাইদুর রহমান ও এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান ভলান্টারি অর্গানাইজেশন ফর সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট (ডিওএসডি) নামক এনজিও-এর নামে ব্যাংকটি থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন। যার পরিদর্শনকালে স্থিতিশীল ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আবার উদ্যোক্তা পরিচালক মো: আদনাম ইমাম অরনিতা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের নামে বরিশালের উজিরপুরের কৃষিভিত্তিক প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকটি থেকে তিন কোটি টাকা (পরিদর্শনকালে স্থিতি দুই কোটি ৯২ লাখ টাকা) ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজেই সেই ঋণের সুবিধাভোগী হয়েছেন। ফলে তদন্তকালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের অভিযোগে বর্ণিত ঋণ হিসাবসমূহের সর্বসাকুল্য আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ব্যাংকিং বিভাগ থেকে আরো বলা হয়েছে,‘ বর্ণিত ঋণ হিসাবসমূহ সরাসরি ব্যাংকের পরিচালকদের নামে না হওয়ায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রদত্ত ঋণসমূহ ব্যাংকের পর্ষদ/পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটি কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত হওয়ায় আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে উল্লিখিত পরিচালকদেরক অপসারণের পদক্ষেপ নেয়া এ পর্যায়ে সমীচীন হবে না বলে পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য দিকে অভিযুক্ত পরিচালকরাও বিকল্প পরিচালক সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তার দলভুক্ত অন্যান্য পরিচালকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে বেশ কিছু গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। তবে এই অভিযোগ সময়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। ’

এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকিং সচিব মো: ইউনুসুর রহমান একটি নোট দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘ব্যাংকের পরিচালকরা (এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক) এভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে ব্যাংকটির পরিচালনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে এবং আমানতকারীরা ব্যাংকের ওপর আস্থা হারাবে। একটি নতুন ব্যাংক হিসেবে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী অবস্থান কাম্য নয়। সার্বিক বিবেচনায় বিদ্যমান পরিচালকদের কোনো ধরনের অনিয়মে না জড়িয়ে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যাংক পরিচালনায় মনোনিবেশ করার জন্য অর্থমন্ত্রী মহোদয় কর্তৃক পরামর্শ প্রদান যথাযথ হবে। ’

এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রী একটি নোট দিয়েছেন। তিনি তাতে উল্লেখ করেছেন, ‘পরামর্শ দেয়া যেতে পারে, তবে এর অন্তর্দ্বন্দ্ব তাতে প্রশমিত হবে বলে মনে হয় না। আমি বোর্ডের সদস্যদের ডাকতে পারি। তবে কিভাবে এর সুরাহা হবে তা স্পষ্ট নয়। প্রশাসক নিযুক্তির হুমকি দেয়া যায়, তা হলে হয়তো তাদের সম্বিত ফিরতে পারে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এনআরবি কমার্শিয়ালসহ সব ব্যাংকই আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। তাই কোনো ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে যদি আমানতকারী বা ব্যাংকিং কার্যক্রমে সমস্যা হয় তাহলে আমরা আইন অনুযায়ী তা কঠোরভাবে দমন করব। এ ব্যাপারে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই আসে না।

অন্য দিকে, ব্যাংকিং বিভাগ থেকে জানা গেছে, এই ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

দৈনিক নয়া দিগন্ত,  রোববার, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬

স্বপ্ন এক: শুধু একটি দিন ধর্ষণের আশঙ্কার বাইরে কাটাবো

আফসানা বেগম


একের পরে এক নাম জমা হয়, ইয়াসমিন, সীমা, রিমা, নূরজাহান, হেনা, তনু কিংবা আফসানা, আরো কত... এবারে এক গৃহবধু। নামের স্তূপের দিকে তাকিয়ে বুঝি না কাকে ছেড়ে কার জন্য কতদিন শোক করব, অলিম্পিকের মনোগ্রামের মতো একের উপরে আছড়ে পড়ে আরেকটি শোকের বৃত্ত; তারপর একাকার হয়ে যায়, কোনো শোক থেকে কোনো শোককে আলাদা করা যায় না, নিজস্ব দুর্ভাগ্যের মতো বিরামহীন বাজতে থাকে।

একটা সময় থাকে যখন ধর্ষণের ধারণা জন্মায় না। তবে এখন জানি সে সময়টাতেও সুযোগ পেলে রেহাই দেয় না কেউ। কিন্তু তখন তো জানতাম না। তখন আমরা কানে সোনার দুল পরতাম, গলায় চেইন। ছোট্টকালে কান ফুটিয়ে মায়েরা আদর করে পরিয়ে রাখতেন। একদিন জানা গেল ওইটুকু সোনার জন্য খুন হয়ে যাচ্ছে। পাহারায় কতক্ষণ আর, মা খুলে নিলেন সব। অলঙ্কারকেই প্রথম শত্রুজ্ঞান করলাম। অথচ ধারণা বদলে দিল নীহার বানু। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে রাজনৈতিক ছাড়া সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল যার হত্যাকাণ্ড, তিনি নীহার বানু। প্রেমের প্রস্তাব উপেক্ষা করায় মিথ্যে বলে ডেকে এনে ধর্ষণের পরে তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও পুঁতে দেয়া হয়েছিল। অনেক পরে মাটি খুঁড়ে কঙ্কাল উদ্ধার হয়। বাসায় যেদিন প্রচ্ছদে নীহার বানুসহ বিচিত্রা এসেছিল, সেদিন অভিনব আতঙ্ক দেখেছিলাম বাড়ির লোকদের চোখেমুখে। আর সেটা পরিষ্কার করে বোঝার পরে কখনো এমন কোনো দিন কি এসেছিল যে ধর্ষিত হবার আশঙ্কা হয়নি? শরীরের অপরিহার্য অঙ্গের মতো এই ভয় সাথে থাকে, দিনে-রাতে-ব্যস্ততায়-অবহেলায় কখনো ছাড়ে না, কিছুতে ছাড়ে না। এই দেশ হলো সেই দেশ যেখানে একজন একশ’টি ধর্ষণশেষে উৎসব করে। একসময় ভাবতে চেষ্টা করতাম ধর্ষকের মুখ কেমন হতে পারে, তার চলাফেরা দেখেই বুঝি তাকে চেনা যাবে? তাকে সাধারণ ভাবতে কিছুতে মন সায় দিত না। কী করে দেবে, বন্ধু আছে, ভাই আছে, আত্মীয় আছে, তাদেরে উপরে আস্থা আছে... ধর্ষক কি কখনো তাদের মতো হতে পারে! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের সঙ্গে একই ক্লাসরুমে প্রায় এক বছর কাটানোর পরে যখন জানলাম তার একশ’ ধর্ষণপুর্তির উৎসবের কথা, তখন আর সন্দেহ থাকল না যে ধর্ষক মিশে আছে সবখানে। তারপর ‘তাই হেরি তায় সকলখানে’ ভাবটা প্রকট হলো কেবল।

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নারী আন্দোলনের কর্মী এবং আইনজ্ঞরা লড়াই করেছেন, প্রতিবাদ হচ্ছে রাস্তায়, সভায়, লেখায়, কিন্তু কোথাও কিছু বন্ধ হচ্ছে কি? একের পর এক ধর্ষণ হচ্ছে, কদিনেই ধর্ষণটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটা কেসস্টাডি। আমাদের প্রত্যাশা কেসস্টাডির কক্ষপথ ধরে ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে কিছুই পাচ্ছে না। কিছুই পাচ্ছে না তা অবশ্য ঠিক নয়, সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশ কেমন দুর্বল রিপোর্ট দেন, তদন্তকারী ডাক্তার অনায়াসে আঘাতের চিহ্ন গোপন করে মিথ্যে রিপোর্ট তৈরি করেন, ‘forceful sexual intercourse’-এর জায়গায় কী করে ‘habituated’ লেখা হয়, আলামত নষ্ট করে কোনোভাবে কী করে অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টায় সফলতা আসে, এইসব তো শেখা হয়েছে!

জানি না কেউ একে মহামারি জ্ঞান করেন কি না, হিসাবটা এরকম, শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিসে সেন্টারে(ওসিসি) দিনে চার থেকে পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে সেবা নিতে আসেন। প্রতিমাসে সংস্থাটি গড়ে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিত নারীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। এখন খানিক চুপ করে ভাবুন, সারা দেশে তবে দিনে বা মাসে কত নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। সঙ্গে এটাও জানুন যে ‘সামাজিক লজ্জা’কে জয় করে যারা চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না, তাদের হিসাব এখানে নেই। তাছাড়া, মাঝখানে বিরাট এক বাধা হলো চিকিৎসা সেবা পেতে হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের আগে যেতে হবে পুলিশের কাছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের সহায়তা বা উপস্থিতি ছাড়াও কর্তব্যরত চিকিৎসকের প্রতি ভিক্টিমকে চিকিৎসা দেবার নির্দেশ আছে, কিন্তু বাস্তবে তা হতে দেখা যায় না। একই বিষয় মামলার ক্ষেত্রেও, মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে থানায় গেলে ধর্ষণের মামলা নেয়া হয় অথচ একা গেলে প্রায়ই নেয়া হয় না, যেমন, ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৬৩ ভাগ ধর্ষণের শিকার নারী একা মামলা করতে গেছেন দেখে পুলিশ তা গ্রহণ করেননি। বিচারের কথা যে বলব, এটুকু কি পরিস্কার না যে বিচার পাওয়া তো দূরের কথা ধর্ষণের শিকার এক নারীর জন্য বিচার চাওয়াটাও কত কঠিন?

এদেশে পুলিশ হেফাজতে, হাসপাতালে, উপাসনালয়ে, রাস্তায়, বিদ্যালয়ে, অফিসে, বাড়িতে, দোকানে, বাজারে, জলপথে, কোথায় ধর্ষণ হয়নি! কিন্তু আইনের চোখে বিচার চাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলে প্রথমে তা প্রমাণ করতে হবে, মানে, অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব ভিক্টিমের এবং সাক্ষীও লাগবে। আচ্ছা, কেউ কি সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করবে? সে কথা থাক, প্রমাণের নামে অবান্তর প্রশ্নবাণে তাকে বারবার মৌখিকভাবে ধর্ষণ করা হবে। ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা থেকে শুরু করে তার অতীত যৌনাচরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে। ধর্ষক নয়, মানসিক নির্যাতন করা হবে ধর্ষিতাকে। কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞগণ কিছুই বলতে পারেন না, ভিক্টিম যৌনকাজে অভ্যস্ত কি না, হাইমেন ভঙ্গুর কি না এসব প্রমাণের জন্য প্রাচীন(১৮৭২ সালের) ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ যথেষ্ট নয়। এরপর আসামীকে বাঁচানোর নানারকম চাপ তো তাদের উপরে আছেই। তবে একমাত্র ইয়াসমিন ধর্ষণ মামলা ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে মিথ্যে রিপোর্টের জন্য শাস্তি হতেও শোনা যায়নি। কারণ তখন ঘটনাটা সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। অন্য সব ধর্ষণের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা, হা-হুতাশ চলছে, কিন্তু এ ব্যাপারে ধারাবাহিক কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। এখন কথা হলো, প্রতিটি ধর্ষণের সুবিচার চাইতে কি মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে, গুলি খেয়ে অন্তত সাতজনকে মরতে হবে দিনাজপুরের দশমাইলের আন্দোলনের মতো?

বিচার চাইলে আমরা অনেকে কথা ঘোরাই, মেয়েটা ওই সময়ে ওখানে কী করছিল? জাহাঙ্গীরনগরে ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনার পরে অনেকে পত্রিকায় এরকম কথা লিখেছিলেন। এখনো বেশিরভাগ মুক্তমতের ব্লগে দেখা যায় ধর্ষণের আলোচনার ক্ষেত্রে নব্বই শতাংশ মতামত ধর্ষিতার বিপক্ষে; তার পোশাক, তার ভঙ্গি, তার জীবনাচরণ, এসব নিয়ে খোলাখুলি নিন্দার উৎসব চলছে; ধর্ষিতাও সমান দায়ী কিংবা ধর্ষিতাই দায়ী। আচ্ছা, ধরেন, আপনি একটা দামি গাড়ি কিনলেন। রাস্তায় বেরোতেই গাড়িটা ছিনতাই হয়ে গেল। পুলিশে রিপোর্ট করতে গেলে পুলিশ বলল, আপনি গাড়ি কিনেছেন ভালো কথা, রাস্তায় বের করতে গেলেন কেন? সুতরাং এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় আপনারও হাত আছে। আবার ধরেন, গাড়ি বাড়ির পোর্চ থেকে চুরি হলো। আমি বললাম, গাড়িটা আপনি কিনলেন কেন? আর খোলা ফেলে না রেখে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বেডরুমে তালা দিয়ে রাখলে তো আর এমন হতো না!

কিন্তু বেডরুমও কি আসলে নিরাপদ? মোল্লারহাটের জনৈক মোল্লা যখন তলোয়ার দেখিয়ে বাড়িভর্তি মানুষকে বন্দী করেছে আর নিজেরই বাড়িতে গৃহবধুকে ধর্ষণ করেছে, তখন আমরা বলি সংখ্যালঘু হবার কথা, এলাকায় মোল্লার মূর্তিমান আতঙ্ক হবার কথা। অবশ্যই সত্য। আবার অভিজাত এলাকায় প্রভাবশালী বাবার কন্যাকেও কি নিজ বেডরুমে ধর্ষিত হতে হয়নি? তাদেরও যখন দেখি বছরের পর বছর বিচারের জন্য হাপিত্যেশ করছেন, তখন বিষয়টা ভয়াবহ, যেন পুরো দেশ ধর্ষকের অভয়ারণ্য। শুধু এদেশ কেন, পাশের দেশে যাই, ধর্ষণ সাধারণ ব্যাপার সেখানে। কয়েক বছর আগে ভারতে একটি গণধর্ষণের সময়ে তিনজন মানুষ পাশের রাস্তা ধরে যেতে গিয়ে নিজেরাও ধর্ষণে অংশগ্রহন করে ফেললেন। বিষয়টা কি এতটাই জৈবিক যার কাছে মনুষত্ব পুরোপুরি হার মেনে যায়? দিল্লীর বাসে ধর্ষণের ঘটনার মাত্র বারোদিন আগে সেখানকার পার্লামেন্টে বিল উঠেছিল, বিবাহিত মহিলাদের যে কোনো সময়ে তাদের স্বামীরা যৌনকাজে বাধ্য করতে পারবে। সেরকম বেডরুমগুলোর কোনো হিসাব কারো কাছে থাকে না। মনুষত্ব কোথায় খুঁজব, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশের কথাও যদি ধরি, সিডনি হেরাল্ড পত্রিকায় সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘঠিত একটি ধর্ষণের রিপোর্ট অনুসরণ করছিলাম মাস চারেক আগে। শাস্তি হওয়ায় তরুণ ধর্ষকের বাবা আদালতে চিৎকার করে বললেন, মাত্র বিশ মিনিটের একটা কাজের জন্য আমার ছেলেকে সাত মাস জেলে থাকতে হবে?

ভালো কথা, ধর্ষকদের উপরে করা ইউনাইটেড নেশন মালটি কান্ট্রি স্টাডি-র এক সমীক্ষায় নানান চমকপ্রদ তথ্যের মধ্যে এ-ও দেখলাম যে ৬১.১ শতাংশ বাংলাদেশি ধর্ষক ধর্ষণের পর এতটুকু মানসিক অনুশোচনায় ভোগে না এবং ৯১.১ শতাংশ ধর্ষক ধর্ষণের পরে আইনের আওতায় আসে না। তবে, ধরেন সব ঠিকমতো চলল, ধর্ষণের মামলাও পুলিশ নিলেন, কিন্তু তারপর কে দেবে ধর্ষিতা এবং সাক্ষীদের প্রাণের নিরাপত্তা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেস সেখানেই একটি অন্ধগলি খুঁজে পায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে ‘ভিক্টিম অ্যান্ড উইটনেস প্রেটেকশন অ্যাক্ট’-এর কথা বলা হয়েছিল তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আর আমরা বলি সামাজিক সচেতনতার কথা। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ধর্ষককে বিচারের আওতায় না এনে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্ষককে নিরাপদ রেখে, ডাক্তারি পরীক্ষায় মিথ্যে রিপোর্ট তৈরির সুযোগ করে দিয়ে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অসদাচরণ করার মদদ দিয়ে শুধু সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই মহামারি থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা কি সফল হবে?

আমরা কেবল শুনি, কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাই, কিন্তু ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী আন্দোলনের মতো আন্দোলন বারবার ঘটাতে চাওয়া স্বপ্নই বটে। এখন সত্যিকার অর্থে যা হয়, তা হলো মিলান কুন্ডেরার ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এর মতো... ‘বোহেমিয়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশে আইয়েন্দেকে বন্দী করার ক্ষোভ দ্রুত চাপা পড়ল, তারপর বাংলাদেশের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবরে বন্দী আইয়েন্দের কথা মানুষ ভুলেই গেল, এরপর সাইনাই মরুর যুদ্ধের ডামাডোলে বাংলাদেশের ভয়ানক আর্তনাদ গেল মিলিয়ে, অথচ ক্যাম্বোডিয়ার ভয়াবহতা ভুলিয়ে দিল সাইনাইয়ের কথা, আর তারপরে এভাবেই চলল, চলতেই থাকল, যতক্ষণ না সবাই সবকিছু পুরোপুরি ভুলে যায়।’ আমাদের সঙ্গেও তাই হবে, একের উপরে আরেক নাম জমা হবে, আমরা আগের নামটা ভুলে যাবো, গা-সহা হয়ে যাবে সব, সইতে সইতে ভুলে যাবো।

‘আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনো স্বপ্ন দেখ, এখনো গল্প লেখ, গান গাও প্রাণভরে...’ আমারও আছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’-র মতো স্বপ্ন এক :
শুধু একটি দিন ধর্ষণের আশঙ্কার বাইরে কাটাবো। মৃত্যুর আগে অন্তত একটি মাত্র দিন; জানবো কোথাও ধর্ষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। ভরা সন্ধ্যায় যে কোনো ঘাসে গা এলিয়ে দেব, মধ্যরাতে একা একা তারা দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরব... জানবো, আমার পৃথিবী আমার রাজ্য।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশে পৌঁছতেই বিস্মিত বিশ্ব, অগ্রগতি কল্পনার চেয়ে বেশি

ভারত-বাংলাদেশ অটুট বন্ধনে কোনও ফাঁক চান না হাসিনা


অমিত বসু

 গ্রিক পুরাণে বৈরিতা আর ঈর্ষার দেবতা জেলাস। বন্ধন ভাঙেন নিমেষে। দ্বন্দ্বের টানাপড়েনে উত্তেজনা বাড়ান। বিদ্বেষে দেশে দেশে মৈত্রী শেষ। ১৫ অক্টোবর গোয়ায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে তেমনটাই হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ব্রিকসের পাঁচটি দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন, দক্ষিণ আফ্রিকার সংহতি বজায় রাখাটা সহজ ছিল না। অলক্ষ্যে থেকে দেবতা জেলাস সেই চেষ্টা করে ছিলেন কি না জানা নেই। করলেও সফল হননি। হয়েছে বরং উল্টোটা। ব্রিকসের সঙ্গে জুড়েছেবিমস্টেকএর চারটি দেশ বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড। ভারতও সঙ্গে। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃপ্ত উচ্চারণ প্রমাণ করেছে বাঙালির দৃঢ়তা। সন্ত্রাসমুক্ত দেশ চান তিনি। উন্নয়নের পরিপন্থী শক্তিকে বরদাস্ত না করার অঙ্গীকার। একই ভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী। পাকিস্তানের নাম না করেও তাদের সন্ত্রাসের মাদার-শিপ বা সন্ত্রাসের ধাত্রীভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিন-রাশিয়া তাতে প্রত্যক্ষ সমর্থন না জানালেও বিরোধিতা করেনি।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাংলাদেশ, ভারত, চিনের প্রায় সমানে সমান। সাত থেকে সাড়ে সাত শতাংশ। বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশের ছবিটা উজ্জ্বলতর। ব্রিকসের জন্ম ২০০৯-এ। তখনও জ্বলে ওঠেনি বাংলাদেশ। ২০০৬ থেকে ঘোরতর সমস্যায়। নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা। ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি। ১২ জানুয়ারি তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফকরুদ্দিন আহমেদ। ২২ জানুয়ারি নির্বাচন স্থগিত। এক বছর ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। বহু প্রতীক্ষিত অষ্টম সাধারণ নির্বাচন ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর। বিপুল ভোটে জিতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে সময় তো লাগবেই। শান্তি ফিরতেই উন্নয়নের রানওয়েতে দৌড়। টেক অফ ২০১৪- জানুয়ারি নবম সাধারণ নির্বাচনে হাসিনার জয়ের পর। প্রত্যয়ী হাসিনা আর পিছন ফিরে তাকাননি। দেশের চেহারাটা দ্রুত বদলেছে। শিল্প, কৃষির প্রসার। উৎপাদনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রফতানি দ্বিগুণ। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি . থেকে শতাংশে পৌঁছতেই বিস্মিত বিশ্ব। অগ্রগতি কল্পনার চেয়ে বেশি। ব্রিকসের আবির্ভাব-মুহুর্তে বাংলাদেশের এই ছবিটা ফুটলে, সংগঠনে তাদের স্থান অবশ্যম্ভাবী ছিল। বর্তমানে বিমস্টেক আর ব্রিকস একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। বাংলাদেশের মর্যাদার আসন পাকা।

২০০১- অর্থনীতিবিদ জিম নিনের গবেষণায় ব্রিক শব্দটি উঠে আসে। বলা হয়, বিশ্বে জি- গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ জানাবেব্রিক ২০০৯-এর ১৬ জুন ব্রিকের চার দেশের প্রথম সম্মেলন। ২০১১তে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকে যোগ দেওয়ায় ব্রিকের সঙ্গে সাউথ আফ্রিকারএসটা যুক্ত হয়। ব্রিকের জায়গায় ব্রিকস। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ব্রিকসের যৌথ অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর অর্থনীতিকে ছাপিয়ে যাবে ২০৫০-এ।

বিশ্বের অর্ধেক মানুষের বাস ব্রিকসে। অর্থনীতির পরিমাণ ১৬৬ লক্ষ কোটি ডলার যা পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ। ব্রিকস যত বাড়বে দুনিয়া তত দারিদ্র মুক্ত হবে। এর মধ্যে ব্রিকসের সবচেয়ে বড় অবদান, বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এনডিবি স্থাপন। বছরই ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো গ্রিন এনার্জি বা দূষণহীন বিদ্যুতের বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ পেয়েছে ৯১ কোটি ডলার। সাংহাইয়ে ব্যাঙ্কের সদর দফতর আরও ডালপালা বিস্তার করেছে। পাঁচ দেশের মধ্যে ফ্রি ট্রেড চাইছে চিন। তাতে তাদের শ্লথ হয়ে আসা অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হবে। বিশ্বের অন্যতম তেল ভাণ্ডার রাশিয়ায়। তেল, গ্যাসের দাম ৫৫ শতাংশ পড়ে যাওয়ায় তারা সংকটে। বিশ্ববাজারে পণ্য সামগ্রীর মূল্য কমায় আতান্তরে ব্রাজিল। সেই সূত্রে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। সংসদীয় অভ্যুত্থানে দিলমা রুসেফকে হঠিয়ে অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মাইকেল তেমার। রিও অলিম্পিকের পরেও ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত নেই। তুলনায় বাংলাদেশ-ভারতের অর্থনৈতিক জোর অনেক বেশি। হাসিনা-মোদী বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার শপথ। তিস্তা চুক্তি নিয়ে হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন মোদী। হাসিনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারত হাতে হাত রেখে চলবে। সব জোটের বাইরেও এই জোট অটুট থাকবে চিরদিন।

আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত

বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬

কাশ্মীর কিংবা পাকিস্তান তো উপলক্ষ মাত্র, আসল কথাটা বোধ হয় তীব্র এবং ক্রমবর্ধমান মুসলিম বিদ্বেষ

অন্ধ পাক-বিরোধিতা? চোপ, দেশপ্রেম চলছে

‘দেয়ার ইজ নো ফ্ল্যাগ লার্জ এনাফ টু কভার দ্য শেম অব কিলিং ইনোসেন্ট পিপল৷’ জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার নামে সচেতন ভাবে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব কিছুই, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর বিনম্র দেশপ্রেমকে এক পংক্তিতে বসিয়ে যুদ্ধবাজেরা আলো করে আছে স্টুডিওগুলি৷

 

 

সুমন চট্টোপাধ্যায়  

 দৈনিক এই সময়,  কলকাতা


শনিবার ২২ অক্টোবর ফেসবুকে আমি এই পোস্টটি আপলোড করেছিলাম৷

‘সেই মল খসালি তবে লোক কেন হাসালি!এত দিন ধরে এত বাতেলা করে আসার পরে শেষ পর্যন্ত মুম্বইয়ের গুন্ডার সর্দার রাজ ঠাকরের কাছে মুচলেকা দিয়ে এলেন বলিউডের দুই স্তম্ভ, করণ জোহর ও মুকেশ ভাট৷

মুচলেকার শর্ত কী হল ? না বলিউডে ভবিষ্যতে আর কখনও পাকিস্তানি শিল্পীদের ডাকা হবে না , যে সব ছবিতে পাকিস্তানিরা অভিনয় করেছেন অথচ ছবিগুলি এখনও মুক্তি পায়নি তাদের প্রযোজকেরা সেনাবাহিনীর ত্রাণ তহবিলে পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন৷ করণ আবার এই প্রতিশ্রীতিও দিয়ে এসেছেন তাঁর নতুন ছবিটি শুরু হবে উরিতে নিহত সেনাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে !রাজ ঠাকরের মতো দু’পয়সার মস্তান স্রেফ চমকে বলিউডকে নিজের পদানত করছে , বাইরের জগতের কাছে ভারতবর্ষের এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন আর কিছু হতে পারে কি ? তার চেয়েও গর্বের কথা এই সমঝোতা হয়েছে এমন একজনের মধ্যস্থতায় যিনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় বসেছেন৷ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মহোদয় ! সবচেয়ে আনন্দের কথা ফৌজি তহবিল এ বার তা হলে শুদ্ধ হতে চলেছে তোলাবাজির টাকায়! ভারত মাতা কি জয়!’


সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমার ফেসবুকের পাতায় চার অক্ষর আর ছয় অক্ষরের খিস্তির বন্যা চলেছে! চলুক৷ খিস্তি খেতে আমার একেবারেই খারাপ লাগে না কেননা আমার গাত্রচর্ম দেখে গণ্ডারও লজ্জা পায়৷ ‘ট্রোল’ ছাড়া সোশাল নেটওয়ার্ক হয় না, আমরা তো কবেই জেনে গিয়েছি৷ কিন্ত্ত প্রশ্নটা খিস্তি খাওয়ার নয়৷ ইদানীং দেখছি, পাকিস্তান নামটি শুনলেই অসংখ্য লোক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন , যেন তাঁদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লাগছে, চারটি গালাগাল ছুড়ে না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের রক্তের চাপ স্বাভাবিক হচ্ছে না৷ গুজরাটে এমনটা হয় তার মানে বুঝি , রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ মায় উত্তরপ্রদেশে হয় তারও একটা জুত্সই ব্যাখ্যা বের করা সম্ভব৷ কিন্ত্ত তাই বলে ব্রুটাস বাঙালি তুমিও! যে রাজ ঠাকরে নিজের রাজ্যে ভোটে এক শতাংশও ভোটও জোগাড় করতে পারে না বাংলায় সে-ই আজ হিরো হয়ে যাচ্ছে? দেশভক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজ -ভক্তিও ?সন্দেহ নেই কিছু দিন যাবত্ টেলিভিশন চ্যানেলগুলির সৌজন্যে বেশ একটা উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া বইছে৷ .যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা কিছুটা থিতু হলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে যত চমকপ্রদ বিশেষণ ব্যবহার করতে পারছেন তাঁরই নম্বর বাড়ছে চড়চড় করে৷ সোশাল নেটওয়ার্কে রাজ ঠাকরের মতো প্রান্তিক মারাঠি নেতাও হঠাত্ ফোকটে পয়লা নম্বর বাপের বেটার মর্যাদা পাচ্ছেন সে জন্যই৷ দেখলে তো ছেলেটার একটা হুমকি শুনেই কেমন সুড়সুড় করে নাকে খত দিতে বাধ্য হল করণ জোহর? আরে বাবা ছবি করছিস কর, দুধ-ভাত দিয়ে পাকিস্তানি কালসাপগুলোকে ডেকে আনার কী প্রয়োজন? শিল্প আগে না দেশ ? এতই যদি পাকিস্তানি পিরিত তা হলে যা না কেন রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে থাক ! পাকিস্তানি সরকার, সেনাবাহিনী, আইএসআই, হাফিজ সইদ বা সালাউদ্দিনের মুণ্ডুপাতেই খেলাটা আর থেমে নেই৷ পাকিস্তান নামটাই অপবিত্র , পাকিস্তানি মাত্রেই সন্ত্রাসি না হলেও ভারতের দুশমন, তাই এ দেশে অবাঞ্ছিত৷ এই মতের শরিক যারা একমাত্র তারাই চব্বিশ ক্যারেট খাঁটি দেশপ্রেমিক , বিপক্ষে যারা তারা মেনিমুখো স্যুডো-সেকুলার কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি দেশদ্রোহী৷ এই চিল চিত্কারের এমনই দাপট যে যত্সামান্য ভিন্নমতও উড়ে যায় খড়কুটোর মতোই৷

একমাত্র পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা হলেই ভারতবাসী যাবতীয় দৈনন্দিন ভেদাভেদ ভুলে এককাট্টা হয়ে পড়ে এটা জানাই ছিল৷ নতুন যেটা , তা হল, আমরা কী ভাবে আমাদের জাতীয় পরিচিতির সংজ্ঞা নিরূপণ করব তার উপরে পাকিস্তানের দীর্ঘ ছায়াপাত , অতীতে যেটা আমরা সে ভাবে কখনও প্রত্যক্ষ করিনি৷ বরং এটা সত্যি ছিল পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই৷

জিন্না যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার মৃত্যু হতে শুরু করেছিল কায়েদ-ই-আজমের মৃত্যুর আগে থেকেই৷ পাকিস্তান যেখানে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার পাট চুকিয়ে ফৌজি জ্যাকবুটের তলায় নিজেকে সমর্পণ করেছে, প্রতিবেশী ভারত সেখানে সগর্বে দাড়িয়ে ছিল বৈপরীত্যের উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে৷ পাকিস্তান যা নয়, ভারত ঠিক সেটাই৷ স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর পরে, জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের নামে আসলে আমরা সেই পাকিস্তানিদেরই যেন নকল করতে শুরু করেছি৷ এত দিন পাকিস্তান ভাবত যত নষ্টের গোড়া ভারত, এখন আমরা ভাবছি পাকিস্তান৷ তার মানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথায় কথায় জেহাদ ঘোষণা করে তাদের অহরহ সবক শেখাতে চেয়ে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রও কি অনিবার্য ভাবে সেই ‘সিজ মেন্টালিটি’-র শিকার হয়ে উঠছে না? আমাদের তেরঙা তা হলে কীসের দ্যোতক, পাকিস্তান-বিরোধিতার না নিজেদের সাফল্য ও সমৃদ্ধির? ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে, পাকিস্তানের থেকে তো নয়! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন হিস্টিরিয়া তৈরি করা, দেশপ্রেমকে পাকিস্তান-বিরোধিতার সমার্থক করে তুলে নিজেদের দৈন্যকে বে-আব্রু করে দেওয়া অনেকাংশেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলির কীর্তি৷ দিনের পর দিন উগ্র জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমকে বাজারে বিকিয়ে এরা দেশজুড়ে এমন একটা আবহ তৈরি করেছে, স্বাভাবিক ভাবেই যা প্রভাবিত করছে আম-জনতার একাংশকে৷ একেবারে পাকিস্তানিদের মতোই উদগ্র হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্মীয় পরিচিতিটাই৷ যৌনতা কিংবা হিংসার মতো পাক-বিরোধী দেশপ্রেমের বিপণনও যে বাণিজ্যিক ভাবে এতটা সফল হতে পারে আমাদের তা জানা ছিল না৷ সেটা ভালো করে বুঝতে পারার আগেই দেখছি বিষবৃক্ষের শিকড় মাটির তলায় ছড়িয়ে গিয়েছে অনেক দূর৷

পাকিস্তান-পাকিস্তান নিয়ে এই আর্তনাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে ছা-পোষা কাশ্মীরবাসীর, তাদের ভয়াবহ জীবনযাত্রার কথা বাকি দেশ আর সে ভাবে জানতেই পারছে না৷ এক্কেবারে সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এই অসহায় মানুষগুলির নির্মম দিনলিপি৷ জেনেশুনে তবু ভুলে থাকার এই প্রবণতার একটা কারণ যদি হয় মূর্খের দেশপ্রেম অন্য কারণটি তা হলে দেশদ্রোহী চিহ্নিত হওয়ার ভয়৷ কী দরকার বাবা কাশ্মীরিদের দুর্দশার কথা রিপোর্ট করে নিজের শত্রু বাড়ানোর ! হতভাগারা মরছে মরুক , কাশ্মীরের আগুনের আঁচ তো আমার দাওয়ায় এসে পৌঁছচ্ছে না! আসলে এটাও এক ধরনের দেশদ্রোহ৷ যদি মনে করি কাশ্মীর সত্যিই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা হলে কাশ্মীরিরাও তো বাংলা, বিহার, ওডিশা, উত্তরপ্রদেশের মতোই একটি অঙ্গরাজ্যের ভারতীয়৷ বাকি ভারতে পান থেকে চুন খসলে যদি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাগুলো নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে নেমে পড়ে , কাশ্মীরে তা হলে তেমনটি হয় না কেন একেবারেই ? উরি আর পাম্পোরই কি ভূস্বর্গের একমাত্র খবর নাকি? যে কোনও চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখুন মনে হবে যেন তেন প্রকারেণ দর্শককে উত্তেজিত করাটাই সঞ্চালকের একমাত্র কাজ৷ কোনও ঘটনাকে তার সঠিক প্রেক্ষাপটে ফেলে বিচার বিশ্লেষণের কোনও তাগিদ নেই, রাষ্ট্র যা বলছে সেটাকেই ধ্রুবজ্ঞান করে একতরফা প্রচার চালিয়ে যাও৷ প্রসঙ্গত , বুরহান ওয়ানির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সহসা কাশ্মীরবাসীর আন্দোলিত হওয়ার কথাই ধরা যাক৷ এ ধরনের ঘটনা কিছুতেই রাতারাতি ঘটতে পারে না , নিশ্চয়ই তার একটা দীর্ঘ প্রেক্ষাপট আছে যেটা আদৌ জঙ্গিয়ানার সঙ্গে যুক্ত নয়৷ সুবিধেমতো আমরা এ কথা বিস্মৃত হই যে গত এক দশকে উপত্যকায় জঙ্গির সংখ্যা কেবল কমেছে , কমতে কমতে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বড়ো জোর শ ’দুই৷ অথচ পনেরো বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল কম করেও তিন হাজার৷ তা হলে জঙ্গিদের উপস্থিতি যেখানে প্রায় প্রান্তিক হয়ে পড়েছে সেখানে হঠাত্ তাদের সমর্থনে কাশ্মীরি আওয়াম এ ভাবে দলে দলে রাস্তায় নামল কেন ? কেন দিনের পর দিন ধরে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের রাজপথের লড়াই থামছে না? কাশ্মীরের পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে সর্বাগ্রে খুঁজে বের করতে হবে এই জরুরি প্রশ্নটির উত্তর৷ কিন্ত্ত সেই কাজ করাটাকে কি কেউ কর্তব্য বলে মনে করছে? তাদের নিদান, কাশ্মীরে সমস্যা মানেই জঙ্গিয়ানার সমস্যা, আর জঙ্গিয়ানার সমস্যা মানেই পাকিস্তানের সক্রিয় ইন্ধন৷ এর বাইরেও কাশ্মীরি যুবাদের বিদ্রোহী মেজাজের পিছনে যে সহস্র কারণ থাকতে পারে সে খবর কে রাখে ?সত্যটা হল হাওয়ার্ড জিন একদা যা বলেছিলেন৷ ‘দেয়ার ইজ নো ফ্ল্যাগ লার্জ এনাফ টু কভার দ্য শেম অব কিলিং ইনোসেন্ট পিপল৷’ জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার নামে সচেতন ভাবে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব কিছুই, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর বিনম্র দেশপ্রেমকে এক পংক্তিতে বসিয়ে যুদ্ধবাজেরা আলো করে বসে আছে স্টুডিওগুলিতে৷ তাদের পাশে যোগ্য সঙ্গত করার গেরুয়া দেশপ্রেমিকরা তো আছেই , এরা ভারত মাতা ও গো -মাতা উভয়েরই সন্তান, আনখশির মুসলিম বিদ্বেষী৷ তাদের এজেন্ডাকে ফলবতী করে তোলার কাজে মিডিয়ার এমন নিঃশর্ত সমর্থন অতীতে কখনও তারা পায়নি৷ শাসক ও মিডিয়ার এমন অদৃষ্টপূর্ব যুগলবন্দিই বিষাক্ত করে তুলছে চারপাশের পরিবেশকে৷ যে তাদের গলায় গলা মেলাবে না সেই দেশদ্রোহী, তাকে শূলে চড়াও৷

আর সোশাল নেটওয়ার্কে এমন দেশদ্রোহীকে হাতের কাছে পেলে ? তেড়ে গালাগালি দাও, বাপ-চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ছাড়৷ কখন অলক্ষে সেই ভাইরাস ঢুকে গিয়েছে আমাদের এই বাংলাতেও৷ আমরা ভেতো, পেট-রোগা, অলস, কুচুটে এবং অতীত -বিলাসী ছিলাম, এখনও আছি, বরাবর থাকবও৷ কিন্ত্ত আমরা কি লিবারেল ছিলাম না ? কিংবা সেকুলার ? আমরা তো জানতাম এই বাংলাই নাকি সেই দুর্জয় ঘাঁটি যেখানে ধর্মীয় বিদ্বেষ মাথা চাড়া দিতে পারে না, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একমাত্র মরূদ্যান৷ তা হলে গোলমালটা হচ্ছে কোথায় ? কী ভাবে ‘মিউটেট’ করে যাচ্ছে আমাদের ডিএনএ-ও? সোজা কথাটা সোজা ভাবেই বলে ফেলা ভালো৷ উরি, কাশ্মীর কিংবা পাকিস্তান কেবল উপলক্ষ মাত্র, আসল কথাটা বোধ হয় তীব্র এবং ক্রমবর্ধমান মুসলিম বিদ্বেষ৷ সোশাল নেটওয়ার্কের অসংযত গালাগালি, খিস্তি-খেউড় সেই সামাজিক বাস্তবতারই জ্বলন্ত প্রতিফলন৷ কিছু নয় কিছু নয় করে আমরা যে যার ঠান্ডা ঘরে বসে যতই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি না কেন, বাকি ভারতের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য নিয়ে সেমিনারে যতই পরিচিত বুকনি ঝাড়ি না কেন , হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ‘আচ্ছে দিন’ ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন হচ্ছে তলায় তলায়৷ কাণ্ডজ্ঞানহীন তোষণ আর অন্ধ বিদ্বেষের নিয়ত ঠোকাঠুকির ফলে তৈরি হয়েছে আগ্নেয়গিরি৷ শুধু যেন শলাকা লাগানোর অপেক্ষা৷ উদয় দেবসত্যটা হল হাওয়ার্ড জিন একদা যা বলেছিলেন৷

সুমন চট্টোপাধ্যায়: ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সাংবাদিক

পাকিস্তানি নাগরিক হলেই জঙ্গি! এঁরা সেলিব্রিটি এটাই এঁদের অপরাধ?

সৌপর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ভারত-পাক সম্পর্ক কোনও দিনই একমাত্রিক ছিল না৷ আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের নীচে চাপা পড়ে আছে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, নিরাপত্তা, ভারত-পাক সম্পর্ক কোন পথে, এমন নানা প্রশ্ন৷ উরিতে বা পাঠানকোটের ওপর যে অকারণ জীবনহানি হয়েছে তার জন্য দলাদলির চাপে যে কোনও দেশের সাংস্কৃতিক দিকগুলিকে পিষে মারার অধিকার কারওর নেই৷

বিভিন্ন পাকিস্তানি সেলিব্রিটিরা এই সার্জিকাল স্ট্রাইক-এর ফলে বিনা কারণবশত যে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন তা একেবারেই সমর্থন যোগ্য নয়৷ বাস্তবিক ভাবে এই ধরনের জটিল পরিস্থিতি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে জাতীয়তাবাদের নামে করা মিথ্যে দাম্ভিকতা ও চরম নির্বুদ্ধিতার কারণে৷ অনেকের কাছেই এটা পরিষ্কার নয় যে উরি বা পাঠানকোট-এ জঙ্গি হানা এবং অকারণ প্রাণহানির সাথে পাকিস্তানি সেলিব্রিটিদের ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দিকে যুক্ত থেকে কাজ করার মধ্যে কী সম্পর্ক? বরং নতুন প্রজন্মের ভারতীয়রা শিখছে যে কী ভাবে মিলেমিশে নিজের দেশ ছাড়াও অন্য দেশকে ভালোবেসে কাজ করা যায়৷ তার মানে এটা নয় যে জঙ্গিহানা যখন তখন আমাদের ওপর হবে আর আমরা তার কোনও প্রতিবাদই করব না৷ কিন্ত্ত তার মানে তো এটা নয় যে, যেহেতু পাকিস্তান থেকে জঙ্গিহানা হচ্ছে তাই সব পাকিস্তানিরাই জঙ্গি বা আতঙ্কবাদী, তারা সবাই ভারতকে শত্রু মনে করে, ঘৃণা করে৷ তা হলে তো যদি কোনও দিন অন্য কোনও দেশ থেকে যদি এ রকম হানা হয় তখন ভারত বলবে সেই দেশেরও সবাই জঙ্গি, তারাও সবাই শত্রু৷

তাই এক কথায় জাতীয়তাবাদের নামে পাকিস্তানি সেলিব্রিটিদের এই ভাবে সার্জিকাল স্ট্রাইকের আওতায় এনে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার সিদ্ধান্ত চরম অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত৷


দেশের যাই ঘটনাই ঘটুক না কেন, সেই সব বিষয়ে সাধারণের কথা তো ধরা হয় না, তবে সেলিব্রিটিদের নিয়েই বা এত টানা-হ্যাঁচড়া কেন? এঁদের বক্তব্য পেশ করতেই হবে, কিন্তু কেন? আর যদি এঁরা কোনও মন্তব্য করেও থাকেন তবে তাই নিয়ে বাকিদেরই বা আরও জলঘোলা করা কেন? এঁরা সেলিব্রিটি এটাই এঁদের অপরাধ? আর তা ছাড়া সবচেয়ে বডে়া কথা হল কী করে ভারতের কোনও নির্দিষ্ট দল বা প্রতিষ্ঠান গলা তুলতে পারে পাকিস্তানের কোনও সেলিব্রিটিদের বিরুদ্ধে, যখন কিনা ভারত সরকার তাদের ভিসা এবং ভারতে এসে কাজ করার অনুমতিপত্র দিয়েছে৷ আমাদের সংবিধানের ধারা অনুযায়ী জনগণের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে নিজের ইচ্ছেমতো মন্তব্য করার এবং নিজস্ব অভিব্যক্তি প্রকাশ করার৷ যদি কোনও ভারতীয় স্ব-ইচ্ছায় অন্য দেশের (সে যে কোনও দেশেরই হোক না কেন) সেলিব্রিটিদের বর্জন করতে চায় তা হলে তারা তা করতেই পারে, কিন্তু দেশের সব জনগণ কী করবে, কী করবে না সেটা বলার অধিকার জনগণ কিন্ত্ত কোনও নির্দিষ্ট দল বা সংগঠনকে দেয়নি৷ তা হলে তো এ কথাও বলতে হয়, যে সব দল বা সংগঠন এই জিগির তুলছে তারা রীতিমতো সংবিধানকে লঙ্ঘন করার মতো দণ্ডনীয় অপরাধে অপরাধী৷ তাই এক কথায় জাতীয়তাবাদের নামে পাকিস্তানি সেলিব্রিটিদের এই ভাবে সার্জিকাল স্ট্রাইকের আওতায় এনে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার সিদ্ধান্ত চরম অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত৷

সৌপর্ণা চট্টোপাধ্যায়, কদমতলা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

এই সময়, কলকাতার দৈনিক 

সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬

পাকিস্তানকে কোণঠাসা করলেই যেন কেল্লা ফতে

ব্রিকস ও বিমস্টেক মঞ্চকে সন্ত্রাসের প্রশ্ন সামনে রেখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেন কেন মোদী? কাশ্মীর নীতিতে কি এত দিনের দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার বৃত্ত থেকে সরে আসার ইঙ্গিত? তবে কি ভারতের অবস্থানেই পরিবর্তন?

 

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়


গোয়ায় অনুষ্ঠিত দু’দিন ব্যাপী ব্রিকস-এর সম্মেলনের প্রথম দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি আশ্চর্যজনক মন্তব্য করেছেন৷ বলেছেন, ‘রাশিয়া আমাদের পুরনো বন্ধু৷'

দু’জন নতুন বন্ধুর তুলনায় একজন পুরনো বন্ধু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷’ কথাটা রাষ্ট্রনায়কসুলভ হলেও আশ্চর্যজনক এই জন্য যে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমাদের সখ্য ছিল কার্যত নেহরুবাদী পররাষ্ট্রনীতির ফসল৷ ইন্দিরা গান্ধী সেই বন্ধুত্বকে প্রসারিত করেছিলেন৷ ১৯৭১ -এ বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত -পাক যুদ্ধের সময়ে তৎকালীন ওই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের অদৃশ্য সমর্থন আমাদের সাথে ছিল৷ এবং ছিল বলেই চিন ধীরে কিন্ত্ত নিশ্চিত ভাবে পাকিস্তানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷


সন্ত্রাসের প্রশ্নটিকে একমাত্রিক ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সাথে অন্বিত করলে হয়তো সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো সাময়িক কিছু গৌরবের মুহূর্তকে তুলে ধরা যায়৷ কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হয় না৷ 

 

আজ ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে পাকিস্তানও সন্ত্রাসের শিকার৷


এক সময়ে এ দেশের বামপন্থীরা ভারতের সোভিয়েত ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির সোচ্চার সমর্থক ছিলেন৷ তাঁদের বলতে শুনেছি, ‘কেন্দ্রের আর্থিক নীতির বিরোধী হলেও , পররাষ্ট্রনীতিকে আমরা সমর্থন করি৷’ সেটা ছিল সোভিয়েতের প্রতি তাঁদের মতাদর্শগত ‘অনুরাগের ছোঁয়া৷ ’ কিন্ত্ত গণ্ডগোল হয়ে গেল নরসিংহ রাও-এর সময়কাল থেকে৷ বার্লিনের প্রাচীরের পতন , পূর্ব-ইউরোপে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবলুন্তি, গর্বাচভীয় ‘গ্লাসনস্ত’, ‘পেরেস্ত্রৈকা’ এবং অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সামগ্রিক প্রেক্ষাপটটি রচনা করে দিয়েছিল৷ সোভিয়েত হারিয়ে যাওয়ার পর যে এক খণ্ড রাশিয়া পড়ে রইল তা সামরিক ভাবে শক্তিশালী হলেও সোভিয়েতের ছায়াও তার মধ্যে দেখা গেল না৷ অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত একটি যুদ্ধরাষ্ট্রে পরিণত হল রাশিয়া যার অন্যতম কারবার হচ্ছে অস্ত্র কেনাবেচা৷ ফলত, প্রকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে তুলতে মার্কিন প্রশাসনের বেশি দেরি হয়নি৷ আফগান মুজাহিদিনের অস্ত্র সরবরাহ এবং নৈতিক সমর্থন প্রদান, পরবর্তীকালে তালিবানদের নীরব প্রশ্রয়, গণবিধ্বংসী সমরাস্ত্র খোঁজার নামে ‘ইরাক অভিযান’, সব মিলিয়ে মার্কিন প্রশাসনের ‘যুদ্ধই শান্তি’ (war is peace) প্রকল্প প্রায় সফল হয়ে এসেছিল৷ কিন্তু প্রতিক্রিয়ার উৎসমুখ অত সহজে তো বন্ধ হতে পারে না৷ তাই আল কায়দা এবং ওসামা বিন লাদেন৷ তাই আইএস৷ তাই লাশের পর লাশ৷ অসহায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু -মিছিল৷ ইউরোপ জুড়ে উদ্বাস্ত্তর ঢল৷ সাদ্দাম হুসেনের জেনেরালরাই নাকি এখন আইএস জঙ্গিদের পরিচালনা করেন !দুনিয়াতে যুদ্ধ বাস্তব৷ ‘নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’-কে এড়িয়ে বাঁচা যায় না৷ কিন্ত্ত শক্তিসাম্য নষ্ট হলে একমেরু বিশ্ব কতটা বাঁচার অযোগ্য হতে পারে তা একের পর এক সন্ত্রাসের ঘটনায় আমরা বুঝতে পারছি৷ মতাদর্শ তো কিছু বই আর লেখা লাইন নয়৷ একটা জীবনবোধ৷ একটা ‘বিশ্বপরিচয়’৷

তা ভ্রষ্ট হলে কী হয় আমরা দেখতে পাই যখন ওয়েব দম্পতি কিংবা এইচজি ওয়েলস প্রচারিত ফেবিয় সমাজবাদের (Fabian Socialism) ধারক ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ইরাক যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের হাত ধরার আগে রাষ্ট্রপুঞ্জকে সহাস্যে ‘talking shop’ বলে উড়িয়ে দেন৷ সভ্যতা আক্রান্ত, এখন আবার বিতর্কের কী আছে? ইদানীং শোনা যাচ্ছে ব্লেয়ার নাকি ভুল স্বীকার করছেন৷ হতে পারে সেটা জেরেমি করবিনের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে৷ করবিনই সেই লেবার নেতা যিনি প্রথম দিন থেকে লেবার পার্টির মধ্যে এবং বাইরে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন৷

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে এই রাশিয়াকে কখনওই পুরনো বন্ধু বলা চলে না৷ সিরিয়ার প্রশ্নে রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব আবার পাকিস্তানে সামরিক মহড়া কিংবা ভারতের সাথে যুদ্ধ বিমান সংক্রান্ত চুক্তি ইত্যাদি আপাত পরস্পর বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে লুকিয়ে আছে ওই দেশের বেহাল অবস্থা৷ এখন রাশিয়া কোনও শক্তি সাম্য তৈরি করতে পারবে না৷ এই রাশিয়া ভারতের ‘নতুন ’ বন্ধু হতে পারে৷ তথাকথিত বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি তেমনই ইঙ্গিত দেয়৷ ইসলামাবাদে এ বছর সার্কের সম্মেলন হল না৷ ১৯৮৫ -তে ঢাকায় সার্কের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও এই দক্ষিণ এশিয় আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি ১৯৭৮ সালে ভেবেছিলেন বাংলাদেশের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান৷ মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও উন্নতি সাধনই এর লক্ষ্য ছিল৷ এরই ফলশ্রীতিতে ২০০৪ -এর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সার্কের শীর্ষ সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল চুক্তি বা SAFTA৷ পারস্পরিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতের কাছ থেকে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর তকমা পেয়েছে৷ কিন্ত্ত পাকিস্তানের নিজস্ব উত্পাদনের মাত্রা যথেষ্ট রফতানিযোগ্য না হয়ে ওঠাতে ওই সুবিধা বিশেষ কাজে লাগেনি৷ নির্জোট আন্দোলনের ক্ষেত্রে নেহরুর বিশেষ ভূমিকা এবং পঞ্চশীল নীতির প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি বড়ো অংশের ইতিবাচক মনোভাব আকর্ষণের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল৷ আমরা এও দেখেছি যে সার্কের মঞ্চকে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান বারবার উত্তন্ত করার চেষ্টা করলেও ভারত কী ভাবে সেই প্রক্রিয়ায় জল ঢেলেছে৷ অর্থাত্ ভারতের কাশ্মীর নীতি নিয়ে যে প্রশ্নই থাক তা একান্তই ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার স্তরে থেকেই মেটাতে হবে --- এই মূল নীতি থেকে ভারত কখনওই সরে আসেনি৷ সে ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধী, নরসিংহ রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ি বা মনমোহন সিং -এর রাষ্ট্রনায়কোচিত মনোভাবে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি৷ আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর প্রশ্নকে বার বারই এড়িয়ে গেছে নয়া দিল্লি৷ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মাথা গলায়নি৷

তবে এখন সন্ত্রাসের প্রশ্নকে সামনে রেখে ব্রিকস ও বিমস্টেকের মঞ্চকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেন কেন মোদী? বিশেষত উভয় ক্ষেত্রেই যখন পাকিস্তান সদস্য রাষ্ট্র নয়! তবে কি ভারতের মৌলিক অবস্থানেরই কোনও পরিবর্তন হচ্ছে? অর্থাত্ কাশ্মীর প্রশ্নকে কৌশলে ভারত-পাক দ্বি-পাক্ষিক ঘেরাটোপ থেকে ছাড়িয়ে এনে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সাথে একাত্ম করে দেওয়া৷ সে ক্ষেত্রে এক ঢিলে দুই পাখি৷ প্রথমত, পাকিস্তানকে একঘরে করা গেছে এটা দেখিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মোদী সামরিক জাতীয়তাবাদকে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন এবং দ্বিতীয়ত কাশ্মীর প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অভিমত ভারতের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হবেন৷ এটাই ইদানীং বাস্তববাদ আর দেশপ্রেমের রাজনীতি হয়ে উঠেছে৷

জাতীয় মিডিয়ার একটা অংশ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে কেন ব্রিকস সম্মেলনে চিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর মনোভাব নিল না৷ তাঁদের মতামত এই যে সন্ত্রাস নির্মূল না হলে ব্রিকসভুক্ত রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনওই সম্ভব হবে না এবং এই প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদীর পাকিস্তান বিরোধী অবস্থান সঠিক৷ অর্থাত্ দেশজোড়া সামরিক জাতীয়তাবাদের প্রসারে এঁরা মোদীকে সাহায্যই করছেন৷ কিন্তু ভেবে দেখছেন না যে এই প্রশ্নটি ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরিসরটিকে অধিকতর সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে৷ এবং অবধারিত ভাবে পাকিস্তানকে বাধ্য করছে চিনের হাত ধরতে৷ সংবাদসূত্রে জানা গেছে যে পাকিস্তান সার্কের পরিবর্তে চিনের সাথে কৌশলগত কারণে বৃহত্তর মঞ্চ গড়তে চায়৷ তেমন কিছু হলে সেটা কখনও ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল হবে না৷

তার চেয়েও বড়ো কথা সন্ত্রাসের প্রশ্নটিকে একমাত্রিক ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সাথে অন্বিত করলে হয়তো সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো সাময়িক কিছু গৌরবের মুহূর্তকে তুলে ধরা যায়৷ কিন্ত্ত মূল সমস্যার সমাধান হয় না৷ আজ ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে পাকিস্তানও সন্ত্রাসের শিকার৷ এ কথা চিনকে বলতে হচ্ছে কারণ আমরা সন্ত্রাসের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করতে চাইছি এবং চিন পাকিস্তানের বিশেষ বন্ধু রাষ্ট্র৷ আমরা কাশ্মীরকে অবশ্যই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভাবছি এবং এ বিষয়ে সম্ভবত কারুরই কোনও সমস্যা নেই কিন্ত্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে সংঘাতে উপত্যকায় যে সব মানুষের মৃত্যু হচ্ছে তাঁদের বিচ্ছিন্ন ভাবে কাশ্মীরবাসীর মৃত্যু হিসেবেই দেখছি৷ ভারতবাসীর মৃত্যু বলছি না৷ বলছি না বা বলতে চাইছি না৷ আমরা কি মননে কাশ্মীর থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ নই ?সন্ত্রাসের মোকাবিলা জরুরি৷ কিন্ত্ত পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে এমনটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই৷ অন্তত ইতিহাস তাই বলে৷ নরেন্দ্র মোদীর শুরুটা ছিল চমৎকার৷ দক্ষিণ-এশিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এ দেশ দেখেনি এর আগে৷ হঠাৎ ছানা কেটে গেলে চলবে ?

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়স: বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

এই সময়, কলকাতার দৈনিক

শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৬

আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ‘শেষ’ নয়, ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টায় সুর নামাচ্ছে ফিলিপিন্সই

সত্যিই কি আমেরিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে ফিলিপিন্সের? আর তা যদি হয়, তা হলে ঠিক কী ভাবে? কী- বা হবে তার পরিণতি? সাধারণ মানুষের এই টুকরো টুকরো প্রতিক্রিয়া আর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ পদাধিকারীদের কথায় খুব বেশি ফারাক কিন্তু নেই৷ দুতের্তের কথা এখনও ঠিক হজম হচ্ছে না তাঁদেরও৷ যা বলেছেন, সব দিক ভেবে বলেছেন কি ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট? কেন এই সংশয় আর বিভ্রান্তি, তার কিছু উত্তর হয়তো দিতে পারবে পরিসংখ্যান৷  

‘মনে হয়, উনি মজা করছিলেন।’ মন্তব্যটা এল যাঁর কাছ থেকে, তাঁর বয়স ৫৯, ম্যানিলায় সেলসউওম্যান হিসেবে কাজ করেন৷ বৃহস্পতিবার বেজিংয়ে ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট দুতের্তে যা বলেছেন, তা যে সত্যি হতে পারে, সে কথা বিশ্বাস হচ্ছে না মারিসা লাগুইতানের৷ অবাক হয়ে বলছেন, আমেরিকা তো দীর্ঘদিন ধরে দেশের বন্ধু৷ কী হবে, যদি ফিলিপিন্স থেকে বিপিও-গুলো সব চলে যায়? আমাদের তো চাকরি থাকবে না! মারিসার মতো পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি, এমন এক তরুণীর গলায় নির্ভজাল আশঙ্কা৷ তাঁরও প্রশ্ন


আমেরিকা ফিলিপিন্সের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক শুধু কূটনৈতিক বা সামরিক সহযোগিতার নয়৷ অর্থনৈতিক বিষয়ে আমেরিকার উপর এই এশীয় দেশটির নির্ভরতা বিপুল৷ গত বছর দুদেশের মধ্যে পণ্য ব্যবসার পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়ে ছিল ১৮০০ কোটি মার্কিন ডলার৷ আর ফিলিপিন্সে বিভিন্ন মার্কিন সংস্থার বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি৷ বিদেশে কর্মরত ফিলিপিনোদের কাছ থেকে তাঁদের দেশ বছরে যে ১৭৬০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে, তার মধ্যে আমেরিকা প্রবাসী নাগরিকদের অবদান প্রায় এক তৃতীয়াংশ৷ এই পরিস্থিতিতে দুতের্তেরবিচ্ছেদঘোষণার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁর মন্ত্রীরাও৷ বেজিংয়ে দুতের্তে শুধু আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে চিনের হাত ধরার কথা বলেই থামেননি, ‘বিচ্ছেদ বলতে কী বোঝাচ্ছেন, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন৷ তাঁর নিজের ভাষাতেই, ‘আমি আমেরিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘোষণা করছি৷ সামরিক ভাবে, এবং সামাজিক ভাবে না হলেও অর্থনৈতিক ভাবে।’ অর্থনৈতিক বিচ্ছেদ হলে যে ফিলিপিন্সের জন্য তার ফল মোটেও ভালো হবে না, তা নিয়ে দ্বিমত নেই ওয়াকিবহাল মহলের৷ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, আমেরিকার উপর ফিলিপিন্সের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা অতিক্রম করে দুতের্তের কথাকে সত্যিই কাজে পরিণত করা সম্ভব নয়৷

সেটা বুঝতে পেরেছে ফিলিপিন্সও৷ ফলে শুরু হয়ে গিয়েছে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা৷ শুক্রবার দুতের্তের দন্তর বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, আগে থেকেই যারা বন্ধু, এমন দেশগুলির সঙ্গে চুক্তি ভাঙা বা সমঝোতা নষ্ট করার কোনও ইচ্ছে নেই ফিলিপিন্সের৷ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র আর্নেস্টো আবেলার মতে, দুতের্তের ঘোষণা আসলে স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসরণ করার বিষয়ে ফিলিপিন্সের অবস্থানটাই আরও এক বার জানিয়ে দেওয়া৷ প্রেসিডেন্টের কথার অর্থ আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কশেষ করা নয়, শুধুমাত্র আমেরিকার উপর নির্ভরশীল না হয়ে এশীয় দেশগুলিকেও সঙ্গী করা বলে দাবি করেছেন আমেরিকার সঙ্গেবাণিজ্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রবন্ধ করার প্রশ্ন নেই৷ 

এমনকি চিনও সম্ভবত এটা আশা করছে না যে, আমেরিকার সঙ্গে ফিলিপিন্সের সম্পর্ক সত্যিই ছিন্ন হবে৷ বেজিংয়ে চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়াং দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এটাকে (আমেরিকা চিনের মধ্যে) হার-জিতের খেলা হিসেবে না দেখাই ভালো৷ তাঁর কথায়, চিনের দিক থেকে দেখতে গেলে, আমারা মনে করি, বর্তমান বিষয়টাকে হয় তুমি, নয় আমি বা তুমি জিতলে আমার হার, ভাবে বলা যায় না৷ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে কোনও ভাবে প্রভাবিত না করেই একটি দেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়ার ঘটনা তো হয়েই থাকে৷ আমেরিকা অবশ্য একটা ঝাঁকুনি খেয়েছে৷ ফিলিপিন্সের পক্ষে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ নয় বুঝলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, দক্ষিণ চিন সাগর এলাকায় তাদের পরিকল্পনাটা দুতের্তের কথায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছে৷ বিতর্কিত ওই অঞ্চলে চিনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ঠেকিয়ে রাখতে এতদিন ফিলিপিন্সই ছিল তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সহযোগী৷ ম্যানিলার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং ভিয়েতনাম, মালয়শিয়ার মতো দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা যে কূটনীতির চালটা দিচ্ছিল, তা বার ভেস্তে যাওয়ার মুখে৷ কিন্তু মার্কিন রাজনীতিক বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করে নিচ্ছেন, দক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপিন্সকে হারানো একটা বড় ধাক্কা৷ সে জন্য দুতের্তের মন্তব্যের পর প্রতিক্রিয়া আসতে দেরি হয়নি৷ বিষয়ে নিজেদের অসন্তোষ গোপন করছে না তারা৷ ম্যানিলায় মার্কিন দূতাবাস দিনঅকারণ অনিশ্চয়তা তৈরি জন্য দুতের্তের মন্তব্যের সমালোচনা করেছে৷ মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জন কির্বি জানিয়েছেন, কেন অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন মন্তব্য করা হল, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হতে পারে ফিলিপিন্সের কাছে৷

প্রকাশ্যে অবশ্য ইতিবাচক ভাবটা বজায় রাখছে আমেরিকা৷ তবে ভরসা যে কিছুটা নড়ে গিয়েছে, তা স্পষ্ট৷ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, ‘ফিলিপিন্সের সঙ্গে হওয়া চুক্তিগুলির দায়বদ্ধতা বজায় রাখতে চায় ওয়াশিংটন৷ তবে যে কোনও সম্পর্কই দ্বিপাক্ষিক৷ বিষয়ে আমরা ফিলিপিন্সের সঙ্গে কথা বলব৷  প্রসঙ্গত, এখনও আমেরিকা-ফিলিপিন্স সম্পর্কের ভিত্তি ১৯৫১ সালে হওয়া একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি৷ সেই চুক্তি নাকচ করতে গেলে কিন্তু পার্লামেন্টের সমর্থন পেতে হবে দুতের্তেকে৷ আর ফিলিপিন্সের পার্লামেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে মার্কিন-পন্থী চিন-বিরোধী অবস্থান নেওয়া আইনসভাগুলির একটি বলে কূটনৈতিক মহলে পরিচিত৷ কাজেই দুতের্তের কাজটা মোটেই সহজ হবে না৷ দিন যে ভাবে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু হয়েছে ফিলিপিন্সের মন্ত্রীদের তরফে, তাতে ইঙ্গিতটা পরিষ্কার৷ তা হলে দুতের্তে দুম করে এমন একটা কথা বললেন কেন? এই প্রশ্নটা নিয়েই এখন চলছে আলোচনা৷ দেশে তাঁর বিরোধীরা বলছেন, এটা দুতের্তের আকাশছোঁয়া অহমিকা ছাড়া কিছু নয়৷ তাঁর দীর্ঘদিনের সমালোচক, সেনেটর লেইলা দে লিমার কথায়, ওঁর নিজের সম্পর্কে ধারণাটা যদি বিভ্রমের পর্যায়ে নাও পড়ে, তা হলেও সত্যিই বিরাট ফোলানো ফাঁপানো৷ উনি নিজেকে রাশিয়া চিনের সমান শক্তিশালী বলে মনে করেন৷  

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদেরও কেউ কেউ বলছেন, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতেই এমন কথা বলেছেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট৷ সম্ভবত দেশে মার্কিন উপস্থিতিতে তাঁর ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে, এমন একটা ধারণা থেকে ক্ষোভ তৈরি হয়ে থাকবে তাঁর মনে৷ বেজিংয়ের বিস্ফোরণ তারই বহিঃপ্রকাশ৷ আবার কারও মতে, ড্রাগ মাফিয়াদের বিষয়ে তাঁর নীতি ফিলিপিন্সে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে আমেরিকার মাথা ঘামানোটা মেনে নিতে পারছেন না দুতের্তে৷ কেউ কেউ অবশ্য পুরো বিষয়টাকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন নিছক পাবলিসিটি স্ট্যান্ট বলে।  

দৈনিক ই সময়, কলকাতা