পুরনো ক্ষতগুলো জানান দিয়ে যায়
পল বিটিরয়টার্স পেলেন এবারের ম্যান বুকার পুরস্কার৷ তাঁর লেখার গভীরে ঢুকতে হলে রপ্ত করতে হবে তির্যক চোখের দৃষ্টিকোণ৷ কালা আদমির দুঃখ দুর্দশা পুনর্নির্মাণ করতে শুধু চাবুক আছড়ানোর আওয়াজ আর পায়ে কবজিতে শেকলের ঘষায় কাঁচা মাংস বেরিয়ে দগদগে ঘায়ের বর্ণনা নয়, প্রাণ খুলে বেপরোয়া অথবা আড়ালে মুচকি হেসে ওঠাও সমান জরুরি সেটা পল বিটি মনে করিয়ে দেন৷
অমিতাভ মালাকার
পল বিটির জন্ম আমেরিকায়, ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলিস-এ , ১৯৬২ সালে৷ ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসটির জন্য তাঁকে প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে ম্যান বুকার প্রাইজ দেওয়া হয়েছে এ বছর৷ ওঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বয় শাফল্’ সাহিত্যকীর্তি হিসেবে’ ৯৬-’৯৭ নাগাদ পাঠক মহলে যথেষ্ট আদৃত এবং প্রশংসিত হয়েছিল, এবং রিচার্ড বার্নস্টাইনের বক্তব্য অনুযায়ী সেটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রাত্যহিকতার খঁুটিনাটি কাঁচিয়ে কুড়িয়ে মার্কিন জীবনের দুর্ধর্ষ একটি ব্যাঙ্গাত্মক দলিলও বটে --- যদিও, ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় টিকে থাকার লড়াইটিতে যেহেতু উত্পাদিত পণ্যগুলি অসীম ক্ষুধায় শেষে নিজেই নিজেকে খেতে বাধ্য থাকে , তাই , অন্য সব বিনিময় -যোগ্য পসরার মতোই সে দলিলকেও তামাদি প্রমাণ করে আরও নতুন , আরও ঝকমকে ঝলমলে মোড়কে মলাটে জড়ানো জীবন -বোধের দস্তাবেজে বাজার ভরিয়ে তুলতে হয় প্রতিনিয়ত৷
এহ বাহ্য৷ পল বিটি নিজের লেখার পাশাপাশি আফ্রিকান -আমেরিকান রসসাহিত্যের একটি সঙ্কলন সম্পাদনা মারফত অনেক তামাদির মাঝে কয়েকটি স্বর টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে আমাদের ওয়াকিবহাল করেন, সেটা ২০০৬ --- ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস্’-এ তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধও ছাপা হয়েছিল ওই বিষয়ে৷ ‘ওই বিষয়টি’ আদতে কালো মানুষদের দাসত্ব সংক্রান্ত , ক্রমান্বয়ে যেটিকে খুঁচিয়ে চলতে হয় যাতে বিস্মৃতির অন্তরালে ঘাপটি মেরে থাকতে থাকতে শেষে এক সময় তার অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন না হয়ে পড়ে --- অস্তিত্ব বলতে সমকালীন ইতিহাসে , প্রতি দিনকার বাঁচা মরায় তার ছায়া ছাপ৷ বিটি ঠাট্টা মশকরায় ওই যোগাযোগটিকে টিকিয়ে রাখেন৷ কালা আদমির দুঃখ দুর্দশা পুনর্নির্মাণ করতে শুধু চাবুক আছড়ানোর আওয়াজ আর পায়ে কবজিতে শেকলের ঘষায় কাঁচা মাংস বেরিয়ে দগদগে ঘায়ের বর্ণনা নয়, প্রাণ খুলে বেপরোয়া অথবা আড়ে আড়ালে মুচকি হেসে ওঠাও সমান জরুরি , পল বিটি মনে করিয়ে দেন৷
তাঁর এই উপন্যাসটি মোট আঠেরো জন প্রকাশক ছাপার অযোগ্য বিবেচনাপশ্চাত্ ফিরিয়ে দেন৷ ‘তবে কি তাঁরা ভেবেছিলেন যে বইটা বিক্রি হবে না?’--- এমন সন্দেহ বিটির মনেও দানা বাঁধে৷ সেটা অস্বাভাবিক নয়৷ বিটি যে ধরনের রসসৃষ্টি করেন , তাতে হেসে ওঠার পাশাপাশি তির্যক দৃষ্টিতে সব কিছুকেই দেখার অভ্যাস ওঁর উপন্যাসের দুই মলাটের ভিতর যতক্ষণ বাস , ততক্ষণ স্বাভাবিক একটি পাঠ -কৌশল , অন্তত রসিকতার প্রাথমিক স্তরটি পেরিয়ে পাঠোদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই৷ পাঠককে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বিটির কৌশল খানিকটা রন্ত করতে হয় , অবশ্য অ্যাফ্রো -আমেরিকান লেখকদের পড়ার অভ্যাস যাঁদের আছে, এটা তাঁদের রক্তে মিশেছে অনেককাল৷ বিটি কেবল এই অভ্যাসটাকে কাজে লাগিয়েছেন পাঠের রাজনীতির সঙ্গে পাঠকের রাজনৈতিক বিশ্বাস অবিশ্বাস দ্বন্দ্ব তৈরির কাজে৷ এটাও যে খুব নতুন অভিনব কিছু তাও নয় , ঠিক ওই ঠাট্টা ব্যঙ্গের মতোই --- তাই হয়তো মজা করেই রোমন্থন --- ‘সম্পাদকরা যখন বলেন যে লেখাটা ভালো হওয়া সত্ত্বেও বইটা করা গেল না , তখন আমি বেশ ব্যথিত হই… খানিকটা রোমান্টিসাইজ করতেই ফিরে যাই হার্লেম রেসেসাঁসের কালে যখন শোনা যেত কেউ বলছেন বইটা বিকোবে না ঠিকই , তবে তোমার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে৷’ কোথাও যেন লেখা , ছাপাই , কেতাবের ব্যবসা , লেখক, লেখা ছাপানোর লড়াই , বাজার , কাটতি , লাভ , লোকসান, কালো লেখক , সাদা বাজার সবটা মিলেমিশে গেছে --- মিলেমিশে আছে তাঁর পুরস্কার পাওয়া বইটির সঙ্গে , ‘কম দামি’ প্রকাশকের আস্থা প্রকাশে , সাদা বাজারে কালো মানুষের ব্যঙ্গাত্মক ঠাট্টা ইয়ার্কির পসরা সাজিয়ে ‘আয় ভাই, একবারটি কিনে পড়ে দেখ’ বলার মধ্যেও৷
আলাদা করে অনৈতিহাসিক কোনও প্রেক্ষিতে নিজেকে এবং উপন্যাসগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করে , ইতিহাস -বিচ্ছিন্ন এক লেখক ইতিহাস-বিমুখ পাঠকের কলা কৈবল্যবাদী অভিসন্ধিগুলিকে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য এ লেখা লিখছেন না সেটা পরিষ্কার , বরং তাঁদের টেনে আনছেন লড়াইয়ের এক দুনিয়ায়৷ পাঠক তার পর কী ভাবে সবটার মোকাবিলা করেন নিজের জীবনের সঙ্গে লেখা এবং কালো মানুষদের লেখার ইতিহাসের টুকরোটাকরা জুড়ে বা লেখাগুলিকে কোন কায়দায় আপন আপন মগজে সস্তা চুটকির পর্যায়ে নামিয়ে আনেন সেটা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যাপার৷ অস্বস্তি একটা কাজ করে বিটির লেখা পড়ার সময় , তার খানিকটা রেশও থেকে যায় অনেকটা ওই নিনা সিমোনের গানের মতো , ভালো লাগা আর বেদনার একটা বোধ মিলে মিশে যায়, বাজনার তালে সুরে শরীর দুলে উঠলে পুরনো ক্ষতগুলো ফের একবার জানান দিয়ে যায় --- আছি ভাই৷
দৈনিক এই সময়, কলকাতা, ভারত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন