ভারতের ০০৭ অজিত ডোভাল!
চার বছর আগের অপারেশন ব্লু-স্টারের স্মৃতি তখনও ম্লান হয়নি। ১৯৮৮ সালের মে মাসের প্রথম দিকে ভারতের কেন্দ্রে রাজীব গাঁধীর সরকার। পাঞ্জাবে শিখদের স্বর্ণমন্দিরের দখল নিল খলিস্তানপন্থী সশস্ত্র জঙ্গিরা। জঙ্গিদের জন্য স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে আটকে গেছেন পুণ্যার্থীরা। এই দলে আছেন রোমানিয়ার কূটনীতিক লিভিউ রাড়ু। পঞ্জাবের পুলিশ প্রধান কেপিএস গিল। সরকারের কাছে খবর ছিল, জঙ্গির সংখ্যা ৪০ জন। জবাবে ৭০০ বিএসএফ জওয়ান স্বর্ণমন্দির ঘিরে ফেলেছে। দিল্লি থেকে হাজির হয়েছে ৩০০ এনএসজি কম্যান্ডো। জঙ্গিদের সঙ্গে কথা চললেও কোনও ফল মিলছে না। যখন-তখন শুরু হতে পারে অভিযান। পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত।
১৯৮৮ সালে খালিস্তানি জঙ্গিদের হাত থেকে পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দির রক্ষা করার পিছনে সব থেকে বড় অবদান ছিল আইপিএস অজিত ডোভালের। যখন স্বর্ণমন্দিরের দখল নিয়েছে জঙ্গিরা সেই সময় ওই মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রুজির টানে হাজির হয়েছিল এই ফেরিওয়ালা। এই কয়েক দিন ধরেই স্বর্ণমন্দিরের সামনে ঘুরঘুর করছিলেন এই ফেরিওয়ালা। বেঁটেখাটো চেহারা। কেউই বিশেষ লক্ষ করেনি। কিন্তু এক দিন জঙ্গিরা তাঁকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল। যিনি খালিস্তানি জঙ্গিদেরকে নিজেকে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট বলে পরিচয় দিয়েছিল। পাক গুপ্তচর হওয়ায় খালিস্তানি জঙ্গিরা তাকে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন সার্বিক পরিস্থিতি। কয়েক দিন পরে প্রায় সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে এলেন সেই ফেরিওয়ালা। সেই ফেরিওয়ালার থেকে মন্দিরের ভিতরে জঙ্গিদের অবস্থান এবং গতিবিধি সম্পর্কে অবগত হয় ভারতীয় সেনা। আর তাতেই জানা যায়, ৪০ নয়, জঙ্গিরা সংখ্যায় ২৫০ জনের মতো। ফলে অভিযানের বদলে মে মাসের তীব্র গরমের মধ্যে স্রেফ বিদ্যুৎ আর পানি সরবরাহ বন্ধ করে অবরোধ শুরু হয়। না, কোনও অভিযান হল না। কয়েক দিনের মধ্যে সুরসুর করে বেরিয়ে এল জঙ্গির দল, সোজা আত্মসমর্পণ। রক্তপাত ছাড়া খালিস্তানি জঙ্গিদের হটিয়ে স্বর্নমন্দিরের দখল নেয় ভারতীয় সেনা। সেদিনের সেই ফেরিওয়ালা ছিলেন আইপিএস অফিসার অজিত ডোভাল।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই মোদী ডোভালের পরামর্শ নিতেন |
ষাটের দশকে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় বর্তমান মিজোরাম রাজ্যে। সেইসময় মিজোরাম ছিল আসাম (বর্তমান অসম) রাজ্যের একটি জেলা। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) নামক এক সংগঠনের আন্দোলনের জেরে ওই এলাকাটি তখন সরকারের নাগালের বাইরে। কেন্দ্রের তরফ থেকে মিজোরামকে পৃথক রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়েও চলছে ভাবনাচিন্তা। যদিও তখন ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করতে শুরু করেছে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলন থামাতে মিজো ন্যাশনাল আর্মড ফোর্স গঠন করেছে দিল্লি। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে এমএনএফ। বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ এবং নিরাপত্তা কর্মীও নিয়োগ করে এমএনএফ। ক্রমবর্ধমান হিংসা প্রশমিত করতে আসরে নামানো হয় অজিত ডোভালকে। এমএনএফের সাত শীর্ষ নেতার ছয় জনকে নিয়ে আসেন সরকারের পক্ষে। যার ফলে ভেঙে যায় এমএনএফের মেরুদণ্ড। দীর্ঘ ২০ বছর পর ১৯৮৬ সালে শেষ হয় এমএনএফের আন্দোলন। পৃথক অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় মিজোরাম।
দুই দশক আগে কুকা প্যারি নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে উত্তপ্ত হয়েছিল ভূস্বর্গ জম্মু-কাশ্মীর। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জারি রাখতে মগজ কুকা প্যারি তৈরি করেছিল ইখয়ান-ই-মুসলিমুন নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের মাথার মগজ ধোলাই করে ওই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন অজিত ডোভাল।
শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা ছিল ভারতের প্রশাসনিক কর্তা অজিত ডোভালের। তাঁর কারণেই অনিশ্চিতভাবে পরাজয় হয়েছিল রাজাপক্ষের। চিনের পক্ষ নিয়ে ভারত বিদ্বেষী একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন রাজাপক্ষ। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার বন্দরে চিনের যুদ্ধজাহাজ রাখার অনুমতি দেওয়াকে ঘিরে উদ্বিগ্ন ছিল নয়াদিল্লি। সেই কারণে ওই দেশে রাজাপক্ষকে হারাতে বদ্ধ পরিকর ছিল ভারত। এবং এই পরিকল্পনা সার্থক করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন অজিত ডোভাল। রাজাপক্ষের সকল বিরোধীদের একত্রিত করেন ডোভাল। সেই পথেই রাজাপক্ষ পরাস্ত হয়ে যান। যা একেবারেই ছিল অনভিপ্রেত।
ছোটখাটো চেহারার মুখচোরা এই মানুষটি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-র (আইবি) প্রধান হিসেবে অবসর নেন ২০০৫-এ। কিন্তু তার আগে এক বর্ণময় কেরিয়ার তৈরি হয়েছে তাঁর। ১৯৪৫-এ ইউনাইটেড প্রভিন্স, অধুনা উত্তরাখণ্ডের গারওয়ালে জন্ম। পড়াশোনা আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে। তার পরে আইপিএস হয়ে ১৯৭২-এ সোজা আইবি-তে। এর পরে একের পর এক কঠিন পরিস্থিতি সামলেছেন।
নিজের সম্পর্কে বেশি কথা বলেন না। এবং সব তথ্য বলার মতোও না। যা মেলে সেটুকু ডোভালের কেরিয়ারের আভাস মাত্র। ১৯৬৬-তে থেকে মিজোরামে শুরু হয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। নেতৃত্বে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ)। কেরিয়ায়ের শুরুতেই গা-ঢাকা দিয়ে কাজ শুরু করেন ডোভাল। অচিরেই এমএনএফ-এর পাঁচ-ছ’জন নেতার আস্থা অর্জন করে তাঁদের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফল আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।
ডোভালের চাকরি জীবনের বড় অংশ কেটেছে কাশ্মীর সমস্যা সামলাতে। ঠিক এখন যেমন সামলাচ্ছেন। আইবি-র কাশ্মীর গ্রুপ-এর (‘কে’ গ্রুপ) নেতৃত্ব দিয়েছেন ডোভাল। এখানে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি নিয়ে কাজ করেছেন। জঙ্গি নেতাদের দলে টেনে জঙ্গি দমনের কাজ করেছেন। সে কাজের জন্য প্রচুর দুর্নামও কুড়িয়েছেন। এ বারেও পরিস্থিতির অবনতির জন্য হুরিয়ত নেতাদের অনেকে সরাসরি ডোভালের দিকে আঙুল তুলেছেন। আঙুল তুলেছে বিরোধী দল কংগ্রেসও। কিন্তু ডোভাল অবিচল।
অবিচল না থাকলে প্রায় সাত বছর পাকিস্তানে আত্মগোপন করে থাকা যায় না। নিজের মুখেই সেই আত্মগোপনের কথা জানিয়েছিলেন ২০১৪-র নভেম্বরে। এমনিতে সাবলীল উর্দু বলতে পারেন ডোভাল। ফলে পাকিস্তানে মিশে যেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হিন্দু প্রথা মেনে ছোটবেলায় কানে ফুটো করা হয়েছিল। সেই চিহ্ন মেটাতে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন ডোভাল। কিন্তু সাত বছর পাকিস্তানে কী করছিলেন? না, এ সম্পর্কে স্বভাবতই নীরব ডোভাল। কিন্তু সূত্র বলে, পাকিস্তানের পারমাণবিক গবেষণার গোপন তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডোভাল। বর্ণময় কেরিয়ারে মিলেছে পুলিশ মেডেল, প্রেসিডেন্ট মেডেল, কীর্তিচক্র। আর এই সব নিয়ে ডোভালকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মিথের বলয়। এখন সংবাদমাধ্যমে ডোভালকে ‘০০৭’ বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে।
কিন্তু ডোভালের বড় গুণ মাথা ঠান্ডা রাখা। তাই ব্যর্থতাতেও অবিচল থাকেন। কাঠমাণ্ডু থেকে ছিনতাই করা আইসি-৮১৪-র যাত্রীদের মুক্ত করার জন্য মাসুদ আজহারকে ছাড়তে বাধ্য হয় ভারত। বিমানে মাসুদ আজহারকে সঙ্গে নিয়ে যান তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা। সেই বিমানে ছিলেন ডোভালও। এত বড় বর্থ্যতার পরে যে কেউ ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু পরিচিতদের বয়ানে জানা যায়, পরের দিন একটি পার্টিতে যথারীতি প্রিয় পানীয় নিয়ে মশগুল ছিলেন ডোভাল। পঠানকোটে বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হানার সময়ে পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন ডোভাল। তাঁর নির্দেশে পৌঁছে গিয়েছিল এনএসজি। কিন্তু পরিস্থিতি সামলানোর বদলে জটিল হয়ে ওঠে। সরে দাঁড়ান ডোভাল। ডোভালের ভাবনা (ডোভাল ডকট্রিন) হল এই রকম পরিস্থিতিতে নীতি নির্ধারণ শুধু সামরিক নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
আইবি থেকে অবসর নেওয়া পরে ২০০৯-এ বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন ডোভাল। এমনিতে নয়ডার বাড়িতে বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে বাস করেন ডোভাল। প্রবল ধূমপায়ী। বিশেষ লোকজন পছন্দ করেন না। তবে কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পেলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মন দিয়ে কথা শুনবেন। অনেকের মতে, ঠান্ডা মাথার জন্যই ডোভালকে বেছে নিয়েছেন মোদী।
অনেকের মতে মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই ডোভালের পরামর্শ নিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক থেকে অন্তর্দেশীয়— ডোভালের মত মোদীর নীতি নির্ধারণে বেশ গুরুত্ব পায়। তা ছাড়া ডোভালের কড়া ধাঁচের নীতির সঙ্গে মোদীর ভাবনা বেশ খাপও খায়। যা নিয়ে মন্ত্রী পরিষদের অন্য সদস্যদের আপত্তির কথা কানাঘুষোয় শোনা যায়। ডোভালের মত মেনে কাশ্মীর আন্দোলন কড়া হাতে দমন করা নিয়েও মন্ত্রী পরিষদে মতভেদ রয়েছে। এর পরেও ডোভাল অবিচল। জম্মু-কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে সার্জিক্যাল আক্রমণের পরিকল্পনার অন্যতম কাণ্ডারী ডোভাল। তবে ডোভাল-ই যে এ যাবৎকালের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নিরাপত্তা উপদেষ্টা তা নিয়ে প্রায় কারও দ্বিমত নেই।
২০০৪-০৫ সালের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর ছিলেন অজিত ডোভাল। এর আগে সাত বছর ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে কাটিয়েছিলেন চিরশত্রু পাকিস্তানের মাটিতে। এই বিষয়ে বিন্দুমাত্রও কেউ টের পায়নি। সেই সময়ের খেলা চালেই ছোটা রাজনের মতো ডনকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৫ সালে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন