আটষট্টি দিনের উপবাসে তপস্বিনী আরাধনা সামদারিয়ার মৃত্যু!
হায়দরাবাদের উপবাস মঞ্চে আরাধনা সামদারিয়া |
অতনু বিশ্বাস
আইরিশ-কানাডিয়ান লেখিকা এমা ডোনাহিউ দেড় শতাব্দীরও আগেকার আয়ারল্যান্ডের উপোস করা মেয়েদের নিয়ে লিখেছেন দ্য ওয়ান্ডার। এই বইয়ে দেখি, লিব রাইট ক্রাইমিয়াতে নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছে ‘মিস এন’-এর কাছে। মিস এন হলেন সেবার প্রতিমূর্তি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। লিব ইংল্যান্ডের নার্স। মুক্ত চিন্তার মেয়ে। সে আয়ারল্যান্ডে এসেছে এগারো বছরের মেয়ে অ্যানা ও’ডোনেল-কে দেখবার জন্যে। অ্যানা নাকি কিচ্ছু খায়নি চার মাস। অ্যানা কেন এমন করছে, এ প্রশ্নটাই ক্রমে প্রধান হয়ে ওঠে লিবের কাছে। পারিবারিক গোপনীয়তা, ধর্মীয় মাদকতা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের রহস্যের এক অদ্ভুত সম্পৃক্ততায় একটাই শক্তি যেন মূর্ত। তা হল অ্যানার খাদ্য প্রত্যাখ্যান। এ বইয়ে আমরা দেখি বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। অ্যানার মধ্যে যেন শয়তান আর ঐশ্বরিক শক্তির যুগপৎ প্রকাশ দেখতে পায় লিব। শেষে সে হাবুডুবু খায় অ্যানার অনশন ভঙ্গ করা উচিত কি না সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে।আরাধনা সামদারিয়া হায়দরাবাদের এক সম্পন্ন জৈন পরিবারের তেরো বছরের মেয়ে। সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী। টানা আটষট্টি দিন উপোস করে মারা গিয়েছে আরাধনা। চার মাস ব্যাপী জৈন ধর্মের পবিত্র সময় ‘চৌমাসা’তে উপবাস শুরু করে সে। পরিবারের সৌভাগ্যের জন্যে। নবকার মহামন্ত্রে রয়েছে ৬৮টি অক্ষর, তাই এই ৬৮ দিনের ‘উপবাস’। এ সময়ে দিনে দু’বার শুধুমাত্র ফোটানো জল ছাড়া আর কিছুই খায়নি সে। প্রথম ২৫ দিন এ অবস্থায় ইস্কুলে পর্যন্ত গিয়েছে। পৃথিবী চমকে উঠেছে এ খবরে। পরিবার কী করে প্রশ্রয় দেয় এমন আত্মহত্যায়! এটা কি আত্মহত্যায় প্ররোচনা নয়?
আরাধনা সামদারিয়া হায়দরাবাদের এক সম্পন্ন জৈন পরিবারের তেরো বছরের মেয়ে। সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী। টানা আটষট্টি দিন উপোস করে মারা গিয়েছে আরাধনা। চার মাস ব্যাপী জৈন ধর্মের পবিত্র সময় ‘চৌমাসা’তে উপবাস শুরু করে সে। পরিবারের সৌভাগ্যের জন্যে। নবকার মহামন্ত্রে রয়েছে ৬৮টি অক্ষর, তাই এই ৬৮ দিনের ‘উপবাস’। এ সময়ে দিনে দু’বার শুধুমাত্র ফোটানো জল ছাড়া আর কিছুই খায়নি সে। প্রথম ২৫ দিন এ অবস্থায় ইস্কুলে পর্যন্ত গিয়েছে। পৃথিবী চমকে উঠেছে এ খবরে। পরিবার কী করে প্রশ্রয় দেয় এমন আত্মহত্যায়! এটা কি আত্মহত্যায় প্ররোচনা নয়?
চমক বাড়তেই থাকে। খবরে প্রকাশ, ‘বাল তপস্বী’ আরাধনার আটষট্টি দিনের উপবাস ভঙ্গের দিন তুমুল সমারোহে পালিত হয় ‘পারণা’ উৎসব। অথচ উপবাসের দীর্ঘ সময় করা হয়নি তার প্রয়োজনীয় ডাক্তারি পরীক্ষাও। তার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে দু’দুজন ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও। এবং, স্থানীয় হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতারাও যোগ দিয়েছে এ উৎসবে, যেমনটা হয়েই থাকে এ দেশে।
উপবাস বিভিন্ন ধর্মেই পবিত্র হিসেবে গণ্য। হিন্দু ধর্মে আজও রয়েছে হাজারো উপবাসের বিধান। তবে আজকের উপবাসগুলি এক-আধ দিনের জন্যই। ইসলাম ধর্মেও রয়েছে উপবাস। পবিত্র রমজান মাসে উষা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ছোটখাটো উপবাসের আচার থাকলেও কঠিন বা প্রান্তিক অনশন বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতির বাইরে। মনে রাখতে হবে সুজাতার পায়েস খেয়েই গৌতম পরিণত হন বুদ্ধে। জৈন ধর্মে অবশ্য উপবাসের উপরে জোর অনেকটাই। কৃচ্ছ্রসাধনই এ ধর্মের মূল কথা। এ ধর্মে রয়েছে ‘সান্থারা’র বিধান। জাগতিক সমস্ত চাওয়াপাওয়ার শেষে নিরম্বু উপবাসে দেহরূপ পিঞ্জর থেকে মুক্তিই হল ‘সাল্লেখানা’ বা ‘সান্থারা’। চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীরের নির্বাণ লাভ হয়েছিল এ ভাবেই। ২০০৬ সালে রাজস্থান হাইকোর্টে সান্থারার বিপক্ষে এক পিআইএল জমা পড়ে, যেখানে দাবি করা হয় যে মুক্ত পেশা, অনুশীলন আর ধর্মপ্রচারের জন্যে নির্দেশিত সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে জীবন রক্ষার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নির্দেশিত ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের বিরোধ রয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা কখনওই নিরঙ্কুশ হতে পারে না, তা জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্য সাপেক্ষেই সম্ভব। ২০১৫-র এক রায়ে রাজস্থান হাইকোর্ট রাষ্ট্রকে সান্থারার অনুশীলন বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য স্থগিতাদেশ দিয়েছেন রাজস্থান হাইকোর্টের এই রায়ের উপরে। অতি সম্প্রতি কলকাতার এক রোগযন্ত্রণাতুরা অশীতিপর বৃদ্ধার সান্থারার প্রচেষ্টা আবার উসকে দিয়েছে বিতর্কের সলতে। কিন্তু সান্থারা প্রধানত বয়স্করাই করেন, আরাধনার বয়সী ছোট্ট মেয়েরা নয়।
দীর্ঘ উপবাসের অনেক নজির রয়েছে ইতিহাসের পাতাতেও। রাজনৈতিক আন্দোলনের আর সামাজিক অধিকার অর্জনের এ এক বড় হাতিয়ার। কিন্তু সে সবই কিছু না কিছু অর্জন করার লক্ষ্যে প্রাপ্তবয়স্কের উপবাস। এগারো বা তেরো বছরের মেয়ে কোন সে অমৃতের আকাঙ্ক্ষায় করতে পারে এমনটা? কতটাই বা থাকতে পারে তার অমৃতের বোধ? এই প্রশ্নেই অ্যানা আর আরাধনা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেই কবে রবীন্দ্রনাথের ‘গুরু’তে শুনেছি আচার্যের মত: সুভদ্র মানুষ কিংবা শিশু বলেই দেবতাদের প্রিয়। গায়ের জোরে দেবতা গড়ার ‘পাপে’ লিপ্ত হতে চাননি আচার্য। কিন্তু তা দেখি হয়ে চলেছে আজও। শিশুর অধিকার রক্ষার এক সংস্থা আরাধনার বাবাকে দোষারোপ করে অভিযোগ করেছে। অভিযোগ, পারিবারিক জুয়েলারি ব্যবসা ভাল না চলায় এক জৈন গুরুর পারামর্শে তাঁরা মেয়েকে জোর করে এই ‘উপবাস’ করান। ও দিকে পরিবার জানিয়েছে যে, ধর্মীয় গুরুরা তাদের শোক না করে উৎসব করতে বলেছেন, কারণ আরাধনা ‘মোক্ষ’ লাভ করেছে। হায়দরাবাদে এক সভা করে জৈন নেতারা আরাধনার বারা-মার পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের ধর্মীয় বিষয়ে অন্যদের নাক গলাতে নিষেধ করেছেন।
আমার ঘরেও আছে তেরো বছরের ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে। কোনও কারণে সে একবেলা না খেলে আমাদের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, আমরা চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠি। এটাই স্বাভাবিক। সর্বত্রই। ঈশ্বর পিতা-মাতার হৃদয়ে সন্তানের জন্যে ঢেলে দিয়েছেন স্নেহের স্রোতস্বিনী। ধর্মীয় সংস্কার বা বিষয়বুদ্ধি সেই স্বাভাবিক স্নেহকে ছাপিয়ে উঠলে আমরা অস্বস্তি অনুভব করি, বিপন্ন বোধ করি। আরাধনার ঘটনাটা এমনই এক দৃষ্টান্ত। সতীদাহ প্রথা কি এর থেকেও নিষ্ঠুর বা ভয়ঙ্কর ছিল? সেখানে তো তবু এক বারে চিতায় ঠেসে মেরে ফেলা হত, ৬৮ দিন ধরে নয়। আর পিতামাতা অন্তত সন্তানের হত্যা-যজ্ঞে সক্রিয় থাকতেন না, করতেন না উৎসব।
এগারো বা তেরো বছরের নাবালিকা ধর্মকে কতটা উপলব্ধি করতে পারে? ধর্মের আফিম খাইয়ে কোথাও দেখি নাবালকদের দিয়ে অন্যকে মারা হয়, কোথাও আবার নিজেকে। আফিমটাকে নিষিদ্ধ করতে হলে সর্বক্ষেত্রেই করা উচিত। মেয়েটির পরিবার তার উপোস ভাঙার দিনে সগৌরবে উদ্যাপন করে তার ‘বাল তপস্বী’ হওয়াটা। এমনকী তার দু’দিন পরে তার মৃত্যুর পরেও করে ‘শোভাযাত্রা’। ৬০০ লোক তাতে যোগ দেয়! হ্যাঁ, সন্ত্রাসবাদেরও সমর্থক থাকে, হোক না তা এক তেরো বছরের মেয়ের উপরে তার নিজের বা পরিবারের সন্ত্রাস। এ ঘটনা ‘আত্মহত্যা’ হলেও সেখানে পরিবারের প্ররোচনা নেই কি? নাবালিকা যদি স্বেছায় ৬৮ দিন উপবাস করতেও চায়, তাকে জোর করে না খাওয়ানোটাও কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? জানা গিয়েছে এর আগেও ২০১৪-তে এগারো বছরের আরাধনা আট দিনের ‘উপবাস’ করে, আর তার পরের বছর ৩৪ দিন।
আমাদের ঘরের কন্যাকে কবে যে আমরা কন্যা হিসেবেই সম্মান করতে পারব! কবে যে তাকে নিয়ে উৎসব আর গর্ব করবার জন্যে তার আর ‘বাল তপস্বী’ হওয়ার প্রয়োজন হবে না!
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা’য় রাশিবিজ্ঞানের শিক্ষক
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন