বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

বাঘ না বাঁচলে বিশ্বকে কি বাঁচানো যাবে?

বাঘেরা মোটেই ভালো নেই, কারণ বনভূমি নিধন, পোচিং, বনভূমিগুলির মধ্যে যোগাযোগ নষ্ট ওয়া উল্লেখ্য৷ উপায়? চোরাশিকার বন্ধে পাহারাদারি আর কড়া আইন প্রণয়ন প্রয়োগ এবং অরণ্যচ্ছেদন বন্ধ করতে হবে৷ চোরাশিকার যথেচ্ছ বনভূমি নিধনের হাত থেকে বাঘকে রক্ষা করা যাবে?


তন্ময় চৌধুরী


গোটা পৃথিবীর অরণ্যে মোট তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বাঘ বেঁচে আছে, বেশির ভাগই ভারতে৷ সে সংখ্যা হাজার দুয়েকের কাছাকাছি হবে৷ কিন্তু তো গেল রয়াল বেঙ্গল টাইগারের কথা৷ জীবিত বাকি প্রজাতিগুলোর মধ্যে ইন্দোচাইনিজ প্রজাতির বাঘের সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে তিনশোতে, মালায়ান টাইগার পাঁচশোর মতো, আর সাইবেরিয়ান টাইগারে সংখ্যা মাত্র তিনেক৷ সাউথ চায়না টাইগারের সংখ্যা তো একশোরও কম, সুমাত্রান টাইগারও বড়ো জোর চারেক হবে৷

গত শতাব্দীর তিনের দশকে বালি টাইগার, সাতের দশকে ক্যাসপিয়ান টাইগার আর আটের দশকে জাভান টাইগার পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ সংখ্যাতত্ত্বই বোঝাচ্ছে, বাকি প্রজাতিগুলোরও বিলুন্তির বেশি দেরি নেই৷ অবশ্য পৃথিবী থেকে বাঘ বিলুপ্ত হলে হবেটা কী? আন্দাজ করা যেতে পারে৷



এই জঙ্গলের সর্বোচ্চ শ্বাপদ হল লেপার্ডকিন্তু গাউর, হাতি বা গন্ডারকে মারার ক্ষমতা তার নেই৷ ফলে তৃণভোজী প্রাণীদের অনিয়ন্ত্রিত প্রজননের দরুণ এতটাই তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে যে মনুষ্যবসতিতে তারা প্রায়শই হানা দিচ্ছে৷ অভয়ারণ্য সংলগ্ন অঞ্চলে তারা শস্যের ক্ষতি করে চলেছে৷ মানুষের সঙ্গে এদের সংঘাত ঘটেছে অনিবার্য ভাবেই৷ এখানে যদি বাঘ থাকত, তৃণভোজীদের সংখ্যাবৃদ্ধির ওপর একটা রাশ থাকত৷

সুন্দরবনের কথাই ধরা যাক৷ সুন্দরবনের যে দ্বীপগুলো ব্যাঘ্র অধ্যুষিত নয়সেখানকার জঙ্গল আর ব্যাঘ্র অধ্যুষিত দ্বীপগুলোর জঙ্গলের তুলনা করলেই সহজেই প্রতিভাত হবে দক্ষিণ রায়ের আসল অবস্থান৷ সে শুধু জঙ্গলের রাজাই নয় পাহারাদারও বটে৷ আসলে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে আছে বাঘ৷ অবলুপ্ত হলে খাদ্যশৃঙ্খলটা আর থাকবে না৷ প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে৷

১৯০০ সালে ভারতেই বাঘের সংখ্যা ছিল লক্ষের কাছাকাছি৷ আর ১৯৭০ সালে এই সংখ্যাটা নেমে এল চার হাজারে৷ অর্থাৎ সত্তর বছরে ছিয়ানব্বই হাজার বাঘ মারা হয়েছে৷ ভারতের স্বাধীনতার পরেও বহু রাজ্যে বাঘ মারাটা কোনও অপরাধ ছিল না৷ ছিল শৌর্যের পরিচয়৷ এক বাঘেল রাজাই একশো আটটা বাঘ মেরেছিলেন৷ এটা নাকি তারা বংশানুক্রমে পালন করে চলতেন৷ এর বেশির ভাগই বহু লোক-লস্কর, বন্দুক, হাতি দিয়ে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যা বিনা কারণে৷ ফলাফল ভারতের প্রথমটাইগার ক্রাইসিস সেটা ছিল সত্তরের দশক৷ ইতিমধ্যে ভারতবাসী সংখ্যায় বেড়েছে৷ শিল্প বিপ্লব এসে গেছে ভারতবর্ষে৷ আরও বেশি জমি চাই৷ শহর বাড়াতে হবে, কৃষি জমি বাড়াতে হবে, চাই আরও খাদ্য, চাই জলবিদ্যুৎ, অতএব গাছ কাটো৷

পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে অরণ্যচ্ছেদনের হার বছরে তিন শতাংশেরও বেশি৷ বাড়ি, রাস্তা, রেল, কারখানা তৈরির ফলে উত্তরোত্তর বাঘেদের বাসস্থান কমল৷ এক অরণ্যের সাথে অন্য অরণ্যের দূরত্ব তৈরি হল৷ এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যে যেতে হল অনিবার্য হল মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণের সংস্পর্শ৷ ফল যা হবার তাই হল৷ বাঘেদের সংখ্যা কমল দ্রুত৷ তৈরি হল আর এক সংকট৷

ভারতে শেষ দুদশকে জনসংখ্যা বেড়েছে পঞ্চাশ শতাংশ, শেষ চার দশকে চিনের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে৷ চীন অরণ্য ধ্বংস করছে৷ ভারতে ঘটনাটা একটু অন্য রকম৷ সেখানে লাগোয়া দুটো অরণ্যের মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে দরিদ্র জনগণ৷ এই দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ বাঘ হয়তো গবাদি পশু মারছে৷ বাঘের খাবার হয়তো যাচ্ছে মানুষের পেটে৷

গ্রামবাসীরা তাই আক্রোশে মৃত পশুটির মাংসে মেশাচ্ছে বিষ৷ পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্কে এই গ্রীষ্মেই বাঘিনালার বাঘিনী এই রকম এক ঘটনায় দুই বাচ্চা -সহ প্রাণ হারিয়েছে৷ তা ছাড়া দালালদের কাছেও তো এসেছে তথ্য, যে বাঘেদের সর্বাঙ্গ মঙ্গোলিয় প্রজাতির কাছে বিকোয় চড়া দামে৷ দালালরা ধরল ফড়েদের হাত৷ তারা চলে এল আদিবাসীদের কাছে৷ আদিবাসীরা বড়ো হয়েছে অরণ্যের মাঝে৷ অরণ্যকে তারা নিজেদের হাতের তালুর মতো চেনে , কিন্ত্ত অনাহার যে তাদের নীতি নৈতিকতাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে ক্ষুধাভর্তি পেটে৷ তাই খুব স্বল্প অর্থের বিনিময়ে তারা সংসার চাঁদদের বাঘের সর্বাঙ্গের জোগানদার হয়ে ওঠে৷ হঠাত্ এক দিন দেখা যায় সারিস্কা থেকে বাঘ ভ্যানিশ৷ রঘু চান্দোয়াত আর্তনাদ করে ওঠেন পান্না ন্যাশনাল পার্কের বাঘেদের অবস্থা দেখে৷ প্রথম প্রথম তারা জঙ্গলে ঢুকত সাবেকি অস্ত্র, সাবেকি ফাঁদ নিয়ে৷ কিন্ত্ত এক সময় তাদের হাতে এসে গেল আধুনিক মারণাস্ত্র৷ মারণক্ষমতা বাড়ল কয়েক গুণ৷ কিছু কিছু চোরাশিকারি ধরা পড়ল, শাস্তিও হল৷ কিন্তু চোরাশিকার থামানো গেল না পুরোপুরি৷ বিপন্নতার আরও কারণ বাঘের স্বভাব৷ দুই থেকে তিন বছর বয়সের বাঘেরা মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকার পর নিজেদের আলাদা জায়গা খুঁজতে থাকে৷ নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখতে বাঘের ত্রিশ বর্গ কিলোমিটার এবং বাঘিনীর পাঁচ থেকে দশ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রয়োজন৷ অরণ্যচ্ছেদনের ফলে অরণ্য বহরে কমছে৷ ফলে এলাকা দখলের প্রয়োজনে বাঘকেকোরএরিয়া ছেড়েফ্রিঞ্জএলাকায় চলে আসতে হচ্ছে, অতঃপর মানুষের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়ছে৷

খবরে প্রকাশ, বছরের ২৬ জুন পর্যন্ত ভারতে ৭৪টি বাঘ মারা পড়েছে৷ সরকারি ছবিই যদি এই রকম হয়, তা হলে আসল চিত্রটা আরও ভয়ঙ্কর হতেই পারে৷ ওয়াল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া দেওয়া চিত্রটা দেখলে স্পষ্ট হবে, চোদ্দটি বাঘ হয় তড়িতাহত, না হলে বিষক্রিয়া বা চোরাশিকারিদের হাতে প্রাণ দিয়েছে৷ আর ষোলোটা বাঘের থাবা বা নখ বা দেহের অন্য কোনও অঙ্গ পুলিশ বা বনবিভাগের দ্বারা উদ্ধার হয়েছে৷ সুতরাং সংখ্যাটা দাঁড়াল ত্রিশ৷ আঠেরোটা বাঘের মৃত্যু হয়েছে বার্ধক্য, নিজেদের মধ্যে মারামারি বা ট্রেন বা সড়ক দুর্ঘটনাায়৷ বাকি ছাব্বিশটাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাঘের মৃত্যু হয়েছে মধ্যপ্রদেশে (১৯টি )৷দ্বিতীয় স্থানে আছে উত্তরাখণ্ড (৯টি )

বাঘেরা মোটেই ভালো নেই, ভালো না থাকার কারণও একাধিকবনভূমি নিধন, পোচিং, বনভূমিগুলির মধ্যে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রভৃতি উল্লেখ্য৷ তা হলে উপায়? সোজা হিসেব, এক, চোরাশিকার বন্ধ করতে পাহারাদারি আর কড়া আইন প্রণয়ন প্রয়োগ এবং দুই, অরণ্যচ্ছেদন বন্ধ করতে হবে৷

মঙ্গোলিয় উপজাতির কাছে বাঘের বিভিন্ন অঙ্গের চাহিদা মেটাতে তাদের সামনে বিকল্প উপস্থাপন করা যেতে পারে৷ যথা, আয়ুর্বেদিক চিকিত্সা৷ সহজলভ্য এই বিকল্প তাদের ব্যাঘ্রনিধনে অনুৎসাহিত করতে পারে৷

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া অরণ্যের থেকেও বোধ হয় বাঘেদের বিপদ চোরাশিকার৷ চিনেদের আড়কাঠিরা দেশে নানা পদ্ধতিতে চোরাশিকার করে , যেমন বিষপ্রয়োগবাঘ সাধারণত একেবারে নিজের শিকারের পুরোটা খেয়ে ফেলে না৷ লুকিয়ে রাখা আধ -খাওয়া শিকারে বিষ প্রয়োগ চোরাশিকারিদের প্রিয় অস্ত্র৷ বা ধরা যাক , স্টিল ট্র্যাপ , এগুলি এত শক্তিশালী যে এগুলোকে খুলতে ছয় -সাত জন শক্তিশালী পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রয়োজন৷ হাল আমলে আগ্নেয়াস্ত্র বা ২২০ ভোল্ট ১১ কেভি বৈদ্যুতিক তার বাঘের চলাচলের পথে ফেলে রেখে বাঘ মারার পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছে মধ্য ভারতের কিছু জঙ্গলে৷

ভারতে চোরাশিকারিদের বিরুদ্ধে সে সমস্ত ধারা প্রয়োগ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি বেশ নমনীয়৷ ১৯৭২ সালেরওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্টঅনুযায়ী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর জেল অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুটোই৷ টাইগার রিজার্ভের কোর এরিয়াতে অপরাধ সংঘটিত হলে পঞ্চাশ হাজার থেকে লক্ষ টাকা জরিমানা এবং তিন বছর জেল৷ ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, ৯০০ - উপর বাঘ সম্পর্কিত কোর্ট কেসের অল্প কয়েকটির মাত্র ফয়সালা হয়েছে৷ এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দরকার আরও কঠোর আইন এবং তার দ্রুত প্রয়োগ এবং প্রণয়ন৷ দ্বিতীয়ত, ‘বাঘবনচিহ্নিত অরণ্যগুলিকে রক্ষা করতে হবে৷ চাই জনমত গঠন৷ এখানেই ছোটখাটো সোসাইটিগুলোর ভূমিকা৷


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন