রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

এনআরবিসি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগে অর্থমন্ত্রীর হুমকি 

চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের পক্ষে-বিপক্ষে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু

ভালো নেই ‘এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড’। ২০১৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরুর তিন বছরের মাথায় ব্যাংকটির পরিচালকরা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন; একে অন্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনছেন। চেয়ারম্যানের পক্ষে রয়েছেন কয়েকজন পরিচালক। অন্য পক্ষে রয়েছেন, আরেকদল পরিচালক। এখানে দলবাজি অনেকটা চরমে উঠেছে। তারা একে অন্যকে অপসারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ধরনা দিয়েছেন। আর এতে করে ব্যাংকটির সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ঘোরতর শঙ্কা ব্যক্ত করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে বলা হয়েছে-‘পরিচালকরা এভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে ব্যাংকটির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে এবং আমানতকারী ব্যাংকটির ওপর আস্থা হারাবে।’ স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগ করা যেতে পারে’। ব্যাংকিং বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিাল ব্যাংক সূত্রে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন পক্ষ থেকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে বিভিন্ন অনিয়মের খবর অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এসব বিষয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গোচরীভূত করা হয়। পরে অর্থমন্ত্রী এই ব্যাংক সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংককে গোপন পরিদর্শন কাজ পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এই গোপন পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন করে তা অর্থমন্ত্রী ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিবের কাছে প্রেরণ করে।

জানা গেছে অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকিং বিভাগ থেকে পাঠানো এই ব্যাংকের ওপর পরিচালিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিদর্শনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরাসত আলী কর্তৃক পাঁচজন পরিচালকের বিরুদ্ধে আনীত ঋণ ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগগুলো পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে, বিকল্প পরিচালক এ এম সাইদুর রহমান ও এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান ভলান্টারি অর্গানাইজেশন ফর সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট (ডিওএসডি) নামক এনজিও-এর নামে ব্যাংকটি থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন। যার পরিদর্শনকালে স্থিতিশীল ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আবার উদ্যোক্তা পরিচালক মো: আদনাম ইমাম অরনিতা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের নামে বরিশালের উজিরপুরের কৃষিভিত্তিক প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকটি থেকে তিন কোটি টাকা (পরিদর্শনকালে স্থিতি দুই কোটি ৯২ লাখ টাকা) ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজেই সেই ঋণের সুবিধাভোগী হয়েছেন। ফলে তদন্তকালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের অভিযোগে বর্ণিত ঋণ হিসাবসমূহের সর্বসাকুল্য আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ব্যাংকিং বিভাগ থেকে আরো বলা হয়েছে,‘ বর্ণিত ঋণ হিসাবসমূহ সরাসরি ব্যাংকের পরিচালকদের নামে না হওয়ায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রদত্ত ঋণসমূহ ব্যাংকের পর্ষদ/পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটি কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত হওয়ায় আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে উল্লিখিত পরিচালকদেরক অপসারণের পদক্ষেপ নেয়া এ পর্যায়ে সমীচীন হবে না বলে পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য দিকে অভিযুক্ত পরিচালকরাও বিকল্প পরিচালক সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তার দলভুক্ত অন্যান্য পরিচালকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে বেশ কিছু গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। তবে এই অভিযোগ সময়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। ’

এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকিং সচিব মো: ইউনুসুর রহমান একটি নোট দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘ব্যাংকের পরিচালকরা (এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক) এভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে ব্যাংকটির পরিচালনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে এবং আমানতকারীরা ব্যাংকের ওপর আস্থা হারাবে। একটি নতুন ব্যাংক হিসেবে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী অবস্থান কাম্য নয়। সার্বিক বিবেচনায় বিদ্যমান পরিচালকদের কোনো ধরনের অনিয়মে না জড়িয়ে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যাংক পরিচালনায় মনোনিবেশ করার জন্য অর্থমন্ত্রী মহোদয় কর্তৃক পরামর্শ প্রদান যথাযথ হবে। ’

এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রী একটি নোট দিয়েছেন। তিনি তাতে উল্লেখ করেছেন, ‘পরামর্শ দেয়া যেতে পারে, তবে এর অন্তর্দ্বন্দ্ব তাতে প্রশমিত হবে বলে মনে হয় না। আমি বোর্ডের সদস্যদের ডাকতে পারি। তবে কিভাবে এর সুরাহা হবে তা স্পষ্ট নয়। প্রশাসক নিযুক্তির হুমকি দেয়া যায়, তা হলে হয়তো তাদের সম্বিত ফিরতে পারে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এনআরবি কমার্শিয়ালসহ সব ব্যাংকই আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। তাই কোনো ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে যদি আমানতকারী বা ব্যাংকিং কার্যক্রমে সমস্যা হয় তাহলে আমরা আইন অনুযায়ী তা কঠোরভাবে দমন করব। এ ব্যাপারে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই আসে না।

অন্য দিকে, ব্যাংকিং বিভাগ থেকে জানা গেছে, এই ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

দৈনিক নয়া দিগন্ত,  রোববার, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন