রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬

পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রের বাতাসে বিষ, বৃষ্টির জলেও শুকোয় পাতা


সোমনাথ মাইতি

এই সময়, কলকাতা, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬

বর্ষার ভরা মরসুমেও বার রূপোলি শস্যের তেমন দেখা মেলেনি পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটে৷ কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকায় বাতাসে যেন বিষ৷ মানুষ, জীবজন্ত্ত, গাছপালা, চাষের ফসল, কোনও কিছুরই নিস্তার নেই৷ তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের চিমনি থেকে বাতাসে ভাসতে থাকা ছাইয়ের আস্তরণ পড়ছে কোলাঘাটের প্রধান অর্থকরী ফসল, ফুল পানের আবাদে৷ এর ফলে উত্পাদন কমার সঙ্গে সঙ্গে ওই ফসলগুলির গুণমানও নামছে৷ 

তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রের ছাইয়ের দূষণ যে সর্বনাশ করেছে নদীর৷ দূষিত জলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে ইলিশের ঝাঁক৷ শুধু নদী নয় , কোলাঘাটে চাষের জমি, গাছ, খাল-বিল কিছুরই নিস্তার নেই দূষণে থেকে৷ বাতাসে ভেসে থাকা তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ছাই বৃষ্টির জলে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি হয়ে ঝলসে দিয়েছে গাছের পাতা৷  

কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পানি-মাটি

এক সময় কোলাঘাটে প্রচুর ইলিশের দেখা মিলত৷ আর দূষণের কারণে ইলিশরা ডিম পাড়ার জন্যও আর কোলাঘাটমুখো হচ্ছে না৷ এ বার তাই ভরা মরসুমেও ইলিশের দেখা মেলেনি৷


ছাই-দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছেন স্থানীয় দূষণ প্রতিরোধ কমিটি কৃষক সংগ্রাম পরিষদ৷ তাদের আন্দোলনের জেরে ২০১৪ সালে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষকে দফা নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ৷ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সেই নির্দেশ এখনও সম্পূর্ণ কার্যকর করে উঠতে পারেননি তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ৷ যদিও কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ম্যানেজার তাপস পাত্রের দাবি, ‘ছাইয়ের দূষণ নিয়ে একাধিক পদক্ষেপ করা হয়েছে৷ আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে৷ 

উত্তর জিয়াদা গ্রামের সুশান্ত পাত্র বলেন, ‘ফুল পান বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগে জলে ধুয়ে নিতে হচ্ছে৷ ধোঁয়ার ফলে কমছে আমাদের আয়ু৷কলা, আম, পেয়ারা গাছের ক্ষতি হচ্ছে৷ বারের বর্ষায় তো কোলাঘাট , বাবুয়া , শান্তিপুর , মহিষগোট , মেচেদা এলাকায় মাঝে মধ্যে হলুদ বৃষ্টি হতে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা৷ এই বৃষ্টির জল গাছে পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে পাতা৷ এলাকায় বাড়ছে চর্মরোগ শ্বাসকষ্ট জনিত অসুখ৷ এই সমস্যার কথা মানছেন চিকিত্সকরা৷ চর্মরোগ হার্টের রোগ যেভাবে বাড়ছে , তাতে অবিলম্বে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় চিকিত্সক সন্তোষ মাইতি৷

স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, এক সময় কোলাঘাটে প্রচুর ইলিশের দেখা মিলত৷ আর এখন দূষণের কারণে ইলিশরা ডিম পাড়ার জন্যও আর কোলাঘাটমুখো হচ্ছে না৷ তাই ভরা মরসুমেও ইলিশের দেখা মেলেনি বার৷  
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দূষণ নিয়ে কোনও হেলদোল নেই তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের৷ কৃষক সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নারায়নচন্দ্র নায়েক বলেন , ‘রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ গত দুবছরেও কার্যকর না করায় সমস্যায় জেরবার স্থানীয়রা৷ চিমনিগুলোর আধুনিকীকরণ না করার জন্যই ছাই বাতাসে মিশছে৷ 

ছাই দূষণ কমেনি, ফের নির্দেশিকা

আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ জানিয়ে আগে একাধিকবার রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দ্বারস্থ হয়েছে এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে। কিন্তু তারপরও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অব্যাহত ছিল দূষণ। 

এই তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রে প্রতিদিন প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন কয়লা লাগে। এর থেকে প্রতিদিন প্রায় হাজার মেট্রিক টন ছাই উৎপন্ন হয়। ওই বর্জ্য ছাইয়ের একাংশ উড়ে গিয়ে পড়ায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সংলগ্ন কোলাঘাট, শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লক হাওড়া জেলার বাগনান এলাকা মিলিয়ে প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ বাসিন্দারা ছাই দূষণের শিকার। তাঁর অভিযোগ, ‘মানুষের ফুসফুস, ত্বক, চোখ-সহ নানা অসুখের এলাকার দুই প্রধান অর্থকরী ফসল পান, ফুলের খেতে ছাই উড়ে গিয়ে পড়ায় পান, ফুল চাষের ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া এলাকার জলনিকাশি খালগুলি ছাইয়ে মজে গিয়ে এলাকার কয়েকটি গ্রাম প্রতিবছর বর্ষাকালে জলবন্দি হয়ে পড়ে।’


অভিযোগ জানিয়ে চলতি (২০১৫) বছরের এপ্রিল-মে মাসে ফের রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তার ভিত্তিতে পর্ষদের এক বিশেষজ্ঞ দল গত অক্টোবর মাসে কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করেন গত অক্টোবর রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসে শুনানি হয়। এরপর গত নভেম্বর পর্ষদের তরফে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র কর্তৃৃপক্ষকে কয়েক দফা নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশগুলি হল, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সংলগ্ন এলাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ে তৈরি এক, দুই তিন নম্বর ইউনিটের দূষণ রোধক যন্ত্রের আধুনিকীকরণ করতে হবে ২০১৭ সালের মধ্যে। যতক্ষণ না ওই আধুনিকীকরণের কাজ হচ্ছে ততদিন ওই তিন ইউনিটের উৎপাদন মোট ক্ষমতার অর্ধেক করতে হবে। তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রের নম্বর ইউনিটে অ্যামোনিয়া ডজিংএর কাজ ২০১৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে শেষ করতে হবে। তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রের টি ইউনিটেরই দূষণ পরিমাপক যন্ত্র (ওপাসিটি মিটার) চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যে কার্যকর করতে হবে ( বর্তমানে , , নম্বর ইউনিটে চালু রয়েছে ) তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের চিমনি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের দূষণের মাত্রা অনলাইন সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়াও তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সংলগ্ন দেনান, বাপুর মেদিনীপুর খালে ছাইমিশ্রত জল ফেলা বন্ধ করার ব্যবস্থা, ছাইপুকুর থেকে ছাই তোলা গাড়িতে বহনের ক্ষেত্রে ছাই ওড়া বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই দূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কমিটির তরফে এর আগেও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে একাধিকবার অভিযোগ জানানো হয়েছিল। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বের অভিযোগ, ''এলাকায় পরিবেশ দূষণ রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ আগে একাধিকবার তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ কয়েকটি পদক্ষেপ করলেও ছাই দূষণ রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে পুরনো ছবির বদল হয়নি। কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক চিকিত্সক সন্তোষ মাইতি জানান, প্রতিটি ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি ইউনিটের এই তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রে প্রতিদিন প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন কয়লা লাগে। এর থেকে প্রতিদিন প্রায় হাজার মেট্রিক টন ছাই উৎপন্ন হয়। ওই বর্জ্য ছাইয়ের একাংশ উড়ে গিয়ে পড়ায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সংলগ্ন কোলাঘাট, শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লক হাওড়া জেলার বাগনান এলাকা মিলিয়ে প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ বাসিন্দারা ছাই দূষণের শিকার। তাঁর অভিযোগ, ‘মানুষের ফুসফুস, ত্বক, চোখ-সহ নানা অসুখের এলাকার দুই প্রধান অর্থকরী ফসল পান, ফুলের খেতে ছাই উড়ে গিয়ে পড়ায় পান, ফুল চাষের ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া এলাকার জলনিকাশি খালগুলি ছাইয়ে মজে গিয়ে এলাকার কয়েকটি গ্রাম প্রতিবছর বর্ষাকালে জলবন্দি হয়ে পড়ে।’

১৯৮৪ সালে উৎপাদন শুরু হওয়া তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাই দূষণ বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন করছে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎপরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কমিটি কৃষক সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের সম্পাদক নারায়ণ নায়েক জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে বহুবার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেন নি।' নারায়ণবাবুর কথায়, `দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সব নির্দেশ না মানায় এর আগে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করেছিল। আমরা চাই দূষণ বন্ধ করতে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ মেনে তাপবিদ্যুত্কেন্দ্র উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক।' 

কোলাঘাট তাপবিদ্যুত্কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার তাপস পাত্রের উত্তর, নির্দেশিকা মেনে দূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে তা কতৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

1 টি মন্তব্য: